Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

লঙ্কার লর্ডসে পিচ নাটকে আক্রান্ত ভারত

পার্সি অভয়শেখরা নিঃসন্দেহে এর পর কিছু একটা বানাতে বসবেন! ক্রিকেট-ছড়ায় যে লোকটার কি না এত দিনের মাস্টার ডিগ্রি, বিশ্বের তাবড় ক্রিকেটারদের অধিকাংশকে নিয়ে যিনি বাজারে নিয়মিত কিছু না কিছু ছেড়েছেন, তাঁকে কিনা ছড়ার ঠেস! ভারতীয় প্র্যাকটিসে এসেছিলেন টিম ডিরেক্টর রবি শাস্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে। লঙ্কা জার্সি নয়, একেবারে সাহেবি কায়দার পোশাকে। তা দেখলেন, রবি প্রায় দুলতে-দুলতে জালের ও পার থেকে এগিয়ে আসছেন। মুখে অদ্ভুত এক ছড়া পার্সি ইন আ টাই/ দ্যাটস নট রাইট/পার্সি ইজ রাইট/ অ্যান্ড অলওয়েজ আপরাইট!

যত কাণ্ড বাইশ গজে<br>
এসএসসি-তে শেষ পর্যন্ত ঘাস থাকবে, না থাকবে না?

যত কাণ্ড বাইশ গজে<br> এসএসসি-তে শেষ পর্যন্ত ঘাস থাকবে, না থাকবে না?

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
কলম্বো শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০১৫ ০৪:০০
Share: Save:

পার্সি অভয়শেখরা নিঃসন্দেহে এর পর কিছু একটা বানাতে বসবেন! ক্রিকেট-ছড়ায় যে লোকটার কি না এত দিনের মাস্টার ডিগ্রি, বিশ্বের তাবড় ক্রিকেটারদের অধিকাংশকে নিয়ে যিনি বাজারে নিয়মিত কিছু না কিছু ছেড়েছেন, তাঁকে কিনা ছড়ার ঠেস! ভারতীয় প্র্যাকটিসে এসেছিলেন টিম ডিরেক্টর রবি শাস্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে। লঙ্কা জার্সি নয়, একেবারে সাহেবি কায়দার পোশাকে। তা দেখলেন, রবি প্রায় দুলতে-দুলতে জালের ও পার থেকে এগিয়ে আসছেন। মুখে অদ্ভুত এক ছড়া পার্সি ইন আ টাই/ দ্যাটস নট রাইট/পার্সি ইজ রাইট/ অ্যান্ড অলওয়েজ আপরাইট!

দ্বীপপুঞ্জের দীর্ঘদিনের অফিশিয়াল সর্মথক স্তম্ভিত। কিছু একটা বলতে গিয়েও নির্বাক হয়ে গেলেন। আশপাশ থেকে ঝোড়ো হাততালি, মিডিয়ার হুল্লোড়।

দুঃখের হল, রিল লাইফ আর রিয়েল লাইফের পৃথিবীতে যেমন স্বর্গ-মর্ত্যের পার্থক্য থাকে, কখনওই দু’টো জীবন যেমন সমান্তরাল চলে না, বাইশ গজের বিশ্বও তাই। সে কখনও কখনও তার যুদ্ধকে ঘিরে এমন দৃশ্যপটের ব্যবস্থা করে যা দূর থেকে বিভ্রমের মরূদ্যান, কাছে গেলে বাস্তবের মরীচিকা। বৃহস্পতিবারের সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাবে পার্সি-শাস্ত্রীর ‘ডুয়েল’টাও অনেকটা তাই। সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীর মনে হবে, চরম হানাহানির একটা টেস্ট যুদ্ধ আসতে চলেছে ঠিকই, কিন্তু সম্প্রীতির কাঁটাতার পেরিয়ে তার আঁচ মোটেও গলতে পারছে না। সুন্দর দুপুর। সোনা রোদ। অপরূপ সৌন্দর্যের লঙ্কার ‘লর্ডসের’ প্র্যাকটিস গ্রাউন্ড। টেনশনের জায়গা কোথায়? এবং এটা ভাবলে আপনি একশোয় সাড়ে পাঁচ পেলেন! আর অধুনা ক্রিকেট-পৃথিবীতে আঁচের খোঁজে যদি সরকারি বক্তব্যের ভরসায় থাকেন, সেটাও মূর্খামি। কারণ জিওফ্রে বয়কটদের চেয়ে এখন অ্যাঞ্জেলো ম্যাথেউজরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। সেখানে ‘ভাল খেলব’, ‘জিততে হবে’, ‘ওরাও ভাল, আমরাও’ এ সবের বাইরে খুব বেশি বেরোবে না। প্রাক্-যুদ্ধের সঠিক ছবি এখন বেশি পাওয়া যায় প্লেয়ারের শরীরী ভাষায়। বা পারিপার্শ্বিকে। এবং শুক্রবার থেকে সিরিজের ভাগ্য নির্ধারণের আসল ছবি উপস্থিত মিডিয়াকে দিল সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাবের পিচ। এক নয়, দুই নয়, তিন খেপে।

প্রথমটা, সকাল সওয়া দশটায়। লঙ্কা অধিনায়ক ম্যাথেউজ, কোচ মারভান আতাপাত্তু যখন পিচের পাশেই কিউরেটর মাইকেল ডি’জয়সার সঙ্গে বসে পড়লেন। আঙুল তুলে নানাবিধ নির্দেশ দেওয়া হল। কিউরেটর সক্রিয় হয়ে উঠলেন নতুন উদ্যমে।

দ্বিতীয়টা, দুপুর দেড়টা নাগাদ। যখন ভারতীয় টিম ডিরেক্টর রবি শাস্ত্রী বোলিং কোচ ভরত অরুণকে নিয়ে চললেন আবার পিচ দেখতে। এবং ফিরে এসে থমথমে মুখে বলে গেলেন, “এখনও তো পিচকে ফিনিশড প্রোডাক্ট মনে হচ্ছে না। ঘাস আছে। মনে হয়, ঘাস আরও কাটবে ওরা। ঠিক আছে, প্র্যাকটিস সেরে আবার দেখব। তার পর কম্বিনেশন ঠিক করব।”

তৃতীয় তথা শেষ, বিকেল সাড়ে তিনটেয়। কিউরেটরকে ধরা হলে তিনি সব শুনেটুনে যখন বললেন, “কী ভাবছে ওরা? বিকেলে দেখবে আর পিচ বুঝে নেবে? ইন্ডিয়ান টিমকে গিয়ে বলুন, কাল সকালে কম্বিনেশন ঠিক করতে। ওরা আজ দেখার পরেও কিন্তু আমি আবার সব পাল্টে দিতে পারি!”

পরিষ্কার যুদ্ধ ঘোষণা।

পিচ সবুজ চাদরে ঢেকে ভারতকে নামিয়ে দেওয়ার মানে কী, নির্বোধেও বুঝবে। ওটা রবিচন্দ্রনের অফস্পিনের রবি ও চন্দ্র দু’টোরই পূর্ণগ্রাস গ্রহণের বন্দোবস্ত করা! টার্ন নিয়ে খোঁচাখুঁচিতে ডি’জয়সাকে চিবিয়ে-চিবিয়ে বলতে শোনা গেল, “অশ্বিন তো ভাল স্পিনার। তা হলে তো যে কোনও উইকেটেই ওর পারা উচিত।” বক্তব্যের অর্থ সত্যি হলে নির্যাস পরিষ্কার। গত দু’টেস্টে সতেরো উইকেট নেওয়া অশ্বিন সিরিজে শেষ বারের মতো লঙ্কা ছারখারে নামবেন। অতএব, সারফেসে তাঁকে ভোঁতা করে দাও। এমন বানাও যে, চতুর্থ দিনের আগে যাতে বল-টল না ঘোরে। বরং বাউন্স থাক, ক্যারি থাক। স্ট্রোকপ্লেয়ারদের শট খেলতে সুবিধে হোক। বল ঘোরাটা শুধু বন্ধ হোক। তাতে হার আটকে সিরিজ ড্রয়ের দিকে যায় তো যাক।

ভারতীয় শিবিরের কথাবার্তা শুনলে মনে হবে, আচমকা উদ্ভূত সমস্যায় তাঁরাও যেন একটু ঘেঁটে। নমন ওঝা টিমের একমাত্র সরকারি উইকেটকিপার। কিন্তু তাঁর টেস্ট অভিষেকের আগেও একটা ‘সম্ভবত’ জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। তিনি না ‘ব্যাটসম্যান হু ক্যান কিপ’ কে এল রাহুলের দিকে যাওয়া হবে, নিশ্চিত উত্তর পাওয়া গেল না। কারণ, পিচ অনুযায়ী কম্বিনেশনের পাজ্ল। সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাবের পিচের ইতিহাস যদিও বলে, এ মাঠে দশটা টেস্ট হলে তার সাতটা ড্র হয়। যতই বলার চেষ্টা হোক যে পিচ-চরিত্র পাল্টেছে, এখন রেজাল্ট হয় কিন্তু পঞ্চাশ বা ষাটের দশকের এখানে ‘হুইসল স্টপ ম্যাচের’ (যখন অ্যাসেজ খেলতে যাওয়ার আগে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া টুক করে এক-আধটা ম্যাচ খেলে যেত), আমল থেকেই নাকি এটা এ উইকেটের রীতি। এই তো শেষ পাঁচটা টেস্টের মধ্যে চারটে ড্র হয়েছে! ভারতের গত শ্রীলঙ্কা সফরকেই ধরা যাক। শ্রীলঙ্কার সাড়ে ছ’শোর জবাবে ভারত তুলেছিল সাতশো এবং ম্যাচ ড্র। শাস্ত্রীকে দেখা গেল কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছেন যাতে এ মাঠে কমেন্ট্রির দিনগুলো যাতে ফিরে না আসে। বলেও ফেললেন, “প্লিজ আর মনে করাবেন না। পাঁচ দিনেও একটা ইনিংস শেষ হত না। উফ!”

শ্রীলঙ্কা করবেও বা কী? মাহেলা নেই। সঙ্গা নেই। দিলশান নেই। একের পর এক মহীরুহের পতনে টিমে পিতৃসম কোনও ছায়া নেই, নেই এক-আধজনের বেশি নির্ভরতার নাম। যা খবর, সঙ্গকারার জায়গায় উপুল থরঙ্গাকে খেলানো হতে পারে। কিন্তু তার পরেও লঙ্কা শিবির বুঝে উঠতে পারছে না, সঙ্কট কাটবে কি না। তার মধ্যে সংসারে নতুন অনটন। অফস্পিনার থারিন্ডু কৌশলের ডান হাতের বুড়ো আঙুলে চোট। পারবেন কি না, কে জানে।

এবং সব দেখে দেড়শো বছরের প্রাচীন শ্রীলঙ্কান ক্লাবের অফিস ঘরটাকে বড় ট্র্যাজিক মনে হয়। যার দরজা খুলে ঢুকলে প্রথমেই চোখে পড়বে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড় করানো পি সারা ওভালের সেই বিশাল মেসেজ বোর্ডটা। যেখানে হাজার-হাজার মেসেজ। মাঝে পরিচিত মহাযোদ্ধার বিদায়ী মুখ।

কুমার সঙ্গাকারার মুখ।

পার্সি অভয়শেখরা ভারতীয় টিম ডিরেক্টরের জন্য পাল্টা ছড়া বার করবেন কি না, জানা নেই। কিন্তু সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাবের অফিস ঘরে ঢুকলে একটা দুঃখের ছড়া অন্তত ওই মেসেজ বোর্ডে আজ লিখে আসতেই পারতেন।

গেলে ঠিকই, কিন্তু কেন গেলে।

ছবি: দেবাশিস সেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE