যুগলবন্দি: দুই যাদবে শেষ অস্ট্রেলিয়া। উমেশের কোলে কুলদীপ। পিটিআই
শনিবার সকাল ন’টা পর্যন্ত বেশ উৎকণ্ঠা নিয়েই অপেক্ষা করছিলাম। ভারতীয় দলের হয়ে টসটা কে করতে যায়, তা দেখার জন্য।
দেখলাম অজিঙ্ক রাহানেই গেল স্টিভ স্মিথের সঙ্গে। সেটা দেখে প্রতিক্রিয়াটা ছিল হতাশার। কিন্তু আমি বিস্মিত হলাম, ভারতের প্রথম একাদশটা শুনে। কোহালির পরিবর্তে দলে কিনা কুলদীপ যাদব! এক জন ব্যাটসম্যানের পরিবর্তে দলে আসছে কিনা এক জন বোলার! তা-ও আবার এমন মরণ-বাঁচন ম্যাচে!
তখনকার মতো আশঙ্কাই হচ্ছিল যে, এমন এক জনকে কোহালির পরিবর্তে নামিয়ে দেওয়া হল, যে আগে কখনও টেস্টই খেলেনি। ধর্মশালাতেই অভিষেক ঘটবে। যাকে বিশ্ব ক্রিকেট এখনও তেমন ভাবে চিনেই উঠতে পারেনি।
তখন কে আর ভেবেছিল যে, ম্যাচ শুরুর সময়কার সেই বিস্ময়ের মোড়ক ত্যাগ করে দিনের শেষে ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্টকে কৃতিত্ব আর ধন্যবাদ দিতে হবে এমন সাহসিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। নিজে নির্বাচক ছিলাম বলে জানি দলের চরম সংকটের মুহূর্তে এ রকম একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। সামান্য বেচাল হল মানে সবাই তখন দুষবে নির্বাচক আর টিম ম্যানেজমেন্টকে।
কুলদীপ ওর প্রতি টিমের আস্থার মর্যাদা রেখেছে। সসম্মানে শুধু উত্তীর্ণই হয়নি, অভিষেক ম্যাচের প্রথম আত্মপ্রকাশে, ভারতকে প্রবল ভাবে ম্যাচেও ফিরিয়ে এনেছে। না হলে ডেভিড ওয়ার্নার আর স্টিভ স্মিথ দুর্দান্ত শুরু পাইয়ে দিয়েছিল। একটা সময় ১৩০-১ ছিল অস্ট্রেলিয়া। তখন মনে হয়েছিল, কোহালিহীন ভারতকে দুরমুশ করার মঞ্চ তৈরি করে ফেলছে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিংয়ের দুই সেরা মুখ।
শুভারম্ভ: অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংসেই চার উইকেট। কুলদীপ যাদবকে ঘিরে উচ্ছ্বসিত অশ্বিনরা। ধর্মশালায়। পিটিআই
স্মিথ যদিও সেঞ্চুরি করে গেল। সিরিজে এটা তৃতীয় সেঞ্চুরি। ভারতের মাটিতে সবচেয়ে সফল বিদেশিদের মধ্যে ঢুকে পড়ল ও। এ রকম চলতে থাকলে কিন্তু নিজের দেশের রিকি পন্টিং এবং আমাদের বিরাট কোহালির জন্য উদ্বেগ ছড়াতে থাকবে স্মিথ। আর এই সফরে অস্ট্রেলিয়া হয়ে গিয়েছে পুরো ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’।
কুলদীপ চায়নাম্যান বোলার। চায়নাম্যান মানে বাঁ হাতে লেগস্পিন করায়। স্যার গ্যারি সোবার্স এই ক্লাবের সবচেয়ে বিখ্যাত সদস্য। আমার একটা ম্যাচের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। প্রয়াত জগমোহন ডালমিয়ার উদ্যোগে ইডেনে একটি প্রদর্শনী ম্যাচ হয়েছিল। সেখানে সোবার্স খেলতে এসেছিলেন। তখন উনি খেলা ছেড়ে দিয়েছেন অনেক দিন হয়ে গিয়েছে। আমি সেই ম্যাচে উইকেটকিপিং করছিলাম স্যার গ্যারির দলের হয়েই। সুনীল গাওস্করকে একটা ওভারে হঠাৎ করেই একটা চায়নাম্যান ডেলিভারি করে দিলেন। সানি ডিফেন্সিভ খেলে আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল, ‘‘ওল্ড ইজ গোল্ড।’’ জীবনে ওই মন্তব্যটা আমি কিন্তু ভুলব না।
আরও পড়ুন: স্মিথ এখন নতুন ‘ডন’
মাঝে দু’এক জন চায়নাম্যান বোলারকে আমরা দেখেছি। যেমন দক্ষিণ আফ্রিকার পল অ্যাডামস। কানের পাশ দিয়ে হাত ঘুরিয়ে প্রায় চোখ বন্ধ করে বল ছাড়ত। অ্যাডামসের বোলিংয়ের মধ্যে কোনও শিল্প খুঁজে পায়নি ক্রিকেট রোম্যান্টিকরা। কুলদীপ যাদবের মধ্যে পাবে। তার কারণ, কুলদীপ ক্লাসিকাল স্পিনারের মতোই বল করল ধর্মশালায়। দু’টো কারণে ওর নেওয়া চার উইকেটকে আদতে ছয় উইকেটের সমান বলব। ধর্মশালায় টার্নিং উইকেট হয়নি। সেখানে প্রথম দিনেই এমন মোড় ঘোরানো বোলিং বিশেষ কৃতিত্বের। একটাও অস্ট্রেলীয় ব্যাটসম্যানকে কাট মারতে দেয়নি। ওয়ার্নারকে আউট করেছে কাট মারতে বাধ্য করিয়ে। কিন্তু সেটাও বু্দ্ধি করে ওপরে দিয়েছে বলটা। দ্বিতীয়ত, এটা ওর অভিষেক টেস্ট এবং কোহালির মতো মহাতারকার জায়গায় খেলছে।
চাপটা দারুণ ভাবে নিয়েছে কুলদীপ, এটা বললে প্রায় কিছুই বলা হয় না। বলা উচিত, চাপকে ধারেকাছেই ঘেঁষতে দেয়নি। জীবনের প্রথম টেস্টেই না হলে কেউ ক্যাপ্টেনের কাছে গিয়ে বলতে থাকে, আমাকে এই ফিল্ডিং দাও, সেই ফিল্ডিং দাও। অভিষেক টেস্টেই কী দুর্দান্ত আত্মবিশ্বাস! অধিনায়ক রাহানেকে পর্যন্ত আশ্বস্ত করতে দেখলাম। তবে আমি সবচেয়ে মুগ্ধ ওর নিয়ন্ত্রণ দেখে। চায়নাম্যান আসলে খুবই কঠিন শিল্প। ভাবুন না, ডান হাতে যে লেগস্পিন করানো হয়, সেটাই করাতে হবে বাঁ হাতে। যে হেতু হাতের বাইরের দিক থেকে বল ছাড়তে হয়, এটা খুব কঠিন পদ্ধতি।
দিনের পর দিন ধরে নেটে অনুশীলন করে তবেই চায়নাম্যান বোলিংয়ে এমন নিয়ন্ত্রণ আনা যায়। আমি নিশ্চিত, নেটে প্রচুর বল করে তৈরি হয়েছে কুলদীপ। ছোটবেলায় ওর স্বপ্ন ছিল পেস বোলার হওয়ার। কিন্তু কোচ কপিল পাণ্ডে ওকে চায়নাম্যান বোলার বানিয়ে দিয়েছিলেন। কপিল বলতে ভারতীয় ক্রিকেট জানে এক জনকেই। কপিল দেব। শনিবারের পর ভারতের হয়ে টেস্টে খেলা প্রথম চায়নাম্যান বোলারের হাত ধরে হয়তো বিখ্যাত হয়ে গেলেন আরও এক কপিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy