Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

মেসিকে হারিয়ে দিয়েও নিজে জিততে পারলেন না রোনাল্ডো

এক ফুটবল-মহাযজ্ঞ ঘিরে প্রতিটা দেশের আবেগের রং আলাদা হয়। এক-একটা দেশের এক-এক রকম ফুটবল-গান, উল্লাস প্রকাশের এক-এক রকম ভঙ্গি। ইংরেজরা হেঁড়ে গলায় গান ধরতে ভালবাসে।

টাইব্রেকের সময় সেই রোনাল্ডোই আর পাঁচ জনের মতো টেনশন-আক্রান্ত।

টাইব্রেকের সময় সেই রোনাল্ডোই আর পাঁচ জনের মতো টেনশন-আক্রান্ত।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
মার্সেই শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০১৬ ০৪:০২
Share: Save:

এক ফুটবল-মহাযজ্ঞ ঘিরে প্রতিটা দেশের আবেগের রং আলাদা হয়। এক-একটা দেশের এক-এক রকম ফুটবল-গান, উল্লাস প্রকাশের এক-এক রকম ভঙ্গি। ইংরেজরা হেঁড়ে গলায় গান ধরতে ভালবাসে। ফরাসিরা টানা নব্বই মিনিট দু’টো হাত আশ্চর্য ছন্দে আকাশে ছুড়ে ছুড়ে ‘আলে, লে ব্ল্যুজ...আলে, লে ব্ল্যুজ’ চেঁচিয়ে যায়। বরফদেশের বাসিন্দারা করতালির মাতাল সুরের শেষটা করে বিকট ‘বুম’ গর্জনে। পর্তুগাল সমর্থকরা আবার প্রথমে সবুজ-লাল পতাকায় আগে নিজেদের ঢেকে নেন। কেউ কেউ পনিটেলে ছোট্ট আলাদা পতাকা গোঁজেন। টিম যতক্ষণ না জেতে বাবার পিঠে মুখ গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকে মেয়ে, প্রেমিককে জড়িয়ে থাকে প্রেমিকা। টেনশনের পাট চুকিয়ে টিম জিতে গেলে এঁরাও একটা গান ধরেন। নেশা তারও কম নয়, মোহ তারও কম নয়। কী রকম সাইরেনের মতো শোনায়, ‘পো-পো-পো-পোওও...’ ঝিম ধরানো এক আওয়াজ।

মার্সেইয়ের প্রাডো মেট্রো স্টেশনে রাত সাড়ে বারোটায় পর্তুগিজ-আবেগের আরও একটা মায়াবী রূপ দেখা গেল। মধ্যেখানে ট্র্যাক, দু’পারে দুই প্ল্যাটফর্ম, আর তাতে এত রাতেও গিজগিজ করছে পর্তুগিজ জনতা। দেখা গেল, একটা দল এ পার থেকে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর নামে তীব্র জয়ধ্বনি দিচ্ছে। ও পার তার উত্তর দিচ্ছে শরীর ঝুঁকিয়ে, অভিবাদনে, ঠোঁট নিঃসৃত ‘লা-লা-লা-লা’ ফুর্তির আওয়াজে।

দেখতে ভাল লাগে। কিন্তু স্তাদ ভেলোড্রামের সিআর সেভেন এত রোম্যান্সের ছিলেন তো?

কর্ণগহ্বরে এদের কিছু ঢোকে না, বাস্তব বোঝানো বড় জ্বালা। মহানায়কের নামে নিন্দে শুনলে এদের মুখচোখ কেমন শক্ত হয়ে যায়। প্রাডো বিচ ফ্যান জোন থেকে বেরোনোর সময় সবুজ-লালে রাঙানো এক সমর্থক চোখে পড়ে, জিজ্ঞেস করা হয়, টিম জিতল ঠিকই। কিন্তু রোনাল্ডো খুশি করতে পারলেন কি? কুতকুতে চোখে পর্তুগাল সমর্থক উল্টে বেখাপ্পা প্রশ্ন করেন, “তুমি কি মেসির ফ্যান? রোনাল্ডো নিয়ে আজেবাজে কথা বলতে এসেছ?” লিসবন-জাত নয়, পুরোদস্তুর ফরাসি এই যুবক বাকিটা শোনার জন্য দাঁড়ান না, বিরক্তিতে হাঁটা দেন বিয়ার বারের দিকে। রোনাল্ডোর তিন-তিনটে সহজতম গোল মিস ইনি শুনবেন না। ম্যাচের মধ্যে যিনি রোনাল্ডোকে ছুঁয়ে দেখার অপার আকুতি নিয়ে ঢুকে পড়েছিলেন, তাঁরও তো নিয়মের কাঁটাতার চোখে পড়েনি। কানে ঢোকেনি নিরাপত্তার শাসানি।

আবেগ মনে ধরে। কিন্তু স্তাদ ভেলোড্রামের সিআর সেভেন এত ভালবাসার যোগ্য ছিলেন তো?

পর্তুগাল কোচ ফার্নান্দো স্যান্টোস বেশ খুশি। টিম ইউরো সেমিফাইনালে, ফার্নান্দো বড় ব্যস্ত এখন। টিমের ‘কিড’-দের একটু দেখেশুনে রাখতে হবে। “উপায় কী? আমার বাচ্চাদের কাছে এটা স্বপ্ন। এখনই তো সামলে রাখতে হবে,” বলে ফেলেছেন স্যান্টোস। পর্তুগিজ কোচের আঠারো বছরের ‘কিড’ রেনাতো স্যাঞ্চেজও ‘কেমন দিলাম’ মেজাজ নিয়ে ঘুরছেন। গত রাতের সেরা ফুটবলার সাংবাদিক সম্মেলন করতে এসে শুনিয়ে গেলেন যে, যারা এত দিন তাদের টিমে, ক্রিশ্চিয়ানোর ‘শ্রাদ্ধশান্তি’ নিয়ে প্রবল উত্সাহী ছিল, জয়টা তাদের জন্য থাকল। যারা বলতে চায়, তারা বলতে থাকুক। কিন্তু সঙ্গে এটাও যেন মাথায় রাখে, টিম পর্তুগালের ও সবে কিছু এসে যায় না!

শুনতে ভাল লাগে। কিন্তু স্তাদ ভেলোড্রামের সিআর সেভেন এত প্রশংসার যোগ্য ছিলেন তো?

ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো বড় টুর্নামেন্টের মধ্যে খবরের কাগজ-টিভি চ্যানেল দেখেন কি না, জানা নেই। দেখলে ব্যাপারটা নিশ্চিত তাঁর চোখে পড়ত। ইউরোপের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম কিন্তু বলছে যে, নানি-রেনাতোর পূর্ণগ্রাসে বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা পড়ে গিয়েছিলেন রোনাল্ডো। তিনটে সুযোগ পর্তুগিজ মহাতারা পেয়েছিলেন ম্যাচে। একটা তিনি নষ্ট করলেন নিজেকে দূরূহ কোণে ঠেলে নিয়ে গিয়ে। একবার ডান পায়ে শট নিলেই গোল হয়ে যেত। তার বারোটা বাজালেন বাঁ পায়ে বলটা রিসিভ করতে গিয়ে। আর শেষটা— অভাবনীয়। পেনাল্টি বক্সের মধ্যে গোলকিপারকে একা পেলেন, নিখুঁত ক্রস তাঁর পায়ের সামনে এসে পড়ল, ছোঁয়ালেই গোল। কিন্তু রোনাল্ডোর পা ঘুরে গেল হাওয়ায়, বল টাচ পর্যন্ত করতে পারলেন না! আন্তর্জাতিক ফুটবল অনেক বড় ব্যাপার, পাড়ার টুর্নামেন্টেও ওই গোল মিস করলে বোধহয় এক সপ্তাহের নির্বাসন কপালে জুটবে!

সহজবোধ্য বাংলায় ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো শতবার্ষিকী ফাইনালের লিওনেল মেসিকে নিছক স্কোরবোর্ডে হারাতে পারলেন। তাঁর চিরকালীন আর্জেন্তিনীয় প্রতিদ্বন্দ্বী কোপা ফাইনালে পেনাল্টি মিস করেছিলেন, আর্জেন্তিনাও জিততে পারেনি। মেসি দেশের জার্সি থেকে তার পর সরেও গিয়েছেন। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো পেনাল্টি নষ্ট করেননি। গ্রুপ পর্বের অস্ট্রিয়া-আতঙ্কের রাতকে আবার ফেরত আনেননি। তাঁর টিম জিতেছে, দেশের জার্সিও অক্ষত। কিন্তু ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো অন্তত নিজেকে জিতিয়ে বেরোতে পারেননি। খেললেন কোথায়? একশো কুড়ি মিনিটের মধ্যে এক মিনিটও তাঁকে ভয়াবহ লাগল কোথায়?

পর্তুগাল সেমিফাইনাল- স্টেশনে পৌঁছে যাওয়ার পর রোনাল্ডো বলে ফেলেছেন যে, স্বপ্নের খুব কছাকাছি চলে এসেছেন তিনি। বহু দিন ধরে আকাঙ্খা ছিল, দেশকে একটা ট্রফি দেওয়ার। দেশের জার্সিতে কিছু পাওয়ার। কিন্তু কোথায়, রোনাল্ডোর আকাঙ্খা, রোনাল্ডোর স্বপ্ন নিয়ে কোথাও তো চর্চা হচ্ছে না। বরং তীক্ষ্ণ শ্লেষ জুড়ে দেওয়া হচ্ছে তাঁর ইউরো পারফরম্যান্সের সঙ্গে। একমাত্র হাঙ্গেরি ম্যাচ ছাড়া কোনও ম্যাচে গোল নেই রোনাল্ডোর। ফ্রান্সের বিদ্যুত্গতির টিজিভি-র পাশে যেমন আমাদের শিয়ালদহ লাইনের ট্রেনকে ছ্যাকড়া গাড়ি দেখায়, অতীতের রোনাল্ডোর পাশেও বর্তমান সিআর-কে তেমনই লাগছে। সেই ড্রিবল, সেই দৌড়, সেই পুরনো নাকল বল ফ্রিকিক, যেন কোনও কালান্তক ব্ল্যাক ম্যাজিকে সব উধাও, নিশ্চিহ্ন। ইতালির এক কাগজ যা লিখেছে, তা পড়লে বোধহয় পর্তুগাল সমর্থকদের ভূমধ্যসাগর উপভোগ করতে-করতে দেশের জয় দেখার আমেজ আরও নষ্ট হবে। কাগজটা লিখেছে পর্তুগালের আয়না রোনাল্ডো। পর্তুগাল কেন নকআউট পর্বের প্রতিটা যুদ্ধ অতিরিক্ত সময়ে নিয়ে যাচ্ছে, রোনাল্ডোকে দেখলে বোঝা যায়। লিখেছে যে, সিআরের এখন আত্মবিশ্বাসের অভাবও ঘটছে। আগে পেনাল্টি শ্যুটআউটে সব সময় শেষ শটটা নিতে যেতেন তিনি। আর, বৃহস্পতিবার নিতে গেলেন প্রথমটা। শেষের টেনশন নিজের জন্য ফেলে রাখতে চাননি।

শুনতে খারাপ লাগবে। কিন্তু স্তাদ ভেলোড্রামের সিআর সেভেন বোধহয় এত সমালোচনারই যোগ্য ছিলেন!

ছবি: টুইটার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Ronaldo Messi euro cup
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE