Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

ছ’আঙুলের জুতো মেলে না, থমকে যাবে কি স্বপ্নার দৌড়

ক্লাস টু-এর ছোট্ট মেয়েটাকে স্কুলের দিদিমণি প্রশ্ন করেছিলেন, “বলতো, হাত এবং পা মিলিয়ে তোমার ক’টা আঙুল?” ছটফটে মেয়েটির উত্তর ছিল, ২২টি! জলপাইগুড়ির পাতাকাটা বিএফপি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দিদিমণি তো রেগেই আগুন! “কাল যা শেখালাম সব ভুলে গিয়েছ?” মেয়েটির গালে একটা চড়ও কষিয়ে দিলেন তিনি। মেয়েটি তবু অনড়!

সল্টলেকের সাই-এ স্বপ্না বর্মনের ছবিটি তুলেছেন উৎপল সরকার।

সল্টলেকের সাই-এ স্বপ্না বর্মনের ছবিটি তুলেছেন উৎপল সরকার।

রতন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০১৪ ০৩:১৪
Share: Save:

ক্লাস টু-এর ছোট্ট মেয়েটাকে স্কুলের দিদিমণি প্রশ্ন করেছিলেন, “বলতো, হাত এবং পা মিলিয়ে তোমার ক’টা আঙুল?”

ছটফটে মেয়েটির উত্তর ছিল, ২২টি!

জলপাইগুড়ির পাতাকাটা বিএফপি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দিদিমণি তো রেগেই আগুন! “কাল যা শেখালাম সব ভুলে গিয়েছ?” মেয়েটির গালে একটা চড়ও কষিয়ে দিলেন তিনি।

মেয়েটি তবু অনড়!

বৃহস্পতিবার পড়ন্ত বিকেলে সল্টলেকে সাইয়ের মাঠে বসে সে দিনের ঘটনা বলতে গিয়ে অবশ্য মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে স্বপ্না বর্মনের। হেপ্টাথলনে অসাধারণ পারফরম্যান্স করে দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচিওন এশিয়াডে ভারতীয় দলে সদ্য সুযোগ পেয়েছে স্বপ্না। সদ্য আঠারো ছোঁয়া বাংলার সোনার মেয়েটি হাসতে হাসতে বলে, “আমার দু’পা মিলিয়ে যদি বারোটা আঙুল থাকে, তা হলে কী ভাবে মিথ্যে কথা বলব?”

বারো আঙুল! দু’পায়েই ছ’টা করে! এক ঝলক দেখলে কিন্তু সেটা চোখেই পড়ে না। বিশ্ব অ্যাথলেটিক্সের ইতিহাসে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ রকম ঘটনা সম্ভবত নজিরবিহীন। ক্রীড়া বিজ্ঞানী আশিস গোস্বামী বলছিলেন, “এটা তো দৌড়নোর পক্ষে অন্তরায়! বেশি অনুশীলন করলে পায়ে ব্যথা হয়। স্পোর্টস শ্যু পা চেপে ধরতে পারে। দু’পায়ে বারো আঙুল নিয়ে যদি কোনও অ্যাথলিট সাফল্য পায়, তা হলে সেটা কিন্তু অত্যাশ্চর্য ঘটনা বলে ধরতে হবে। আমি অন্তত এ রকম কখনও শুনিনি।”

কিন্তু এই পা নিয়েই দেশ-বিদেশ থেকে একের পর এক পদক আনছে হেপ্টাথলনের এই বিস্ময় কিশোরী। তাঁর ব্যক্তিগত কোচ সুভাষ সরকার বলছেন, “এ বারেও ও যা স্কোর করেছে, তাতে এশিয়াডে পদক পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।” সদ্য মঙ্গলবারই অলিম্পিয়ান সুস্মিতা সিংহ রায়ের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলে মাত্র দু’পয়েন্ট পিছনে থেকে রুপো জিতেছে স্বপ্না। এবং পেয়েছে এশিয়াডে যোগদানের দুর্লভ টিকিটও।

ভারতের জার্সি গায়ে সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ কোরিয়ায় যাবেন স্বপ্না। কিন্তু তার আগে গোল বাধিয়েছে তাঁর দু’পায়ের ছ’টা আঙুল-ই! আর সেটাই ভাবাচ্ছে স্বপ্নার কোচকেও। এশিয়াডে যোগ দিতে যাবেন কী, স্বপ্নার পায়ের বুট-ই যে পাওয়া যাচ্ছে না! অ্যাডিডাস কোম্পানির যে রানিং শ্যু পরে পাটিয়ালায় সদ্য ফেড কাপে পদক জিতেছেন তিনি, সেটা কিনেছিলেন আঠারোশো টাকায়। কিন্তু একটা টুর্নামেন্টের পরেই ছিঁড়ে গিয়েছে ছ’নম্বর কড়ে আঙুলের পাশের জায়গাটা। প্রতিবারই তো এমনটা হচ্ছে! এ পর্যন্ত তাঁর প্রায় দু’শোটা জুতো বাতিল হয়েছে!

স্বপ্না যে বিভাগে পদকের স্বপ্ন দেখছেন, সেই হেপ্টাথলনে মোট সাতটি ইভেন্ট। তার মধ্যে তিনটি দৌড়ের — ২০০ ও ৮০০ মিটার এবং ১০০ মিটার হার্ডলস। তা ছাড়া আছে দু’টি জাম্পিং ইভেন্ট— হাই জাম্প ও লং জাম্প এবং দু’টি থ্রো ইভেন্ট— শট পাট ও জ্যাভলিন থ্রো। সাধারণত হেপ্টাথলনের সাতটি ইভেন্টের জন্য দরকার হয় সাতটা জুতো। বড় কোনও প্রতিযোগিতায় নামী ব্র্যান্ডের জুতো কিনতে গেলে এমনিতেই চাপে পড়ে যান অ্যাথলিটরা। কারণ ওই ধরনের এক জোড়া জুতোর দাম পড়ে গড়ে অন্তত আট হাজার টাকা। সেই হিসেবে একটা টুর্নামেন্টের জন্যই দরকার প্রায় ছাপান্ন হাজার টাকা! বছরে সাত-আটটা টুর্নামেন্টে যোগ দেন স্বপ্না। মুখচোরা মেয়েটির কথায়, “বছরে অন্তত এক লাখ টাকা দরকার হয় বুট কেনার জন্য! তার উপর অন্য খরচ তো আছেই।” পাশে দাঁড়িয়ে সুভাষবাবু বললেন, “স্থানীয় এক সর্দারজিকে দিয়ে কম দামের অর্ডারি বুট বানিয়ে দিয়েছিলাম স্বপ্নার জন্য। কিন্তু এত খারাপ! গ্রিপ ঠিক নেই। দৌড়তে সমস্যা হচ্ছে। তাড়াতাড়ি ছিঁড়েও যাচ্ছে। ওটা পড়ে এশিয়াডের অনুশীলন হয় না!” বড় অসহায় লাগে তাঁকে।

স্বপ্নার জন্য বিশেষ জুতোর খোঁজে নানা জায়াগায় ঘুরপাক খাচ্ছেন প্রাক্তন অ্যাথলিট সুখেন মণ্ডল। বাংলা দল নির্বাচনের আহ্বায়ক বলছিলেন, “মেয়েটা এত প্রতিভাবান। দেশের সেরা অ্যাথলিট হওয়ার ক্ষমতা আছে ওর। কিন্তু অ্যাডিডাস, নাইকি বা অন্য কেউ ওর বুট করে দিতে পারছে না!”

কিন্তু স্বপ্নার সাফল্যে সে সবের আঁচ পড়েনি আজও। মালয়েশিয়ায় এক বছর আগে স্কুল এশিয়ান গেমসে দু’টো সোনা, একটি রুপো একটি ব্রোঞ্জ। এ বছর জুনে চাইনিজ তাইপেতে জুনিয়র এশিয়ান ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে রুপো। জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন বয়সভিত্তিক বিভাগে সোনা-সহ দশটিরও বেশি পদক। তবে এশিয়াড যে কঠিন লড়াই, সেটা মানছেন কোচ। তাই চিন্তাটা অনেক বেশি।

জলপাইগুড়ির পাতাকাটা ঘোষপাড়ার মাটির ঘরে বেড়ে ওঠা স্বপ্না এখন থাকেন সল্টলেকের সাই সেন্টারে। বাবা এক সময় রিকশা ভ্যান চালাতেন, এখন পঙ্গু। সংসার টানতে দাদাকে ভ্যান চালাতে হয়। কখনও কখনও নৌকো করে কাঠও বয়ে আনেন তিনি। একেবারে হতদরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা স্বপ্নার খরচ চলে পুরস্কার থেকে পাওয়া সামান্য টাকায়, আর কোচ সুভাষ সরকারের আর্থিক সাহায্যে। ছাত্রীকে দেখিয়ে কোচ বলছিলেন, “মেয়েটা যদি আর একটু লম্বা হতো, তা হলে বলতাম অলিম্পিক মেটিরিয়াল। এশিয়াডে কিন্তু ও পদক পেতেই পারে। ওকে তিন-সাড়ে তিন ঘণ্টা অনুশীলন করাই। এক দিন অনুশীলন না করলেই মোটা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হল, যে পুষ্টিকর খাওয়া-দাওয়া দরকার, তা তো দিতে পারি না। খারাপ লাগে। তার উপর রানিং শ্যু-র সমস্যা। কী যে করব!” কোচের কথা শুনতে শুনতে স্বপ্নার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। “স্যার আমি পারব, ঠিক পারব। দেখবেন।”

বারোটা আঙুল নিয়ে দৌড়তে সমস্যা হয় না? “দৌড়নোর সময় সামনের আঙুলগুলো টাইট হয়ে যায়। একটা অন্যটাকে চেপে ধরে। স্যার বলেছেন, দৌড়ের ইভেন্টগুলোয় আরও ভাল করতে হবে। জাম্পিং ইভেন্টগুলো অবশ্য ভাল হচ্ছে।” অ্যাথলিটদের বারোটা আঙুল সুবিধা না অসুবিধা, তা নিয়ে সাই-এর একাধিক ডাক্তারের মতামতে আরও সমস্যা বেড়েছে স্বপ্নার কোচের। অনেক ডাক্তার নিজেরাই কিছুটা বিভ্রান্ত। “মোষ বা গরুর শিং নিয়ে যেমন সমস্যা নেই, স্বপ্নারও তাই,” বলে দায় এড়িয়েছেন তাঁরা।

এ সবে অবশ্য থমকাচ্ছেন না স্বপ্না। চিন্তিতও নন। বরং বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়েটির জেদ বেড়েছে। এশিয়াডের পদক তাঁর চাই-ই। দরকার শুধু একটা মনের মতো রানিং শ্যু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE