Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

প্রোদুনোভায় দীপাকে কেন কম, প্রশ্ন কোচের

দীপা কর্মকার কি বিচারকদের ভুল সিদ্ধান্তের শিকার? ঠিকঠাক পয়েন্ট দেওয়া হলে কি ত্রিপুরা-কন্যার ব্রোঞ্জ পাওয়া অবশ্যম্ভাবী ছিল? স্বাধীনতা দিবসের সকাল থেকেই এই নিয়ে তোলপাড় রিওর গেমস ভিলেজ। প্রশ্নটা তুলেছেন দীপার কোচ বিশ্বেশ্বর নন্দী স্বয়ং।

বিতর্ক যেখানে। প্রোদুনোভা ভল্ট দিয়ে গড়িয়ে যান চুসোভিতিনা (ইনসেটে)। তাঁর থেকে সামান্যই বেশি পয়েন্ট পান দীপা। ছবি: রয়টার্স

বিতর্ক যেখানে। প্রোদুনোভা ভল্ট দিয়ে গড়িয়ে যান চুসোভিতিনা (ইনসেটে)। তাঁর থেকে সামান্যই বেশি পয়েন্ট পান দীপা। ছবি: রয়টার্স

রতন চক্রবর্তী
রিও দে জেনেইরো শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০১৬ ০৫:০২
Share: Save:

দীপা কর্মকার কি বিচারকদের ভুল সিদ্ধান্তের শিকার? ঠিকঠাক পয়েন্ট দেওয়া হলে কি ত্রিপুরা-কন্যার ব্রোঞ্জ পাওয়া অবশ্যম্ভাবী ছিল?

স্বাধীনতা দিবসের সকাল থেকেই এই নিয়ে তোলপাড় রিওর গেমস ভিলেজ। প্রশ্নটা তুলেছেন দীপার কোচ বিশ্বেশ্বর নন্দী স্বয়ং। তাঁর দাবি, যে ব্রহ্মাস্ত্রে দীপা বিশ্বের তাবড় জিমন্যাস্টিক্স-প্রেমীদের তাক লাগিয়ে দিয়েছেন, সেই প্রোদুনোভা ভল্টের পয়েন্ট দেওয়ার ক্ষেত্রেই বঞ্চিত করা হয়েছে তাঁকে। বিশ্বেশ্বরের কথায়, ‘‘অলিম্পিক্সে খুব কড়া জাজমেন্ট হয়। তা সত্ত্বেও আমার মনে হচ্ছে, (প্রোদুনোভা ভল্ট দিয়ে) উজবেকিস্তানের ওকসানা চুসোভিতিনা যে পয়েন্ট পেলেন, সেই তুলনায় দীপাকে কম পয়েন্ট দেওয়া হয়েছে। তবে এটা একেবারেই আমার ব্যক্তিগত মত।’’

কেন এমন মনে করছেন বিশ্বেশ্বর?

কারণ, শনিবার রাতে যে আট় জন আর্টিস্টিক জিমন্যাস্টিক্সের ভল্ট ইভেন্টে নেমেছিলেন, তাঁদের মধ্যে মাত্র দু’জন প্রোদুনোভা ভল্ট দেওয়ার সাহস দেখিয়েছিলেন। প্রথম জন, লিয়েন্ডার পেজের মতো নিজের সপ্তম অলিম্পিক্সে নামা ওকসানা। অন্য জন দীপা। বছর একচল্লিশের ওকসানা প্রোদুনোভা ভল্ট দেওয়ার পর ঠিকঠাক ল্যান্ডিং তো করতেই পারেননি, উল্টে গড়িয়ে চলে যান অনেকটা। তা সত্ত্বেও তিনি পান ১৪.৯ পয়েন্ট। একান্ত আলাপচারিতায় বিশ্বেশ্বরের ইঙ্গিত, ওকসানার চেয়ে অনেক ভাল প্রোদুনোভা করেছিলেন দীপা। অথচ তাঁর ভাগ্যে জোটে সামান্যই বেশি— ১৫.২ পয়েন্ট। ওটাই হতে পারত ১৫.৫ বা ১৫.৬। চূড়ান্ত স্কোরকার্ডে ব্রোঞ্জজয়ী জিউলিয়া স্টেইনগ্রুবারের সঙ্গে দীপার ব্যবধান ছিল মাত্র ০.১৫ পয়েন্টের। যদি প্রোদুনোভার পয়েন্টটা আর একটু বেশি হতো? কান ঘেঁষে এ ভাবে অলিম্পিক্সের পদক চলে যাওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না দীপার কোচ।

মফস্সল শহরের ছাপোষা শিক্ষকের মতো চেহারা। পেশাদারিত্বের জগতে যা খানিক বেমানানই লাগে। বিশ্বেশ্বর বলতে থাকেন, ‘‘আরও কিছু পয়েন্ট পেলে হয়তো আমার মেয়েটা পদক পেয়ে যেত। আমার বলতে বাধা নেই, ও তো আর গড়িয়ে পড়ে যায়নি। তবে এখন আর কাউকে দোষারোপ করে লাভ নেই। আমি ও সব করার লোকও নই। ষোলো বছর ধরে একেবারে গড়েপিটে মেয়েটাকে তৈরি করেছি। এত দূরে এসে এ ভাবে সামান্য পয়েন্টের জন্য অলিম্পিক্সের মতো মঞ্চে পদক হারাব, ভাবতেই পারছি না। আমার জীবনের সবথেকে দুঃখের দিন বলতে পারেন।’’ গলা ধরে আসে বছর আটান্নর সাদাসিধে মানুষটার।

পাশে বসে মাথা নিচু করে সব শুনছিলেন দীপা। কিন্তু এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাইলেন না তিনি। বরং সান্ত্বনা দিলেন কোচকে, ‘‘স্যার, এ বার হয়নি তো কী হয়েছে? টোকিওতে দেখবেন, আপনার মুখে আমি হাসি ফোটাবই। পদক জিতবই।’’ দীপার জেদ যে কতটা, তার হাতে-গরম প্রমাণ মিলেছে ভল্ট ফাইনালের পরেও। স্বাধীনতা দিবসে ভারতীয় দূতাবাসের আমন্ত্রণ এড়িয়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন মেয়েদের ফ্লোর এক্সারসাইজ এবং আনইভেন বারের জিমন্যাস্টিক্স ফাইনাল দেখতে। দূতাবাসকে তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘‘ওখানে গিয়ে ছবি তোলার মতো আমি এমন কিছু করিনি। জিমন্যাস্টিক্সের ফাইনালগুলো দেখা আমার পক্ষে খুবই জরুরি।’’ সেই দুপুরেই এক ভদ্রলোককে তাঁর

সমর্থকের তালিকায় পেয়ে যান দীপা। প্রাক্তন সেই ক্রীড়াবিদ টুইট করেন, ‘‘সবাই পদক পায় না। দীপা, তুমি দেশকে আলোড়িত করেছ। আমাদের গর্বিত করেছ।’’ ভারতরত্ন সচিন তেন্ডুলকর!

ফাইনালের পরে দীপা বলেছিলেন, ‘‘আমার পক্ষে যতটা করা সম্ভব, করেছি।’’ কিন্তু শেষ পর্যন্ত মন বোঝেনি সে কথা। সেই রাতে চোখে ঘুম আসেনি স্যার আর ছাত্রীর। অসমবয়সী দুই বন্ধুর মতো, বাবা আর মেয়ের মতো একই যন্ত্রণায় কেঁদেছেন দু’জনে। আজ অবশ্য অনেকটা স্বাভাবিক লাগল তাঁদের। দীপা বললেন, ‘‘অনেক দিন পর আইসক্রিম খেয়েছি। ঘোড়ায় চড়েছি। কম্পিটিশন দেখার পর ভাল করে গেমস ভিলেজটাও ঘুরে দেখলাম।’’

পদক না এলেও ধন্য ধন্য করছে গোটা দেশ। ভল্ট ইভেন্টে সোনাজয়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিমোন বাইলসের এখনও ঘোর কাটেনি দীপার প্রোদুনোভা নিয়ে। চূড়ান্ত বিস্মিত বাইলস মন্তব্য করেছেন, ‘‘পাগলামো! চূড়ান্ত পাগলামো! আমি কখনও এটা করবই না।’’ কেউ কেউ তাই মনে করছেন, এখন আর দীপার কোনও বিতর্কে না-জড়ানোই ভাল। এর পরে হাঙ্গেরিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে যেতে হবে তাঁকে। তার পর রয়েছে কমনওয়েলথ, এশিয়াড। তাঁর কোচকে অবশ্য এই ‘ফিল গু়ড’ আবহাওয়ার মধ্যেও দু’টো প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। এক) এত ভল্ট থাকতে প্রোদুনোভার মতো কঠিন ভল্ট ছাত্রীর জন্য তিনি বাছলেন কেন? যেখানে অনেক নিরাপদ ভল্ট দিয়ে অন্যরা পদক নিয়ে গেলেন। দুই) দীপা কেন বিদেশে ট্রেনিং নিতে গেলেন না?

প্রশ্ন শুনে বিশ্বেশ্বর বলছেন, ‘‘প্রোদুনোভার বদলে অন্য কোনও ভল্ট প্র্যাকটিসের সুযোগ ছিল না। অন্তত এক বছর লাগে একটা ভল্টকে নিখুঁত করতে। যোগ্যতা অর্জনের পর তিন মাস সময় পেয়েছি। দীপা প্রোদুনোভা ভল্টটা ভাল করে, তাই এর উপরেই বাজি রেখেছিলাম। টোকিও অলিম্পিক্সের আগে অন্য ভল্টগুলো এ বার তৈরি করাব।’’ পরের প্রশ্নে দীপার কোচের যুক্তি, ‘‘সাই এখানে আমাকে যা সুযোগ-সুবিধে দিয়েছে, তাতে বিদেশে যাওয়ার কোনও দরকার ছিল না। ওরা তো বলছে আরও সুযোগ দেবে। তা হলে বিদেশে গিয়ে লাভ কী?’’

বিদেশি কোচের হাতেও ‘মেয়ে’কে ছাড়তে নারাজ বিশ্বেশ্বর। আগ্রহী নন দীপাও নিজেও। বলছেন, ‘‘স্যার আমাকে যেখানে নিয়ে এসেছেন, এত দিন কোনও জিমন্যাস্টকে কোনও বিদেশি কোচ আনতে পেরেছেন? আমি স্যারের কাছেই টোকিওর প্রস্তুতি নেব।’’ দীপার কাছে তাঁর স্যারের গুরুত্ব কতটা, এর পর আর বুঝিয়ে বলার দরকার পড়ে না।

তাই রিও থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে দীপার ‘মিশন টোকিও’। চার বছর নয়, একরোখা বাঙালি মেয়ের কাছে ওটা শুরু হচ্ছে ‘আগামিকাল’ থেকেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Dipa Karmakar Rio Olympics Produnova vault
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE