Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

ভাইফোঁটার অটুট বন্ধনে মিষ্টি ছোঁয়া

ভাইফোঁটা এসে গেল। ভাইদের পাতে এ বার কী কী পড়তে চলেছে? ঐতিহ্যবাহী কয়েকটি মিষ্টির দোকান ঘুরে দেখলেন রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। বাঙালির প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির ছোঁয়া মিলেমিশে রয়েছে তাদের যে সব সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের ভিতরে, তার মধ্যে ভাইফোঁটা সবার আগে।

শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০১৭ ১৭:৫২
Share: Save:

বাঙালি র প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির ছোঁয়া মিলেমিশে রয়েছে তাদের যে সব সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের ভিতরে, তার মধ্যে ভাইফোঁটা সবার আগে। ভাই-বোনের সুন্দর সম্পর্ককে এমন মিষ্টি একটি অনুষ্ঠানের রূপ দেওয়া বোধহয় বাঙালিদের পক্ষেই সম্ভব। ভাইয়ের সুস্থ ও নীরোগ দীর্ঘজীবন কামনা করছে বোন, আর ভাই সে জন্য তাকে আন্তরিক শ্রদ্ধা বা স্নেহ এবং ভালবাসা জানাচ্ছে— এমন একটি পরব কি উৎকৃষ্ট মিষ্টিমুখ ছাড়া হতে পারে?

আগে ভাইফোঁটা উপলক্ষ্যে চন্দ্রপুলি, ক্ষীরের ছাঁচ, পেস্তার বরফি বা ছানার পায়েসের মতো বিশেষ বিশেষ মিষ্টি এবং কুচো নিমকি বা কচুরির মতো নোনতা প্রতিটি বাঙালি বাড়িতেই তৈরি করা হত। পরের দিকে মিষ্টি তৈরি করতেন যাঁরা, তাঁরা বিভিন্ন বনেদি বাড়িতে এসে গিন্নিমাদের ইচ্ছে অনুযায়ী রসগোল্লা, পান্তুয়া, ক্ষীরমোহন, রসখাজা বা পদ্মনিমকি চোখের সমুখেই তৈরি করে দিয়ে যেতেন। সে যুগ যখন ক্রমশ অবসানের পথে তখন কলকাতার বিভিন্ন পুরনো জায়গায় নানা ধরনের বাঙালি মিষ্টির দোকান গড়ে উঠল। এই জায়গাগুলির মধ্যে বউবাজারের নাম সবার আগে করতে হয়।

বউবাজারের নির্মলচন্দ্র স্ট্রিটে ১৮৫ বছরের পুরনো দোকান নবকৃষ্ণ গুঁই। বর্তমানে সেখানকার কর্ণধার সুপ্রভাত দে হাসিমুখে জানালেন ভাইফোঁটায় তাঁদের বিশেষ মিষ্টির মধ্যে ‘ইমপ্রেসড গজা’র নাম সবার আগে। এই গজাটি সাধারণ সময়ে দোকানে বানানো গজার চেয়ে শুধু পাঁচ গুণ বড়ই নয়, এর পরতে পরতে ঢুকে থাকবে চিনির মায়াময় রস। তাই এতে কামড় দিলেই প্রতিটি মানুষ এর প্রতি ইমপ্রেসড হয়ে পড়বেন, এই জন্যই এর এমন নাম। এ ছাড়া রয়েছে সুপ্রভাতবাবুর বাবা ধীরেন্দ্রনাথ দে-র আবিষ্কার ‘নেহরু সন্দেশ’। এক বার মতিলাল নেহরুমশায় কলকাতার রাজভবনে আসায় ধীরেনবাবু মাথা খাটিয়ে একটা মিষ্টি বানিয়েছিলেন। পেস্তাকে খুব মিহি করে বেটে ছানার সঙ্গে মিশিয়ে, কোনও রকম সেন্ট না-মিশিয়ে, গোল করে পাকিয়ে ওপরে হালকা তবক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।

এ ছাড়া ‘ভিক্টোরিয়া সন্দেশ’, ‘প্যারাডাইস’, ‘শকুন্তলা সন্দেশ’, ‘ছানার মুড়কি’ ও ‘ক্ষীরের চন্দ্রপুলি’ও হটকেক। ক্রিকেটার সুনীল গাওস্করকে উপহার দেওয়া হয়েছিল যে ‘রাবড়ি দই’, মানে যাতে ওপরে রাবড়ির সর আর তার নীচে লাল দই, সেটিও জোগান দিতে এ দিন হিমসিম খান কর্মচারীরা।

এর পরেই আসি নবকৃষ্ণ গুঁই-এর লাগোয়া দোকান ভীমচন্দ্র নাগ-এর কথায়। এখানে আলাদা করে ভাইফোঁটার মিষ্টি বলে বিশেষ কিছু হয় না, শুধু সাবেক মিষ্টিগুলিকেই সাইজে কিছু বড় করে ক্রেতাদের সামনে পরিবেশন করা হয়। এখানকার ‘আবার খাব’ হল গোলাপজল দিয়ে মাখা ছানার একটি গোলাকার সন্দেশ। ছানার সঙ্গে জাফরানের গুঁড়ো মিশিয়ে বানানো হয় ‘বাদশাভোগ’। লালদইটির বিক্রিও বেশ ভাল, কিন্তু আড়াইশোর নীচে এর ভাঁড়ই পাওয়া যাবে না।

বউবাজার থেকে উত্তরে আর একটু এগিয়ে হেদোর কাছে বহু প্রাচীন্ন মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠান গিরিশচন্দ্র দে নকুড়চন্দ্র নন্দী। ভাইফোঁটার সকালে এখান থেকে হু হু করে বিক্রি হবে মধুস্বর। এই মিষ্টিটি ছানার সঙ্গে উৎকৃষ্ট মধু মিশিয়ে তৈরি। মধু ভরা থাকে সন্দেশটির মধ্যেও। ভাইয়ের প্রতি বোনের অন্তরের মাধুর্যই হয়তো প্রকাশিত হয় এই মিষ্টিটির পরিবেশনে। একবার খেলে এই লুকনো মধুর স্বাদ চিরকাল মুখে লেগে থাকবে— এমনই দাবি এই দোকানের কর্ণধার প্রশান্ত নন্দীর। তাঁর মতে, ভাইবোনের ভালবাসার মতোই খাঁটি, গরুর দুধ থেকে কাটানো ছানা দিয়ে মিষ্টি তৈরি করে আসছেন বলেই তাঁদের দোকানের মিষ্টিগুলির এখনও ভাইফোঁটার দিনে এত কদর। তবে আধুনিক প্রজন্মের কথা ভেবে তাঁরা ভাইফোঁটায় ‘চকোলেট শিঙাড়া’র মতো মিষ্টিও তৈরি করছেন, যে সন্দেশটির গড়ন শিঙাড়ার মতো, বাইরের মোড়ক চকোলেটের আর ভিতরে ঠাসা ড্রাইফ্রুট।

‘সত্যি কথা বলতে গেলে ভাঁইফোটার দিনে নতুন মিষ্টি তৈরির কথা আমরা যেমন ভেবে থাকি, অন্য মিষ্টি নির্মাতারা কি সে ভাবে কেউ ভাবেন?’ এ ভাবেই হাসতে হাসতে নিজেদের নতুন আবিষ্কার ‘আতার পায়েস’-এর কাচের বড় পাত্রটির দিকে সস্নেহে তাকালেন পদ্মপুকুর রোডের ‘বলরাম মল্লিক ও রাধারমণ মল্লিক’ মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম কর্ণধার প্রদীপ মল্লিক। আসল ডাবের শাঁস আর জল দিয়ে মাখা ছানার এক আশ্চর্য সন্দেশ এটি। আসল ফলের প্রতি তাঁদের এ আকর্ষণ বোধহয় অজানা নয়। তাই ভাইফোঁটায় তৈরি হচ্ছে ‘এলিক্স জির’ ও ‘ পাইনাপেল’ নামের দুটি সন্দেশ, যার প্রথমটিতে ছানার খোলের মধ্যে আসল খেজুরের কুচি ভরা আর দ্বিতীয়টিতে ভরা থাকছে আসল আনারস কুচির পুর। বাটা কাজুবাদাম আর ছানা মিশিয়ে তৈরি পারিজাত আর বড় মাপের ফুটফুটে খাজাও এ বারের ভাইফোঁটার সকালে সাড়া ফেলে দেবে বলেই স্থির বিশ্বাস প্রদীপবাবুর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE