Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

পড়ুয়াকে সময় দিচ্ছে না ইঁদুরদৌড়

অস্বাস্থ্যকর দৌড়ের প্রথম চাপ এসে পড়ে ছাত্রছাত্রীদের ব্যক্তিগত সময়ের উপরে, যেখানে তারা নিজের জন্য, খেলার জন্য, গল্পের বই পড়ার জন্য, মুক্ত ভাবনার জন্য, প্রকৃতির দিকে এক ঝলক নজর দেওয়ার জন্য সময় পায় না।

সুচিন্ত্য চট্টরাজ
শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৪:১১
Share: Save:

গত কুড়ি-পঁচিশ বছর ধরে শিক্ষাক্ষেত্রে এক অদ্ভুত ইঁদুরদৌড় শুরু হয়েছে। যার প্রভাব এখন সমগ্র সমাজে পরিলক্ষিত হচ্ছে। ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করার নামে তাদের উপরে এক অসম্ভব মানসিক চাপ তৈরি করছেন অভিভাবকদের একটা বড় অংশ। এই শিক্ষা কেবল নম্বরভিত্তিক, শুধু যেনতেন প্রকারে নম্বরের পিছনে দৌঁড়নো বিদ্যালয় স্তর থেকে, যার পরিসমাপ্তি চাকরি পাওয়ায়। এই অস্বাস্থ্যকর দৌড়ের প্রথম চাপ এসে পড়ে ছাত্রছাত্রীদের ব্যক্তিগত সময়ের উপরে, যেখানে তারা নিজের জন্য, খেলার জন্য, গল্পের বই পড়ার জন্য, মুক্ত ভাবনার জন্য, প্রকৃতির দিকে এক ঝলক নজর দেওয়ার জন্য সময় পায় না। এই শিক্ষা আমাদের ছাত্রছাত্রীদের কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে?

শিক্ষা এখন তথ্যভিত্তিক, তথ্যকেন্দ্রিক। চিন্তাশীলতা এখন গৌণ। আইনস্টাইন যখন স্কুলে পড়ছেন, তখন ইতিহাসের শিক্ষকের ভর্ৎসনা তাঁকে শুনতে হচ্ছে, কেন তিনি বিশেষ কোনও যুদ্ধ কোন বছরে হয়েছিল তা মনে রাখেননি! আইনস্টাইন বললেন, সে ব্যাপারে তাঁর কোনও উৎসাহ নেই। বরং, তিনি এটা জানতে আগ্রহী যে কেন বিবদমান সৈনিকেরা হত্যালীলায় মেতে উঠেছে যখন তারা পরস্পরকে জানত না, চিনত না। আইনস্টাইন জানতে চেয়েছিলেন, যুদ্ধের কারণ কী, যুদ্ধ কেন ঘটে, কারা ঘটায়।

আজকের যুগে এই প্রশ্ন ছাত্রছাত্রীরা যদি করে তবেই হয়তো শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য সাধিত হয়। যেখানে জিজ্ঞাসাই আসল শিক্ষা। পাঠ্যক্রমের অন্তর্গত অনেক গল্প, কবিতা, নাটকের মধ্যে চিন্তার রসদের অভাব নেই। কিন্তু চিন্তার চর্চা করার জন্য যে সময়টুকু প্রয়োজন, শিক্ষার ইঁদুরদৌড় সেই সময় শিক্ষার্থীকে দিচ্ছে না।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিক্ষা ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক খরচ। বিদ্যালয় স্তর থেকে একটি ছাত্র বা ছাত্রীর জন্য কিছু অভিভাবক যে টাকা খরচ করেন, তা সব অভিভাবকের কাছে সহজলভ্য নয়। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলির ফি প্রতি বছর বেড়ে চলে কোনও না কোনও কারণ দেখিয়ে। বাহ্যিক আড়ম্বরে ঘাটতি হয় না, কিন্তু শিক্ষার মূল সুরটা অনেক ক্ষেত্রেই কেটে যায়। ‘স্মার্ট ক্লাস’, ‘স্মার্ট ল্যাব’ শুনতে ভাল, কিন্তু তা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে প্রশ্নাতীত নয়।

এ প্রসঙ্গেই প্রশ্ন উঠতে পারে, শিক্ষার অঙ্গন চার দেওয়ালের মধ্যে সব সময় সীমাবদ্ধ রাখতে হবে কেন? বিজ্ঞানের ক্লাসে নিত্য নৈমিত্তিক বইভিত্তিক পড়াশোনার প্রথা এক দিনের জন্য সরিয়ে রেখে স্কুলের খেলার মাঠে যে গাছগুলো আছে— সেই সেগুন, মহানিম, শিমুল, আম, জাম, পেয়ারা, আমলকি গাছগুলোর সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের পরিচয় করানো যেতে পারে। তাদের বোঝানো যেতে পারে, কী ভাবে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়া যায়। ‘জুলিয়াস সিজার’ বা ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’ ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের দিয়েই অভিনয় করানো যায়। বাংলা মাধ্যমের ছেলেমেয়েরা যদি ইংরেজি নাটকে স্বচ্ছন্দ না হয়, তবে তারা অনায়াসে করতে পারে ‘অবাক জলপান’ বা রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যগুলি।

রবীন্দ্রনাথ বলতেন, ‘প্রকাশিত হও’। সে প্রকাশ গতানুগতিক পড়াশোনার বাইরের কোনও জগতেও হতে পারে। তার প্রকাশ ঘটতে পারে খেলায়, অভিনয়ে, সমাজসেবায়, জীবনের যে কোনও ক্ষেত্রে। আজকের অস্থির সময়ে ছাত্রছাত্রীদের সংস্কৃতিমনস্ক রাখা এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সুস্থ সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের পরিচয় করানো শিক্ষার এক আবশ্যিক অঙ্গ। বিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তার বিকাশ ঘটানো যায়।

দেশের প্রায় প্রতিটি বোর্ডের সিলেবাসে পড়াশোনার চাপ অত্যধিক। অথচ, ভূতপূর্ব রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে বারবার আক্ষেপ করতে শোনা গিয়েছে যে, পৃথিবীর প্রথম দু’শোটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ভারতের কোনও বিশ্ববিদ্যালয় নেই। অন্য দিকে, শুধু শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই নোবেল প্রাপকের সংখ্যা ৯২ জন। সুতরাং, বুঝতেই পারা যায় শিক্ষাক্ষেত্রে প্রাথমিক স্তর থেকেই কোথাও একটা গলদ রয়েছে। অথচ, শিক্ষার খরচ দিনদিন বাড়ছে।

শিক্ষা কি তা হলে আমাদের দেশে শুধু বিষয়ভিত্তিক মুখস্থবিদ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, না মৌলিক চিন্তা ও তা কার্যকর করার মধ্য দিয়ে শিক্ষার স্বরূপকে বোঝার চেষ্টা করা উচিত? ভাবুন, গোপাল ভট্টাচার্যের কথা। সাধারণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অনেক উপরে উঠে তিনি লিখলেন, ‘বাংলার কীটপতঙ্গ’ বা তারাপদ সাঁতরা অমর হয়ে রইলেন বাংলার পুরাতত্ত্ব ও প্রাচীন মন্দির নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে। এঁদের উদাহরণ থেকেই ভাবতে ইচ্ছে করে, বিদ্যালয় স্তর থেকে শিক্ষা এমন হবে, যা মানুষকে অনুসন্ধিৎসু হতে শেখাবে। শিক্ষা শুধু চাকরি পাওয়ার হাতিয়ার হবে না। তার মূল কাজ হবে, পড়ুয়াদের মানসিক বিকাশের পথ প্রশস্ত করা।

এই অস্বাভাবিক ইঁদুরদৌড় থেকে ছাত্রছাত্রীদের মুক্তি দিতে হবে। শুধু প্রতিযোগিতার দোহাই দিয়ে তাদের শৈশব, কৈশোরকে ধ্বংস করলে চলবে না। এই বিশ্ব সৃষ্টির নিজস্ব এক সমীকরণ আছে, এক নিজস্ব সুর তাল, ছন্দ আছে। তা বোঝার জন্য পড়ুয়াদের মননকে সার্বিক ভাবে ঋদ্ধ করতে হবে।

লেখক বিদ্যাসাগর মডেল স্কুলের প্রধান শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE