ছোট্ট ছেলেটিকে ডাকলে সাড়া মিলত দেরিতে। চিন্তায় পড়েছিলেন প্রাক্তন অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটার। বাইশ গজের লড়াইয়ে হার না মানা ব্রেট লি-র মানতে কষ্ট হয়েছিল, যে তার ছেলের কানে শোনার সমস্যা রয়েছে। পাঁচ বছর বয়সে ধরা পড়ে অসুখ। টানা চিকিৎসায় এখন সুস্থ সে। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে এ কথা জানিয়েছেন ব্রেট লি।
লি-র ছেলের মতোই বিশ্ব জুড়ে শিশুদের মধ্যে এই অসুখ বাড়ছে। পিছিয়ে নেই এ দেশও। ২০১৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষায় ধরা পড়ে, পাঁচ বছরের নীচে প্রতি হাজার জনে ৩০টি শিশু আংশিক বা সম্পূর্ণ শ্রবণশক্তি হারাচ্ছে। ২০১৭ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে, প্রতি হাজারে ৫০।
এ রাজ্যে যদিও সংখ্যাটা কত, এখনও পর্যন্ত তার নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। তবে চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, পরিস্থিতি যথেষ্ট উদ্বেগজনক। তবে আতঙ্ক নয়, বরং বাবা-মাকে আরও সজাগ হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন তাঁরা। ঠিক সময়ে রোগ নির্ধারণ করে চিকিৎসায় এড়ানো যেতে পারে বড় ক্ষতি, জানালেন চিকিৎসকেরা। আজ, শনিবার বিশ্ব শ্রবণ দিবসে এই সমস্যাই তাই বার বার আলোচনায় উঠে আসছে।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, রাজ্যে একমাত্র এসএসকেএম হাসপাতালেই সদ্যোজাত ও শিশুদের এই চিকিৎসার পরিকাঠামো রয়েছে। ২০০৩ সাল থেকে এখানে সদ্যোজাতের শ্রবণশক্তি পরীক্ষা করা হয়। থেরাপি, ট্রেনিং বা শ্রবণযন্ত্র দিয়ে চিকিৎসাও হয়। এর পরেও যদি রোগী চিকিৎসায় সাড়া না দিলে, ককলিয়া প্রতিস্থাপন করা হয়। ২০১৬ সাল থেকে এসএসকেএম-এ বিনামূল্যে এই অস্ত্রোপচার শুরু হয়েছে। বেসরকারি ভাবে ককলিয়া বসানোর খরচ দশ লক্ষেরও বেশি। পিজি-তে এখনও পর্যন্ত ২৭টি বাচ্চার অস্ত্রোপচার হয়েছে। সংখ্যাটা চাহিদার তুলনায় কম। কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে যন্ত্রের জোগান ঠিক মতো না আসা এর কারণ বলে জানাচ্ছেন হাসপাতেলর চিকিৎসকেরা।
কেন বাড়ছে এই সমস্যা?
নিওনেটোলজিস্টদের মতে, অপরিণত শিশু (৩৭ সপ্তাহের আগেই) ভূমিষ্ঠ হলে তার শ্রবণ ক্ষমতার ক্ষতি হতে পারে। দেরিতে বিয়ে, বেশি বয়সে সন্তানধারণ, সন্তানসম্ভবা মহিলার অতিরিক্ত কাজের চাপে অপরিণত শিশুর জন্ম বাড়ছে। অন্তঃসত্ত্বা স্টর্চ সংক্রমিত (সিফিলিস, টক্সোপ্লাজমা, রুবেলা, সাইটোম্যাগালো ভাইরাস, হারপিস) হলে সদ্যোজাতের শ্রবণশক্তির উপরে খারাপ প্রভাব পড়ে।
শিশু চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, শ্বাসের ত্রুটির কারণে সদ্যোজাত ভূমিষ্ঠ হয়েও কাঁদে না, একে বলে বার্থ অ্যাসপেকশিয়া। এর জেরেও শ্রবণযন্ত্রের ক্ষতি হয়। পাশাপাশি শিশুর মেনিনজাইটিস বা জন্ডিস হলে শ্রবণযন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এসএসকেএম-এর ইএনটি চিকিৎসক এবং ন্যাশনাল প্রোগ্রাম ফর প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল অব ডেফনেস, পশ্চিমবঙ্গের চেয়ারম্যান অরুণাভ সেনগুপ্ত বলছেন, ‘‘ছ’মাসে শিশু যদি শব্দ শুনেও প্রতিক্রিয়া না জানায় বা এক বছরেও কথা না শুরু করে, তখন দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। থেরাপি, ট্রেনিং বা শ্রবণ যন্ত্র দিয়ে সমাধান না হলে অস্ত্রোপচার করে ককলিয়া প্রতিস্থাপন করা হয়। এ সবই পাঁচ বছরের মধ্যে করা জরুরি।’’ ইএনটি শল্য চিকিৎসক মিলিন্দ কীর্তনের মতে, ‘‘সদ্যোজাতের শ্রবণশক্তি পরীক্ষা আবশ্যিক। তবেই ছ’মাস বয়সের মধ্যে তার চিকিৎসা শুরু করে রোগ প্রতিরোধ সম্ভব।’’ স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা জানাচ্ছেন, ইতিমধ্যেই রাজ্য সরকার ১২টি মেডিক্যাল কলেজে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে এই পরীক্ষা পদ্ধতি শুরু করতে চলেছে। গ্রামাঞ্চলেও যাতে স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সদ্যোজাতের শ্রবণশক্তি পরীক্ষা করতে পারেন, সেই কাজও শুরু হচ্ছে।
কারণ শব্দদূষণ, শিশুদের অত্যধিক মোবাইলের ব্যবহার, বাবা-মায়ের সচেতনতার অভাবে ভবিষ্যতে শিশুদের কানে শোনার সমস্যা বড় আকার নিতে পারে বলে আশঙ্কা চিকিৎসক মহলের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy