Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

চালতা থেকে কয়েতবেল, দেশি ফলেই বরফকাঠি

এ তো ঠিক আসল কালোজামের মতো! খেতে গেলে জিভে রং ধরছে। ঠোঁটে রং লাগছে না! কলেজ স্ট্রিটের মেলায় খাঁটি ফলের বরফকাঠি চেখে চমৎকৃত বিরাটির মৃণালিনী কলেজের অনীশা পাল। নুন-মিষ্টি-লঙ্কার ত্র্যহস্পর্শে মাখা কয়েতবেলের অন্ধভক্ত ঝামাপুকুরের সুজাতা দত্তের জিভে জল আসছিল, ‘কয়েতবেলের আইসক্রিম’ শুনে।

চেখে দেখা। মধ্য কলকাতার এক দোকানে। — নিজস্ব চিত্র

চেখে দেখা। মধ্য কলকাতার এক দোকানে। — নিজস্ব চিত্র

ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০২:১২
Share: Save:

এ তো ঠিক আসল কালোজামের মতো! খেতে গেলে জিভে রং ধরছে। ঠোঁটে রং লাগছে না!

কলেজ স্ট্রিটের মেলায় খাঁটি ফলের বরফকাঠি চেখে চমৎকৃত বিরাটির মৃণালিনী কলেজের অনীশা পাল।

নুন-মিষ্টি-লঙ্কার ত্র্যহস্পর্শে মাখা কয়েতবেলের অন্ধভক্ত ঝামাপুকুরের সুজাতা দত্তের জিভে জল আসছিল, ‘কয়েতবেলের আইসক্রিম’ শুনে। তবে জানা গেল, এ মরসুমে তার হদিস মিলছে না। আইসক্রিম বলাটা ঠিক নয়। কারণ, নানা কিসিমের দেশি ফলের নির্যাসে দুধ-মালাই নেই। তাই বরফকাঠি বা ‘আইস ক্যান্ডি’ বলাই যথাযথ। গোটা দুনিয়ার আইসক্রিম-রসিকেরা যাকে সর্বে বলেন।

বাড়তি ক্রিম না থাকলেও কলকাতায় দইও কাঠি আইসক্রিমের আঙ্গিকে পেশ করা হচ্ছে। সল্টলেকের রথের মেলা, কাঁকুড়গাছির সুভাষমেলা বা কলেজ স্ট্রিটের বর্ণপরিচয়-এর হস্তশিল্প মেলায় বিক্রেতারা হাঁক পাড়েন— দই খান দই, বাটিতে নয় কাঠিতে! নলেনগুড়ের পায়েসও কাঠিতে জমাট বেঁধে আবির্ভূত।

বিজাতীয় ব্লুবেরি, সিসিলি লেমন, স্ট্রবেরি বা পিঙ্ক গুয়াভা-র মতো ভিনদেশি স্বাদের সর্বে-য় আগেই ধাতস্থ হয়েছে এ শহর। ক্রমে জাতে উঠছে দেশি ফলেরাও। ডাব, কমলা, কাঁঠাল, আনারস, পেয়ারা, চালতা, বিলিতি আমড়া, কামরাঙারাও এখন ঢুকে পড়ছে বরফকাঠির সুস্বাদে। এমনকী ব্রাত্য নয় ধনেপাতাও। রাজারহাটের সিটি সেন্টার-টু, সল্টলেকের সুইমিং পুলের বিপণি থেকে টালিগঞ্জের পল্লিশ্রী, হিন্দুস্থান পার্ক বা উত্তরের বিবেকানন্দ রোডে প্রাকৃতিক ও কীটনাশকমুক্ত পণ্যের ঠেকেও ঢুকে পড়েছে এই বাঙালি বরফকাঠি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিন থেকে শুরু করে কয়েকটি স্কুল ক্যান্টিনের টিফিনবেলাও জমে উঠছে নানা টক-মিষ্টি স্বাদে।

শুরুটা অবশ্য এক দশক আগে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর রুরাল অ্যান্ড ক্রায়োজেনিক টেকনলজি (সি আর সি টি)-র তৎকালীন অধিকর্তা সিদ্ধার্থ দত্তের উদ্যোগে চেষ্টা শুরু হয়েছিল। বাজারচলতি নরম পানীয় ও আইসক্রিমের স্বাস্থ্যকর ও স্বাদু বিকল্প তাঁরা খুঁজছিলেন। পানের স্বাদের নরম পানীয় আত্মপ্রকাশ করে। ‘পাঞ্চ’ নামে তা বাজারে ডানা মেলেছিল। পরে রকমারি ফলের স্বাদের বরফকাঠি দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। স্রেফ তৈরির খরচটুকু তুলে ছড়িয়ে পড়ছিল। ওই প্রকল্পে যুক্ত সিআরসিটি-র তৎকালীন টেকনিক্যাল ম্যানেজার অসীম চট্টোপাধ্যায় পরে কারখানা খুলে এই দেশি স্বাদ জনপ্রিয় করার চেষ্টায় নেমেছেন।

সিদ্ধার্থবাবু, অসীমবাবুদের দাবি— এই বরফকাঠিতে কোনও প্রিজার্ভেটিভ, কৃত্রিম রং বা গন্ধ নেই। চিনির ভাগও সামান্য। ১০০ শতাংশ ‘ন্যাচারাল’ তকমাধারী দেশি-বিদেশি আইসক্রিম সংস্থাও অবশ্য ইতিমধ্যে কলকাতায় ঝাঁপ ফেলেছে। তবে দেশি বা স্থানীয় ফলের স্বাদ নিয়ে তাদের নাড়াচাড়া কম। শহরে ইতালীয় হাতে গড়া আইসক্রিম ‘জেলাতো’র একটি নামজাদা ঠেকের কর্ণধার অঙ্কিত সিংহানিয়ার কথায়, ‘‘ফলের স্বাদের সর্বে এখনও কিছু আছে। তবে বাজারের চাহিদা মেনেই অন্য ধরনের ডেজার্টে জোর দিয়েছি।’’

দক্ষিণ কলকাতার একটি রেস্তোরাঁয় কাঁচা লঙ্কা-কাঁচা আম, গন্ধরাজ লেবু, পেয়ারা-বিটনুন বা তেঁতুল-পুদিনার সর্বে মেলে। বিভিন্ন পদের মাঝে টাকরা মেজে নতুন স্বাদ গ্রহণের জন্য রসনা তৈরি করা যার উপযোগিতা। রেস্তোরাঁর কর্তা শেফ জয়মাল্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের আফশোস, ‘‘ইদানীং বাঙালি মিষ্টি ফিউশনের ছোঁয়ায় সাহেব হতে চেষ্টা করছে। দেশি ফলের স্বাদ ভুলতে বসেছেন।’’

আইসক্রিমের মোড়কে সেই দেশি স্বাদ-গন্ধের বাজার এখনও বড় নয়। তবু ফাস্টফুড-খোর প্রজন্মের সামনে তা কিছুটা হলেও দেশি জাম-কাঁঠালের স্বাদ তুলে ধরছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Ice Candy Local Fruit Taste
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE