প্রতীকী ছবি
প্রশ্ন: কলকাতার জিডি বিড়লা স্কুলে সম্প্রতি ওঠা অভিযোগ সম্পর্কে কী বলবেন?
উত্তর: ওই স্কুলে যে অভিযোগ উঠেছে তা নতুন কিছু নয়। মাঝে মধ্যেই এ দেশে বা বিদেশে এই ধরনের ঘটনার কথা আমরা জানতে পারি। মনস্তাত্ত্বিক় দিক থেকে আমরা একে ‘যৌন বিকৃতি’ বলে থাকি। সভ্যতার শুরু থেকেই এটা আছে। কিন্তু সংখ্যা এবং ঘটনার গুরুত্ব অনুযায়ী তা ছিল প্রায় নগণ্য। কিন্তু এখন তা এমন একটি জায়গায় এসে পৌঁছেছে যা সমাজে রীতিমতো সঙ্কটজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
এখনই সচেতন না হতে পারলে সঙ্কট ঘনিয়ে আসবে।
প্রশ্ন: শিশুরা কেন এই বিকৃতির হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না?
উত্তর: কিছু প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের বিকৃতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে শিশুরাও তাদের হাত থেকে ছাড় পাচ্ছে না। বার বার এটা দেখা যাচ্ছে। নানা কারণে শিশুরা ‘সফট টার্গেট’। সমাজ একটা ভয়ঙ্কর বিপদের সম্মুখীন। আরও উদ্বেগের যে, শিশুরা শুধু যে বড়দের দ্বারাই আক্রান্ত হচ্ছে এমন নয়, ছোটদের দ্বারাও এমন ঘটনা ঘটছে। আমার কাছে বহু মা-বাবা এসে এখন এমন সমস্যার কথা জানাচ্ছেন। আসলে ছোটরা যা দেখে বা শোনে, তা অনুসরণ করে। তারা তা প্রয়োগ করছে তার সহপাঠী বা বয়সে ছোট কারও উপরে। এটা ভয়ানক ব্যাপার।
প্রশ্ন: আক্রান্ত শিশুর ‘ট্রমা’র সঙ্গে কী ভাবে মোকাবিলা করা উচিত?
উত্তর: প্রথমত, বাচ্চা যেন বাড়িতে বাবা-মাকে সব কথা জানানোর মতো পরিবেশ পায়। বিষয়টি জানার পরে বহু বাবা-মা চেপে যেতে চান। সেটা একেবারেই করা যাবে না। গুটিয়ে গেলে হবে না। ন্যূনতম ঘটনাতেও মুখ খুলতে হবে। দেখা গিয়েছে, একশোটি ঘটনা ঘটলে হয়তো দু’টি বাচ্চাকে নিয়ে বাবা-মা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। তা করলে হবে না। ঘটনার কথা জানা মাত্র দ্রুত ‘থেরাপি’ চালু করতে হবে। যা হয়ে গিয়েছে সেটা না ভেবে বাচ্চার মনোবল বাড়িয়ে এগতে হবে। দ্বিতীয়ত, বাচ্চাটি সেই মুহূর্তে যে মানসিক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ওষুধ প্রয়োজন। সে জন্য দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। তৃতীয়ত, ‘প্রফেশনালি সাইকোথেরাপি’ করতে হবে। সেটা হয়তো মা-বাবার পক্ষে সম্ভব হবে না। তার কাছ থেকে সব কথা বের করতে হবে। ‘সাইকো অ্যানালিসিস’ করতে হবে। শিশুরা সাধারণত বলতে চায় না। তবু কথা বার করে নিতে হবে। চিকিৎসকের সামনে ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেওয়ার পরে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বাচ্চাটি কিছুটা স্বস্তি বোধ করছে। সব শেষে, ফের যাতে এমন পরিস্থিতি সে এড়াতে পারে, পরিস্থিতি আগাম আঁচ করে সেখান থেকে সরে আসা বা কেউ খারাপ ভাবে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করছে কি না তা বোঝার বোধ গড়ে দেওয়ার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যেতে বাবা-মাকে। শেষ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে আমার মনে হয়। এটা ঠিক ভাবে করতে পারলে অনেক বিপদ আগাম এড়ানো সম্ভব বলে মনে করি।
প্রশ্ন: স্কুলের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে শিশুর যৌন হেনস্থার অভিযোগ উঠছে। এটা নিয়ে কী বলবেন?
উত্তর: যদি অভিযোগ আদালতে সত্য বলে প্রমাণিত হয় তবে বুঝতে হবে, আমাদের সমাজের বাঁধন কতটা আলগা হয়ে গিয়েছে যে স্কুলের ভিতরে শিক্ষকেরা এমন ঘটনা ঘটাতে পারছেন। প্রতি মুহূর্তে ধরা পড়ার ভয় রয়েছে। বাচ্চাটি কাউকে গিয়ে বলে দিতে পারে। কেউ দেখে ফেলতে পারে। তার পরেও যদি এমন করা হয়ে থাকে, তা হলে ধরে নিতে হবে পরিণতি কী হতে পারে তা ভাবা হচ্ছে না। ‘সেন্স অফ কনসিকোয়েন্স’ উবে গিয়েছে।
প্রশ্ন: কী ভাবে যৌন বিকৃতি আগাম আঁচ করা যাবে?
উত্তর: যে কোনও মানুষের যৌন বিকৃতি থাকতে পারে। কিন্তু সেটা নিয়ন্ত্রণে থাকে একাধিক কারণে। ব্যক্তিত্ব, সমাজ-সংসারে বাঁধন মানুষকে আটকে রাখে। তাই সে এমন কিছু করতে পারে না, যাতে তার চরিত্রে দাগ লাগে। কিন্তু অনেকেরই সেই দায়ভার থাকে না। তাই কখন সে কী করে বসে তার আগাম আঁচ পাওয়া কঠিন। আগে একশো জনের মধ্যে হয়তো দু’-তিন জনের এমন বিকৃতি থাকত। তারও রকমফের আছে। কোনও ছেলে হয় তো মেয়েদের স্পর্শ চায়। কারও হয়তো অন্য কোনও ইচ্ছা জাগে। কেউ হয়তো কোনও মহিলার ছবি দেখে নিজেকে সামলাতে পারে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা আয়ত্বের মধ্যে থাকত। কিন্তু এখন আর তেমন নয়।
প্রশ্ন: তথাকথিত শিক্ষিত, আপাত ভদ্রদের বিরুদ্ধেও এমন অভিযোগ উঠছে। কী বলবেন?
উত্তর: যৌন বিকৃতি থাকলে তারা অতি-যৌনতায় ভোগে। কাজটা করে ফেলার পরেও তাদের অনুশোচনা থাকে না। সাধারণত, পরিবারে বাবা-মায়ের সম্পর্ক স্বাভাবিক না থাকা, সংসারে নিত্য অশান্তি বা পারিপার্শ্বিক পরিবেশগত কোনও কারণে কেউ কেউ হয়তো অন্য রকম হয়ে যায়। কিন্তু এখন আর তেমন নয়। অভিজ্ঞতায় দেখছি, আপাত ভদ্র, শিক্ষিত পরিবার থেকেও এমন ঘটনা ঘটছে। দ্বিমত থাকতে পারে। তবু একটি কথা না বললেই নয়। আসলে, যৌন বিকৃতি তৈরি করার মতো বাতাবরণে চারিদিক ছেয়ে গিয়েছে।
প্রশ্ন: একটু বিশদে বলবেন?
উত্তর: আমি যেটা বলতে যাচ্ছি, সেটা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু, আমি আমার মত জানাচ্ছি। বিজ্ঞাপন, মিডিয়া, বিনোদনের প্রভাব রয়েছে আজকের সমাজে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বিলবোর্ডে অর্ধনগ্ন মহিলার ছবি। সিনেমার ম্যাগাজিনেও তাই। মিডিয়ায় কোনও মডেল বা অভিনেত্রীর ছবি দেখিয়ে পরিচয় করানো হয়, ‘শি ইজ লুকিং হট’ বা ‘এত সেক্সি’! আগে এ সব ভাষা ব্যবহার করার কথা কেউ ভাবতে পারত? এই ধরনের ভাষার প্রয়োগ বন্ধ হওয়া উচিত। কেন এমন বলছি?
সাইকোলজিতে বলে, কোনও জিনিস বার বার দেখলে সেটা মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলবেই। তা নিজের ইচ্ছা, চিন্তাধারা বদলে দিয়ে, তার ভালা লাগা বদলে দেয়। যেমন, রাস্তার মোড়ের বিজ্ঞাপনে একটা অর্ধনগ্ন মেয়ের ছবি যদি টানা সাতদিন থাকে, তা হলে ৬২ শতাংশ পুরুষের মধ্যে সেটা নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়। এটা তত্ত্ব। টিভির বিজ্ঞাপনেও তাই। মিডিয়ার ভাষাও অনেক সময় উত্তেজকের ভূমিকা নেয়। আবার দেখা গিয়েছে, অধিকাংশ মহিলা সাজগোজ করে শুধু সুন্দরী নয়, যৌন আবেদনময়ীও হতে চান। পুরুষেরা যেন আকৃষ্ট হয়। সব মিলিয়ে যৌন চঞ্চলতা বৃদ্ধির বাতাবরণ চারিদিকে। গণতান্ত্রিক দেশে হয়তো যার যা খুশি করার স্বাধীনতা আছে। কিন্তু আমি মনে করি, কোথাও নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার। না হলে মানুষের, সমাজের নিজস্বতা নষ্ট হয়। যার কুফল থেকে রেহাই পায় না শিশুরাও।
প্রশ্ন: কিন্তু মহিলারাই বা নিজেদের আগলে বেঁধে রাখবেন কেন?
উত্তর: আমি তা বলতে চাইছি না। পুরুষ বা মহিলা, যার যা ইচ্ছা করুন। আমার আপত্তি থাকবে কেন? কিন্তু মনোবিদ হিসাবে দেখেছি, কিছু মহিলা বিকৃত রুচির বশবর্তী হয়ে এমন কিছু করে ফেলছেন যা থেকে পরে সমস্যায় পড়ছেন। উদ্বেগ, অপরাধবোধের শিকার হচ্ছেন। আমার বক্তব্য, পুরুষ ও নারী, সবাই মনের জানালাগুলি খুলে রাখুন। যা করবেন বা যা করতে যাচ্ছেন, তার আগুপিছু ভাবুন। না হলে এর প্রভাব থেকে রেহাই পাবে না শিশুরাও।
সাক্ষাৎকার: অর্পিতা মজুমদার
সাত দিনে সাত কাহনের বিভিন্ন বিভাগে ই-মেল বা চিঠি পাঠাতে:
ই-মেল: edit.southwestbengal@abp.in
চিঠি: আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬, প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা- ৭০০০০১।
চিঠি বা ই-মেলে সংশ্লিষ্ট বিভাগের নাম উল্লেখ করতে ভুলবেন না
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy