Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

যত আরাম, ততই ক্ষতি

এখন অনেকে কম বয়সেই কোমরের ব্যথায় ভুগছেন। কারণ, মেরুদণ্ডের হাড় শক্ত হচ্ছে না। জানাচ্ছেন অস্থিরোগ বিশেষজ্ঞ চিন্ময় দে। সাক্ষাৎকার সৌমেন দত্তএখন অনেকে কম বয়সেই কোমরের ব্যথায় ভুগছেন। কারণ, মেরুদণ্ডের হাড় শক্ত হচ্ছে না। জানাচ্ছেন অস্থিরোগ বিশেষজ্ঞ চিন্ময় দে। সাক্ষাৎকার সৌমেন দত্ত

শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০১৮ ০৪:৪৩
Share: Save:

প্রশ্ন: ভিড় বাসে বা ট্রেনে নামতে গিয়ে কোমরে হ্যাঁচকা টান লাগে। বাড়ি যাওয়ার আগে ব্যথা শুরু। তখন কী করা উচিত?

উত্তর: এটা অনেকেরই হয়। শুধু ভিড় বাস বা ট্রেনে নয়, বর্ধমান শহরে টোটোতেও মাঝেমধ্যে এমন ঘটনা ঘটে। দু’-তিন সপ্তাহ পর্যন্ত এই ব্যথা থাকতে পারে। তার পরেও ওই ব্যথা না কমলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে গিয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ নেবেন।

প্রশ্ন: এই ব্যথা কি পরবর্তী সময়ে মারাত্মক হতে পারে?

উত্তর: অনেক কিছুই হতে পারে। কী ধরনের চোট লেগেছে, তার উপরে নির্ভর করে। চোট মেরুদণ্ডে লাগল, অথচ সময়ে চিকিৎসা না হলে দু’টি পায়ে প্যারালিসিসও হয়ে যেতে পারে। সঙ্গে ব্লাডারের কাজ বন্ধ হয়ে রোগীর স্বাভাবিক প্রস্রাব করার ক্ষমতা চলে যেতে পারে।

প্রশ্ন: আঘাত না পেলেও অনেকেই কোমরের ব্যথায় ভোগেন, বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম। এর কারণ কী?

উত্তর: অনেকগুলি কারণের জন্য নতুন প্রজন্মের একটা বড় অংশ কোমরের ব্যথায় ভুগছেন। প্রথম দিকে ব্যথা অবহেলা করার জন্য পরে তা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এই ব্যথার কারণগুলি হল:

১) শরীরের গঠন অনুযায়ী মোটরসাইকেল চালানোর দিকে কেউ নজর দেন না। দিনের পরে দিন ঝাঁকুনির জন্য মেরুদণ্ডের উপরে প্রভাব পড়ে। মেরুদণ্ডের স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট হয়ে যায়। তখন ঝাঁকুনি সরাসরি মেরুদণ্ডের উপরে পড়ে।

২) অতিরিক্ত কম্পিউটার ব্যবহারের জন্যেও মেরুদণ্ডের উপর প্রভাব পড়ে। অনেকেই কম্পিউটারে এক টানা কাজ করেন। এতে ধীরে ধীরে মেরুদণ্ডের পাশের পেশীগুলি শক্ত হয়ে যায়। মেরুদণ্ডের উপরে অতিরিক্ত চাপ পড়ে। দিনের পরে দিন এই রকম চলতে থাকলে কোমরের ব্যথা শুরু হয়। চিকিৎসার ভাষায় যার নাম হয়েছে, ‘কম্পিউটার রিলেটেড ডিজিজ’।

৩) দাঁড়িয়ে রান্না করার জন্য গৃহবধূরাও কোমরের ব্যথায় আক্রান্ত হতে পারেন। মেরুদণ্ড দেহের ওজন নিতে না পারলেই কোমরের উপর প্রভাব পড়বে।

প্রশ্ন: নতুন প্রজন্ম কোমরের ব্যথায় দ্রুত আক্রান্ত হচ্ছে কেন?

উত্তর: আমি যখন চিকিৎসক পেশায় আসি, তখন দেখতাম পুরুষদের ৪০ বছরের বেশি, আর মহিলাদের ৫০ বছরের বেশি বয়স হলে কোমরের ব্যথা নিয়ে আমাদের কাছে আসছেন। আর এখন দেখছি ২০-২৫ বছর থেকেই কোমরের ব্যথা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে লাইন দিচ্ছে। এর প্রধান কারণ, মেরুদণ্ডের হাড় শক্ত হচ্ছে না। মেরুদণ্ডের হাড় শক্ত করার জন্য খেলাধুলো, শরীরের কার্যক্ষমতা বাড়ানোর প্রয়োজন। এখনকার ছেলেমেয়েদের সেই সময়টা কোথায়? সবাই তো বই নিয়ে ছুটছে।

প্রশ্ন: কিন্ডারগার্টেনের পড়ুয়াদের তো ব্যাগের বোঝার ঠেলাতে কাঁধ ঝুকে যাওয়ার উপক্রম?

উত্তর: এটাই তো বলতে চাইছি। শরীরের ওজনের ১০ ভাগের এক ভাগ বহন করার ক্ষমতা আমাদের। অথচ শিশুদের তার চেয়ে বেশি ওজন বইতে হয়। তার ফলে প্রথমে কাঁধের উপর চাপ পড়ে। তার জন্য মেরুদণ্ড বেঁকে যায়। মেরুদণ্ড নিজের জায়গায় ফিরে আসার জন্য শরীরের ভিতরেই লড়াই করে। দুইয়ের চাপের প্রভাব পড়ে কোমরের উপরে।

প্রশ্ন: আমরা অনেক সময় শুনি, নরম, মোটা গদিতে ঘুমালেও নাকি কোমরে ব্যথা হয়। এটা কি ঠিক?

উত্তর: ঠিকই শুনেছেন। এক ইঞ্চির বেশি গদিতে শুলেই মেরুদণ্ড সোজা থাকে না। তখনই মেরুদণ্ডের পাশের মাংসপেশির উপরে চাপ পড়ে। সেখান থেকে কোমরের ব্যথা শুরু হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলি, অনেকে ভাবেন বালিশে শোয়া ঠিক নয়। এটা ভুল ধারণা। শরীর ও মাথার সঙ্গে সামঞ্জস্য না থাকলে ঘাড়ে ব্যথা শুরু হয়ে যাব। ভুল ভাবে সোফাতে বসলেও কোমরে ব্যথা হতে পারে। মনে রাখতে হবে, যত আরাম ততই কোমরের ক্ষতি।

প্রশ্ন: কোমরের ব্যথার জন্য শরীরের অন্যান্য অংশের কি আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে?

উত্তর: অবশ্যই। পেটের রোগ হতে পারে। এমনকী কিডনি-গল ব্লাডারেও সমস্যা দেখা দিতে পারে।

প্রশ্ন: কোমরের ব্যথা হওয়ার কিছু দিন পরেই দেখা যায় পা ঝিনঝিন করছে। হাঁটতে গিয়ে সমস্যা হচ্ছে। এটা কেন হয়?

উত্তর: মেরুদণ্ড আমাদের শরীরকে ধরে রেখেছে। মেরুদণ্ড থেকে সরু তারের মতো শিরা বেড়িয়ে গিয়েছে। কোমরের ব্যথা শুরু হওয়া মানেই মেরুদণ্ডের উপরে চাপ বাড়ছে। এই চাপ মেরুদণ্ড নিতে পারছে না, তার মূল কারণ মেরুদণ্ড সরু হয়ে পড়ছে। মেরুদণ্ড সরু হওয়ার ফলে সেখান থেকে বেরনো শিরাগুলিও নিজস্ব ক্ষমতা হারাচ্ছে। তার জন্যই পা ঝিন-ঝিন শুরু হয়। সেখান থেকে স্নায়ুর রোগও দেখা দিতে পারে।

প্রশ্ন: মেরুদণ্ড সরু হয়ে যায় মানে?

উত্তর: ‘স্লিপ ডিস্ক’-র কথা শুনেছেন তো? মেরুদণ্ডে ৩৩টি টুকরো হাড় রয়েছে। ওই হাড়গুলিকে ধরে রেখে এক-একটি ‘ডিস্ক’। ওই ‘ডিস্কের’ উপর আস্তরণ রয়েছে। তার ভিতর রয়েছে ‘সেমি ফ্লুইড’। ক্রমাগত চাপের জন্য ওই আস্তরণ নষ্ট হয়ে যায়। তখন ফ্লুইড বেরিয়ে আসে। সে কারণেই মেরুদণ্ড সরু হয়ে পড়ে।

প্রশ্ন: এর কোনও প্রতিকার নেই?

উত্তর: প্রতিকার আছে। প্রথমত, প্রতি দিন আধ ঘণ্টা হাঁটা উচিত। সাঁতার কাটতে পারলে আরও ভাল। কম্পিউটারের সামনে বসে থাকলে বা মোটরসাইকে চালালে এক-দেড় ঘণ্টা অন্তর পাইচারি করা উচিত। তার সঙ্গে ব্যায়াম ও ফিজিওথেরাপি করা প্রয়োজন।

প্রশ্ন: ফিজিওথেরাপি কি বাড়িতে করা সম্ভব?

উত্তর: ফিজিয়োথেরাপি মানে অনেক কিছু। সবটাই বাড়িতে সম্ভব হয় না।

প্রশ্ন: এতে আগের মতো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা যাবে?

উত্তর: অনেকটাই। তবে নির্ভর করছে আঘাত কতখানি। আর সময়মতো ঠিকঠাক চিকিৎসা ও ফিজিওথেরাপি করেছিলেন কি না।

প্রশ্ন: এমনিতে কত দিন ধরে ফিজিওথেরাপি করতে হবে?

উত্তর: সেটাও নির্ভর করছে আঘাত কতখানি তার উপরে। মোটামুটি ভাবে পনেরো দিন থেকে দুই-চার মাস পর্যন্ত ফিজিওথেরাপি করা যেতে পারে।

প্রশ্ন: স্বাভাবিক ছন্দে নিজের পেশায় ফেরা যায় কি?

উত্তর: ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই কোনও অসুবিধা হয় না। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো নিয়ম মেনে চলতে হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Health Health Tips
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE