Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

‘কাবুলিওয়ালা’ ও ‘আনন্দ’র গান ছাড়া হিন্দি গানের ইতিহাস হয় না

মান্না দে-সলিল চৌধুরীর যুগলবন্দী নিয়ে লিখছেন দেবপ্রসাদ চক্রবর্তীবাংলা সিনেমার একটা গানের লাইন মনে পড়ছে। ‘যদি চাঁদ ও সূর্য একই সাথে ওঠে, কে কার তুলনা হবে বলো?’ মান্না দে এবং সলিল চৌধুরী। সুরের আকাশে সূর্য ও চাঁদ। প্রতিভা এবং শিক্ষা, হৃদয় ও মস্তিষ্ক, চূড়ান্ত ভাবে দু’জনের মেধাকে পূর্ণ করেছে।

শেষ আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫ ০০:১০
Share: Save:

বাংলা সিনেমার একটা গানের লাইন মনে পড়ছে। ‘যদি চাঁদ ও সূর্য একই সাথে ওঠে, কে কার তুলনা হবে বলো?’ মান্না দে এবং সলিল চৌধুরী। সুরের আকাশে সূর্য ও চাঁদ। প্রতিভা এবং শিক্ষা, হৃদয় ও মস্তিষ্ক, চূড়ান্ত ভাবে দু’জনের মেধাকে পূর্ণ করেছে। এই দু’জন যখন মিলিত হয়ে কোনও সঙ্গীত রচনা এবং পরিবেশন করেছেন, সৃষ্টি হয়েছে এক একটা দুর্মূল্য রত্ন।

১৯ নভেম্বর সলিল চৌধুরীর জন্মদিন। কলকাতায় একটা বড় মাপের অনুষ্ঠান হয়ে গেল এই উপলক্ষে। অনুষ্ঠানের প্রতিটি মুহূর্তে নতুন করে উপলব্ধি করা গেল, গান রচনায়, সুর প্রয়োগে, অর্কেস্ট্রেশনে, মননশীল পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সলিল চৌধুরী ছিলেন এক এবং একক। সলিলে অত্যন্ত মুগ্ধ ছিলেন মান্নাদা। মান্নাদা বলছেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের পরে এমন সঙ্গীতস্রষ্টা আর আসেননি। অত্যন্ত শিক্ষিত, মার্জিত, ভদ্র এবং সঙ্গীতমনস্ক মানুষ এই সলিল চৌধুরী। সহজাত সুরের সূক্ষ্মজ্ঞান ছাড়াও অত্যন্ত শক্তিশালী ওঁর লেখার হাত। সুরকার এবং সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে সলিলবাবুর স্থান ছিল একেবারে আলাদা। অসাধারণ সব সুরের সাথে ওঁর অনন্য সুরের অর্কেস্ট্রেশন এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেত ওঁর সকল সৃষ্টিকে। সলিল চৌধুরীর স্থান কেউ কোনও দিন পূর্ণ করতে পারবে না।’’ কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী এবং সুরকার পঙ্কজ মল্লিকও ছিলেন সলিল চৌধুরী সম্পর্কে অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। সলিল চৌধুরী সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি : ‘‘সঙ্গীত-শিল্পকলা ক্ষেত্রে ত্রিশক্তি সমৃদ্ধ এক প্রখ্যাত ও কীর্তিমান পুরুষ। তিনি কাব্য-লেখক রূপে বিশিষ্ট গীত-রচয়িতা, বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সুর রচয়িতা, স্বকীয়তা-প্রতিষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক’’।

মান্নাদা এবং সলিল চৌধুরীর পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন ছিল? ‘ব্যাপিকা বিদায়’ ছবির ‘কুয়াশা আঁচল খোলো’ গানের রেকর্ডিং। সলিলবাবুর কাছ থেকে মান্নাদা গানটা লিখে নিলেন। এবার সুরটা শিখে নিয়ে শর্ট নোটেশন করে রাখতে হবে। সলিলবাবু কাঁচুমাচু মুখে বললেন, ‘‘মান্নাদা, সুরটা এখনও হয়নি।’’ শুনে মান্নাদা তো আঁতকে উঠলেন—‘‘সেকী! আজই তো রেকর্ডিং। কী হবে তাহলে?’’ অন্য কেউ হলে মান্নাদা ঘরের দরজা সেই যে বন্ধ করতেন আর খুলতেন না। কিন্তু মানুষটা তো সলিল চৌধুরী। কখন যে কে কোথায় আটকে যায় বলা মুশকিল! ‘সন্ন্যাসী রাজা’ ছবিতে গানের একটা লাইন ছিল : ‘টাকা ছাড়া সবি ফাঁকা’। তো এই ‘ফাঁকা’ শব্দটি মান্নাদার নন-লিরিকাল মনে হয়েছিল। গৌরীপ্রসন্নর মতো গীতিকার। ভেবে দেখুন, দু’তিন দিন সময় নিয়েও তিনি অন্য শব্দ খুঁজে পেলেন না। সলিলবাবুর অনুরোধে মান্নাদাই সে গানের সুরটা তৈরি করে দিলেন। সেদিনই রেকর্ডিং হল। সৃষ্টি হল এক অসাধারণ গানের।

ভিন্ন ধরনের সুর রচনা করে সলিল চৌধুরী বম্বেতে একটা ঝ়ড় তুলেছিলেন। বাংলা-হিন্দি মিলিয়ে ১০০টার মতো ছবিতে তিনি তাঁর অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন। তিন বা ততোধিক নোট একসঙ্গে ব্যবহার করে যে-সমস্ত কর্ড সৃষ্টি করতেন, তেমন চলন পাশ্চাত্য সঙ্গীতেও সব সময় পাওয়া যায় না। কর্ড প্রয়োগে তিনি সেবাস্টিয়ান বাক-এর যথার্থ উত্তরসূরি। লতা মঙ্গেশকর একবার রোশনজিকে বলেছিলেন সলিলবাবুর সুর করার পদ্ধতিটা অনুধাবন করতে। সলিলবাবুর সুরের শ্রুতিমধুরতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন উঠবে না, কারণ তাঁর প্রায় প্রতিটি গানই জনপ্রিয়। আবার সঙ্গীতশাস্ত্রের মূল ব্যাকরণটা বজায় রেখে যে-পরীক্ষানিরীক্ষা তিনি করেছেন তা সঙ্গীতজ্ঞদের কাছে এক গবেষণার বিষয়। খুবই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সলিল চৌধুরী বলেছিলেন, ‘‘ভারতীয় সঙ্গীতে আছে দুর্লভ গভীরতা, গাম্ভীর্য আর সর্বোপরি এর ভাবমাধুর্য। বিশ্বের সঙ্গীত জগতে ভারতীয় সঙ্গীতের দেবার অনেক কিছুই আছে।’’ নিঃসন্দেহে সেই দায়িত্ব বিশেষ ভাবে নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন সলিল চৌধুরী।

এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার সঠিক রূপায়ণের জন্য সলিলবাবু বারবার দ্বারস্থ হয়েছেন মান্নাদার। ভেবে দেখুন, দু’জনের যুগলবন্দিতে কী সব অসাধারণ গান সৃষ্টি হয়েছে। শুরুটা সেই ১৯৫৩ সালে বিমল রায়ের ‘দো বিঘা জমিন’ ছবিতে। সলিল চৌধুরীর গল্প ও সুর। শৈলেন্দ্রর কথায় মান্নাদা গাইলেন ‘আরে তাক নাগিন নাগিন’ এবং ‘ও ভাইরে, গঙ্গা আউর যমুনাকি’। তারপর তো একে একে ইতিহাস তৈরি হতে লাগল। ‘মুসাফির’, ‘মধুমতী’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘আনন্দ’, ‘লালপাথর’, ‘অন্নদাতা’, ‘মেরে ভাইয়া’, আরও কত ছবি। যত দিন যাচ্ছে সলিল-মান্নার যুগলবন্দিতে তৈরি সেই সব গান যেন আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ভাল লাগছে জেনারেশনের পর জেনারেশনের ‘ছল ছল পানি হামরি’, ‘ফির ওহি দর্দ হ্যায়’, ‘দেজি দেজি হমসে ফিরে’, ‘ও বিছুয়া’, অ্যায় মেরে প্যারে ওয়াতন’, ‘নীচা কম উঁচা নাম’, জিন্দেগি ক্যায়সি হি পহেলি হ্যায়’, তেরি গলিও মে, বালমা মোরা...। সব গানেরই আলাদা বৈশিষ্ট। গান তৈরীর পদ্ধতিটা দেখুন। ‘কাবুলিওয়ালা’ ছবির ‘এ্যয় মেরে পেয়ারে ওয়তন’ গানের রেকর্ডিং। সিচুয়েশনটা এ রকম— সারা দিন ঘুরে ঘুরে কাবুলিওয়ালা (বলরাজ সাহনি হিং বিক্রি করে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছে। মনে পড়ছে দূর দেশে রেখে আসা ছোট্ট মেয়ের কথা, রবাব বাজিয়ে বিষণ্ণ মনে এই গানটা গাইছে। খুব আস্তে আস্তে নিজেকেই যেন গানটা শোনাচ্ছে। মান্নাদা ও সলিলবাবু ভেবে দেখলেন একটু চাপা গলায় গাইলেই সঠিক ভাবটা প্রকাশ পাবে। মান্নাদা সে ভাবেই গাইছিলেন। পোড় খাওয়া রেকর্ডিস্টও ধন্দে পড়লেন। জিজ্ঞাসাও করলেন— ‘মান্নাদা, গলাটা কি খারাপ আছে? সত্যি, ভাবা যায় না কী সেন্স। কী গানটাই না তৈরি হল! সবিতা চৌধুরী যথার্থই বলেছিলেন, ‘‘কাবুলিওয়ালা’ ও ‘আনন্দ’র গান ছাড়া হিন্দি গানের ইতিহাস হয় না।’’

বাংলা গানের একজন অতি-পণ্ডিত গীতিকার-সুরকার গায়ক একটি দৈনিক পত্রিকায় (আনন্দবাজার নয়) লিখেছিলেন মান্না দে নাকি গান নিয়ে ভৌগলিক সীমা অতিক্রম করতে পারেননি। কী মন্তব্য ভাবুন! একজন বাঙালি গায়ক। বাংলা সিনেমার জন্য গান গেয়ে জাতীয় পুরস্কার পেলেন। আবার হিন্দি ছবির গানের জন্যও রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। এখানেই কি শেষ! একেবারে অজানা ভাষা মালয়ালমে গেয়ে ‘চেম্মিন’ ছবির ‘মানস মইনে বরু, মধুরাম বুল্লি তেরু’ গানের জন্যও জাতীয় পুরস্কার। ভাবা যায়? ভারতের প্রত্যেকটি প্রধান ভাষায় অজস্র গান গেয়েছেন— মানুষের ভাললাগা তো সর্বোচ্চ শিখর ছুঁয়েছে।

‘মানস মইনে বরু’ গানটির কথা একটু বলি। মান্নাদা-সলিল চৌধুরীর যুগলবন্দি। দু’জনের কেউই মালয়ালম ভাষা জানেন না। মান্নাদা গানটি প্র্যাকটিস করছেন। উচ্চারণ শুনে তো ম্যাডাম ও মেয়েদের কী হাসি! ম্যাডাম কেরলের মেয়ে। ঝরঝর করে মালয়ালম বলেন। দায়িত্ব নিলেন মান্নাদাকে সঠিক উচ্চারণ শেখানোর। এই গান তো দক্ষিণ ভারতে জাতীয় সঙ্গীতের মতো মর্যাদা পায়। মান্নাদা ছাড়াও সলিল চৌধুরী সুরকার হিসেবে এই ছবির জন্য জাতীয় পুরস্কার পান।

পঞ্চাশের দশকে সলিল চৌধুরী গঠন করেন ‘বম্বে ইয়ুথ কয়ার।’ এই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দিয়েই তিনি ভারতীয় সঙ্গীতে সেকুলার কয়ার এবং পলিফোনিক কণ্ঠের ব্যবহার শুরু করেন। সঙ্গী হিসেবে পেলেন বন্ধু এবং গীতিকার শৈলেন্দ্রকে। সলিলবাবুর আহ্বানে কে না গাইবেন সেখানে— লতা মঙ্গেশকর, কিশোরকুমার, মুকেশ, রুমা গুহঠাকুরতা, মান্না দে। এই কয়ারে সলিলবাবু তৈরি করেছিলেন— ‘সুনয়নী সুনয়নী’ গানটি। মান্নাদা এবং লতাজীর কণ্ঠে গানটি অসম্ভব জনপ্রিয় হয়।

‘কুয়াশা আঁচল খোলো’ গানের কথা আগে বলেছি। ‘মর্জিনা-আবদুল্লা’ ছবির ‘বাজে গো বীণা’ গানটির কথা ভাবুন। পুরোপুরি রাগপ্রধান গান। সলিলবাবু এমন ভাবে গানটাকে বাঁধলেন, আর মান্নাদা এমন গাইলেন যে সে-গান সব ধরনের মানুষের কাছেই সমান জনপ্রিয় হয়ে উঠল। একেই বলে গায়কী। শাস্ত্রও রইল, সাধারণ-অসাধারণের ভাললাগাও রইল।

বাংলা ছবিতে অনেক পরে প্লে-ব্যাক করেন মান্নাদা। একেবারে প্রথম দিককার ছবি ‘একদিন রাত্রে’। এই ছবিতে একটা অসম্ভব কাণ্ড ঘটে। মাতালের ভূমিকায় ছবি বিশ্বাস তাঁর লিপে গান। মনে পড়ছে না এমন ঘটনা কখনও ঘটেছে কি না। সলিলবাবুর লেখা ও সুর— ‘এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয়।’ গাইলেন সেই মান্না দে। ছবি বিশ্বাস আবার কাকার বন্ধু। গান শুনে ছবিবাবু একদিন ধরলেন মান্নাদাকে— ‘গানটায় কী সব মাতালের আওয়াজ ঢুকিয়েছ?’ মান্নাদা কিছু বললেন না। যখন পিকচারাইজেশন হল, দেখা গেল ছবি বিশ্বাসের ফিজিক্যাল অ্যাক্টিং এবং মান্নাদার সিঙ্গিং-অ্যাক্টিং মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE