Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

নিজেই কাটাকুটি করলেন পমফ্রেট

রেওয়াজ না করলে খাবার হজম হত না মান্না দে-র। ব্লগ লিখছেন দেবপ্রসাদ চক্রবর্তীরেওয়াজ না করলে খাবার হজম হত না মান্না দে-র। ব্লগ লিখছেন দেবপ্রসাদ চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

গত সংখ্যায় মান্নাদার দুর্গাপুজো নিয়ে লিখেছিলাম। একটু সংযোজন করছি। মান্নাদা প্রয়াত হন ২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবর। সে বছর বিজয়া দশমী ছিল ১৪ অক্টোবর।

শিলিগুড়িতে সঙ্গীতানুষ্ঠান। মান্নাদা গাইছেন। বনশ্রী সেনগুপ্তও আছেন। অনুষ্ঠানের শেষে খাওয়া-দাওয়ার পর্ব। মান্নাদার চোখে কিছুই এড়ায় না। বনশ্রীদি সবে গুছিয়ে খেতে বসেছেন। তার থালার দিকে একবার তাকিয়ে মান্নাদা জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘আরে বাবা! কত মাংস খাচ্ছ তুমি?’’ বনশ্রীদি একটু লজ্জা পেয়ে বললেন, ‘‘এই আট পিস হবে।’’ মান্নাদা গম্ভীর। বললেন, ‘‘আমাদের সবারই তো বয়স হচ্ছে। একসঙ্গে এতটা মাংস খাওয়া ঠিক নয়। দু’পিসই যথেষ্ট’’।

আসলে এটা মান্নাদার পরিমিতিবোধ। সে খাওয়ার ক্ষেত্রে হোক, বা গাওয়ার ক্ষেত্রে। এ প্রসঙ্গে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় একটা সুন্দর গল্প (আসলে সত্যি ঘটনা) বলেন। মান্নাদা সাধারণত নিজেই বাজার করতেন। মনের মতো বাজার করতে তাঁর খুব ভাল লাগত। একদিন বাছাই করা পমফ্রেট নিয়ে এলেন। নিজেই কাটাকুটি করলেন। এ মাছ তো যেমন-তেমন ভাবে রান্না করলে চলে না। মশলার পুর বানিয়ে, তা মাছে মাখিয়ে ম্যারিনেট করে রাখলেন। তারপর খাঁটি সর্ষের তেলে সুস্বাদু করে ভাজলেন মাছগুলো। এরপর মান্নাদা কী বলছেন শুনুন। ‘‘ওঃ কী টেস্ট! সেদিন শুধু মাছই খেলাম তৃপ্তি করে। সঙ্গে নাথিং, নো কিচ্ছু।’’

কোনটার সঙ্গে কোনটা চলবে, মান্নাদার থেকে বেশি আর কে বুঝবে! এক এক গানে এক এক মান্নাদা। যখন গাইছেন ‘তুমি অনেক যত্ন করে’, ‘তুমি নিজের মুখে’, ‘আবার হবে তো দেখা’ গানগুলি...সেখানে এক ব্যর্থ প্রেমিকের আর্তনাদ। আবার ‘আমার না-যদি থাকে সুর’, ‘তুমি একজনই শুধু বন্ধু আমার’, ‘আমি তার ঠিকানা রাখিনি’...ইত্যাদি গানে মিষ্টি রোম্যান্টিকতার সুরেলা স্পর্শ। যখন গাইছেন ‘অভিমানে চলে যেও না’, ‘স্বপনে বাজে গো বাঁশি’, ‘রাতজাগা দুটি চোখ’, তখন অনায়াসে ছুঁয়ে যাচ্ছেন সুরের সব দুরূহ শৃঙ্গ। যে-গান যেমনটি চাইছে, তিনি ততটাই দিচ্ছেন। কমও নয়, বেশিও নয়। মান্নাদা মাপটা জানতেন।

উত্তরপাড়ার কার্তিক ঢালি মান্নাদা-পাগল মানুষ। হাজার কাজের মধ্যেও মান্নাদার জন্য তৈরি করতেন নানা রকম বড়ি, যে সব বড়ি খেতে মান্নাদা খুব ভালবাসেন। কলকাতার বাড়িতে কার্তিক বড়ি নিয়ে এসেছেন। মান্নাদার সঙ্গে বড়ি নিয়ে সিরিয়াস আলোচনা চলছে। সে একটা দেখা ও শোনার মতো ব্যাপার। নানা ধরনের নানা সাইজের বড়ির প্যাকেট। মান্নাদা এক-একটা প্যাকেট হাতে নিচ্ছেন আর বলছেন, ‘‘বুঝলে! এই বড় বড়িটা রান্না শেষ হবার পাঁচ মিনিট আগে দিতে হবে...এই ছোট শক্ত বড়িটা একটু আগে দিতে হবে,...বাঃ! এটা তো শুক্তোর বড়ি,... বুঝলে কার্তিক, এই বড়িটা গুঁড়ো করে রান্নার ওপর ছড়িয়ে দিলে বেড়ে টেস্ট হবে...।’’ আলোচনা চলতেই থাকে। কার্তিক গান-পাগল মানুষ। গান বলতে ও বোঝে মান্নাদার গান। অবাক হয়ে দেখতাম, আলোচনাটা এক সময় বড়ি থেকে গানে চলে এসেছে।

গজল ছিল মান্নাদার খুব প্রিয় সাবজেক্ট। শেষ দিকে গজলের একটা অ্যালবাম করেছিলেন। গানগুলো ঠিকমতো প্রেজেন্টেশনের ব্যাপারে মান্নাদা এত সিরিয়াস ছিলেন যে, মুম্বই থেকে ওয়াই এস মুলকিকে নিয়ে এসেছিলেন যন্ত্রসঙ্গীত পরিচালনার জন্য। পরে অবশ্য মান্নাদার আশাভঙ্গ হয়েছিল। মুলকিজির কাছ থেকে প্রত্যাশিত ক্রিয়েশনটা তিনি পাননি। যাই হোক, রেকর্ডিং-এর আগে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুযোগ হল গানগুলো শোনার। তিনি নিজে একজন অতি গুণী সুরকার। মান্নাদা এক একটা গান গেয়ে শোনাচ্ছেন, আর অভিজিৎদার মনে হচ্ছে, এখানে একটু অন্য রকমের সুর হলে ভাল হত। ওখানে একটু অন্য রকম। মান্নাদা বারোটা গানই শোনালেন। এবার অভিজিৎদার ভুল ভাঙল। নতুন করে উপলব্ধি করলেন সঙ্গীত সম্পর্কে মান্নাদার পরিমিতিবোধ। যে-গানে যেটুকু দরকার, সেটুকুই দিয়েছেন। সবক’টি গান শোনার পর মনে হল— সুর, বাণী, চলন, গায়কি মিলেমিশে এমন মূর্ছনা তৈরি করেছে, শ্রবণে যা স্বয়ংসম্পূর্ণ। শুনলে আর কিছু চাইবার বাকি থাকে না।

২০১০ সালে স্ত্রী অসুস্থ হওয়ার পরে মান্নাদা বেঙ্গালুরুর বাইরে আর যেতে পারেননি। ওই সময়েই, যখন তাঁর ৯১ বছর বয়স, সিঙ্গাপুরে তাঁর শেষ অনুষ্ঠান করেছেন। ওই বয়সেও যুবকের মতো টগবগে শরীর তাঁর, রহস্যটা কী? রহস্য হল, যুবক বয়সের শরীর চর্চা, আর সারা জীবনের সংযমী জীবনযাপন। এ কারণে অবশ্য তাঁকে জিমে যেতে হয়নি বা খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়নি। সংযমকে মান্নাদা জীবনের অঙ্গ করে নিয়েছিলেন। প্রতিদিন নিয়ম করে রেওয়াজ করতেন। বলতেন, রেওয়াজ না করলে আমার খাবার হজম হয় না। রেওয়াজের আগে এক গ্লাস গরম জলে লেবু ও মধু মিশিয়ে খেতেন। কোনও দিন তার ব্যতিক্রম হয়নি। অনুষ্ঠান বা রেকর্ডিং-এর দিন কাজ শেষ হওয়ার আগে বিশেষ কিছু খেতেনই না। শুধুমাত্র স্যুপ বা ওই জাতীয় তরল কিছু। কাজ শেষ করে যখন বাড়ি ফিরতেন, তখনই তৃপ্তি করে খেতেন। মুখরোচক ভাজা ছিল মান্নাদার খুব প্রিয়। বেঙ্গালুরু থেকে যখনই কলকাতায় আসতেন, নানারকম স্ন্যাক্স নিয়ে আসতেন। আনতেন তাঁর প্রিয় কাঁচকলা ভাজা। দারুণ খেতে ছিল সেই ভাজা। গানের সিটিঙে বা আড্ডার সময়ে থালা ভর্তি সেই সব স্ন্যাক্স আসত, সঙ্গে চা। সবাই জমিয়ে খেত। লক্ষ করে দেখেছি, মান্নাদা কিন্তু দু’তিন পিস ভাজার বেশি নিতেন না।

মান্নাদার খাওয়া ও গাওয়ার পরিমিতিবোধ নিয়ে লিখতে লিখতে মনে হল, আর একটা বিষয় অবশ্যই বলা উচিত। সেটা হল, তাঁর জীবন ও সংযম কেমন একার্থ হয়ে গিয়েছিল। বেশ কিছুকাল ধরে মান্নাদা ঘরে ফেরার টান অনুভব করছিলেন। মদন ঘোষ লেনের বাড়ি তাঁর প্রাণ। অসম্ভব টান সেই বাড়ির ওপর। ওদিকে কোমরের ব্যথাটা খুব ভোগাচ্ছে। খাঁড়া সিঁড়ি দিয়ে উঠতে কষ্ট হয়। তা ছাড়া যৌথ পরিবারের বাড়ি। বৌদিকে এবং হঠাৎ হঠাৎ আসা আত্মীয়স্বজন নিয়ে ওখানে থাকা বেশ অসুবিধাজনক। মান্নাদার ইচ্ছার কথা গভর্নমেন্টের কানে গেল। তৎকালীন অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে একটা সাক্ষাতের ব্যবস্থা হল। অর্থমন্ত্রী বললেন, ‘‘মান্নাদা, আপনি কলকাতায় বাড়ি করবেন, এ তো আমাদের গর্বের ব্যাপার। আপনাকে আমরা ৮ কাঠা জমি দেব। কিছু ফর্মালিটি আছে। ও নিয়ে আপনি ভাববেন না। আমার অফিসাররা এ নিয়ে আলোচনা করে নেবে।’’ অফিসাররা আরও বিনীত। মান্নাদাকে বলল, ‘‘সরকারি নিয়ম হল কারও যদি ভারতের কোথাও জমি বা বাড়ি থাকে, তাকে আর জমি দেওয়া যায় না। আপনার তো মুম্বইয়ে বাড়ি আছে, আপনি একদিনের জন্য ওই বাড়িটা কাউকে হস্তান্তর করে দিন। সেই দিন আমরা আপনাকে কলকাতায় ৮ কাঠা জমি দিয়ে দেব। পরের দিন আবার মুম্বইয়ের বাড়ি নিজের নামে করে নেবেন।’’ অফিসাররা অভয় দিল, ‘‘মান্নাদা, আপনাকে কিছুই করতে হবে না। আমরাই উকিল দিয়ে যা করার করিয়ে নেব। শুধু আপনার অনুমতি চাই।’’ হয়তো অন্যের কাছে ব্যাপারটা সামান্য, জাস্ট একটা ফর্মালিটি। কিন্তু মানুষটাতো মান্না দে। ভাবলেন, এ তো অসততা। সারা জীবন যার থেকে শতহস্ত দূরে থেকেছেন। অফিসারদের বললেন, ‘‘মাননীয় মন্ত্রীকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাবেন। কিন্তু এ ভাবে আমি জমি নিতে পারব না।’’

মান্নাদা এ রকমই। এ জন্য সারা জীবন মাটিতে পা রেখে, আকাশ দেখতে দেখতে চলতে পেরেছেন।

—ফাইল চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE