Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

রবীন্দ্রনাথ নিয়ে লিখছেন? আমাকে স্যাটিসফাই করা মুশকিল

রবীন্দ্রগানের সূত্র ধরেই সুলোচনা দেবীর সঙ্গে আলাপ, প্রেম বিয়ে। লিখছেন দেবপ্রসাদ চক্রবর্তীমান্নাদার সঙ্গীত জীবনকে বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করেছেন দু’জন কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে, যিনি তাঁকে গড়েপিটে তৈরি করেছিলেন শিল্পী হিসেবে দ্বিতীয় জন পরোক্ষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যাঁর গান মান্না দে-কে ভীষণ ভাবে প্রভাবিত করেছে। খুলে দিয়েছে নতুন নতুন ভাবনার দিগন্ত। শঙ্কর জয়কিষেণ ছিলেন মান্নাদার অত্যন্ত প্রিয় সুরকার। অন্য সুরকারেরা যখন মান্নাদাকে হিন্দি রোমান্টিক গানের জন্য ভাবছেন না এই সুরকার জুটি মান্নাদাকে দিয়ে কত বিখ্যাত রোমান্টিক গান গাইয়েছেন।

শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

মান্নাদার সঙ্গীত জীবনকে বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করেছেন দু’জন কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে, যিনি তাঁকে গড়েপিটে তৈরি করেছিলেন শিল্পী হিসেবে দ্বিতীয় জন পরোক্ষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যাঁর গান মান্না দে-কে ভীষণ ভাবে প্রভাবিত করেছে। খুলে দিয়েছে নতুন নতুন ভাবনার দিগন্ত।
শঙ্কর জয়কিষেণ ছিলেন মান্নাদার অত্যন্ত প্রিয় সুরকার। অন্য সুরকারেরা যখন মান্নাদাকে হিন্দি রোমান্টিক গানের জন্য ভাবছেন না এই সুরকার জুটি মান্নাদাকে দিয়ে কত বিখ্যাত রোমান্টিক গান গাইয়েছেন। দরকার হলে প্রযোজকদের সঙ্গে ঝগড়াও করেছেন। শঙ্কর জয়কিষেণের পঞ্চাশটি ছবিতে সাতাত্তরটি গান গেয়েছেন মান্নাদা—মহম্মদ রফির পরেই (একশো তেইশটি ছবি) কিশোর কুমার ( ৪১টি ছবি) বা মুকেশ ( ৪৮টি)। এর থেকেও তাঁকে বেশি ব্যবহার করেছেন এস-জে।
কী সব গান গেয়েছেন মান্নাদা এই সুরকার জুটির সঙ্গে। ‘লপক ঝপক’ (বুট পলিশ), তু প্যায়ার কা সাগর (সীমা), সুর না সাজে ( বসন্ত বাহার), ঝনক ঝনক তোরি ( মেরে হুজুর) ও ভাই জারা দেখকে চলো (মেরা নাম জোকার) প্যায়ার হুযা ইকরার হুযা ( শ্রী ৪২০), আজা সনম ( চোরি চোরি), ইয়াদ কিয়া দিলনে ( পতিতা)... অসংখ্য গান। মান্নাদার ওপর তাঁরা আস্থা রেখেছিলেন, মান্নাদারও ছিল তাঁদের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতা। কোনও এক প্রসঙ্গে এক দিন শঙ্কর, মান্নাদাকে রবীন্দ্রনাথের গান সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেন। বলেন, ‘‘কেন যে আপনার রবীন্দ্রনাথের গান এত ভাল লাগে বুঝতে পারি না। বড্ড একঘেয়ে।’’ যতই বন্ধু হোক, মান্নাদার মাথা গরম হয়ে গেল। একদিন শঙ্করকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করলেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা শোনালেন রবীন্দ্রনাথের গান। কথার মানে বোঝালেন, দেখালেন তালের বৈচিত্র। রাগ রাগিণীর ব্যবহার, প্রতিটি সুরের মধ্যে বিস্ময়কর সংয়ম। খুব লজ্জা পেয়ে গেলেন শঙ্কর। স্বীকার করতে বাধ্য হলেন এমন সঙ্গীতস্রষ্টা বিরল। রবীন্দ্রনাথকে ‘বাঁচিয়ে’ মান্নাদাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

মান্নাদা মাঝে মাঝে বলতেন রবীন্দ্রনাথের মতো গানের কথা আর দেখলাম না। কী অসাধারণ সব লেখা। সুর ছাড়াও যে কোনও গান আবৃত্তি করা যায়। কোথাও আটকায় না। কী চলন। আহা পড়লেই বুকটা ভরে যায়। বলতে বলতে মান্নাদার অপূর্ব পাঠ ‘সকরুণ বেণু বাজায়ে কে যায়’, কখনও ‘আঁধার রাতে একলা পাগল যায় কেঁদে’। সবই স্মৃতি থেকে বলতেন। একদিন মৃদু কণ্ঠে বলার চেষ্টা করলাম, ‘আপনার গানের প্রতিটি কথা অসাধারণ’। মান্নাদা সঙ্গে সঙ্গে বললেন ‘‘ ও ইয়েস কথার মধ্যে সং ভ্যালু না থাকলে আমি সে গান গাইবই না। তবে রবীন্দ্রনাথ সবার ওপরে। আমি আর সুলু তো প্রায়ই গীতাঞ্জলি খুলে গান করি। অনেক সময় বইও দেখতে হয় না। গানগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আমি মনে মনে কল্পনা করে নিতাম নিঃসঙ্গ বেঙ্গালুরু, ‘যখন থাকে শুধু অন্ধকার’ মুখোমুখি বসিবার মান্নাদা পড়ছেন— ‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ’। বৌদির চোখে জল। রবীন্দ্রনাথের প্রতি মান্নাদার অন্য এক ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা। রবীন্দ্রনাথের গানের সূত্র ধরেই সুলোচনা দেবীর সঙ্গে আলাপ, প্রেম বিয়ে। জীবনটা একেবারে বদলে যাওয়া।

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় মান্না দে-কে সাম্মানিক ডিলিট উপাধি দিতে চায়। যথারীতি মান্নাদার তীব্র আপত্তি। বারবার বলছেন, ‘‘ আমাকে কেন?’’ কত যোগ্য মানুষ রয়েছেন। আমি তো সামান্য গান করি। উপাচার্য ডা. করুণাসিন্ধু দাস মান্নাদার খুবই গুণগ্রাহী। বিশ্ববিদ্যালয়ের পিআরও সুরঞ্জনাকে পাঠালেন মান্নাদার কাছে। যে করে হোক রাজি করাতে হবে। সুরঞ্জনা তখন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একটা বড় মাপের কাজ করছেন। অল্প সময়ের মধ্যে জমে গেল আড্ডা। বিষয় রবীন্দ্রনাথ। এবং রবীন্দ্রনাথ। এক সময় মান্নাদা বললেন—‘‘ বাঃ আপনার তো রবীন্দ্রনাথের বিষয়ে দারুণ জ্ঞান।’’ সুরঞ্জনা মান্নাদার কাছে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে জানতে চাইলে একেবারে বদলে গিয়ে মান্নাদা ফোনে বললেন, ‘‘আপনারা যখন ঠিক করেছেন, রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আমায় বলতে হবে, আমি না বলি কী করে? আপনারা যে আমার কথা ভেবেছেন সে জন্য আমি কৃতজ্ঞ।’’

মান্নাদার জন্য বাংলার মনীষীদের নিয়ে বারোটি গান লিখেছিলাম। গানগুলো পড়ে মান্নাদা এগারোটা গান অ্যাপ্রুভ করে দিলেন সঙ্গে সঙ্গে। আটকে গেলাম রবীন্দ্রনাথে। আমাকে বললেন, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গানটি আবার লিখতে। বললেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথ নিয়ে লিখছেন। আমাকে স্যাটিসফাই করা খুব মুস্কিল। আপনার অসুবিধেও বুঝতে পারছি। এত বিশাল তাঁর কর্মকাণ্ড, দশ-বারো লাইনের মধ্যে তাঁকে ধরবেন কী করে? তবু চেষ্টা তো করতে হবে। ভেবেচিন্তে লিখুন।’’ বুঝলাম রবীন্দ্রনাথ নিয়ে মান্নাদা কোনও আপসের মধ্যে নেই।

স্ত্রীর সঙ্গে গানের আড্ডায়।

দুঃখের কথা এই যে এত ভালবাসতেন রবীন্দ্রনাথের গান, কিন্তু সে গান খুব বেশি রেকর্ড করে যেতে পারেননি। প্রশ্ন করলে একটু অন্য ভাবে উত্তর দিতেন। কিছু বিখ্যাত শিল্পীর নাম করে বলতেন, ‘‘রবীন্দ্রসঙ্গীত ওরা এত ভাল গায়। সেখানে আমি আর কী গাইব!’’ অনেকের ধারণা বিভিন্ন যে বাধানিষেধ, অনুশাসন ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করার জন্য, মান্নাদার মতো শিল্পীদের সে ভাবে গান গাওয়া খুবই অসুবিধের ছিল। রবীন্দ্রনাথের গানের টিপিক্যাল গায়কিও মান্নাদার একদম পছন্দ ছিল না। বলতেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে গেলে অনেকে কেমন ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে গান করেন। মনে হয় দুঃখের। রবীন্দ্রনাথ কখনও এমন ভাবে গাইতে বলেননি।’’ দেখা যায় রবীন্দ্রনাথের ওপর কপিরাইট উঠে যাওয়ার পরে মান্নাদা বেশ কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করেছিলেন হিন্দিতে। তবে এ কথা বলতে হবে যে’কটি গান মান্নাদা গেয়েছেন, তার তুলনা নেই। ‘মেঘ ও রৌদ্র’ ছবিতে মান্নাদার গাওয়া ‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়,’ কে ভুলতে পারে? অমন ফিলোজফিক্যাল কথা, এত স্পর্শ সুর, মান্নাদা গানটিকে অন্য স্তরে পৌঁছে দিয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মান্নাদার জীবনের অনেক মিল। জীবনে দু’জনেই প্রচুর আঘাত পেয়েছেন। ১০-১২ বছর ধরে রমাদি (মান্নাদার বড় মেয়ে সুরমা) দুরারোগ্য ক্যানসারে ভুগছেন। সব সময় মান্নাদা ভয়ে থাকতেন। এই বুঝি কোনও খারাপ খবর আসে। প্রতি মুহূর্তে প্রিয় সন্তানের যন্ত্রণা মান্না দে-কে কুরেকুরে খেয়েছে। বলতেন সুলোচনার কিছু হলে আমি বাঁচব না। হলও তাই। বৌদি গেলেন ২০১১-র ১৮ জানুয়ারি। মান্নাদা ২০১৩-র ২৪ অক্টোবর। বৌদি চলে যাওয়ার পর খুবই ভেঙে পড়েছিলেন। কিন্তু গান ছাড়েননি। গান ছাড়া মান্নাদার সঙ্গী ছিল রবীন্দ্রনাথ। মান্নাদার শুভানুধ্যায়ীরা পাঠাতেন মৃত্যুচেতনার ওপর রবীন্দ্রনাথের লেখা অনেক বই। অধীর আগ্রহে সে সব বই পড়তেন মান্নাদা।

জীবনের গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ তাঁর চেতনায় জাগ্রত ছিলেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE