Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

অন্যরা পিছোলেও এগিয়ে তৃণমূল

ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে ২০১৪ সালের আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম স্থান দখল করতে চলেছেন। এবিপি আনন্দ-এসি নিয়েলসেনের সমীক্ষা থেকে এই তথ্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গোটা দেশে ভোট ফলাফলে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে এনডিএ সবথেকে বেশি এগিয়ে। রাহুল গাঁধীর নেতৃত্বে ইউপিএ দ্বিতীয় স্থানে।

জয়ন্ত ঘোষাল
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০১৪ ০৪:০৯
Share: Save:

ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে ২০১৪ সালের আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম স্থান দখল করতে চলেছেন। এবিপি আনন্দ-এসি নিয়েলসেনের সমীক্ষা থেকে এই তথ্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

গোটা দেশে ভোট ফলাফলে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে এনডিএ সবথেকে বেশি এগিয়ে। রাহুল গাঁধীর নেতৃত্বে ইউপিএ দ্বিতীয় স্থানে। কিন্তু এই দুই বৃহৎ সর্বভারতীয় দলের পর দেশের সমস্ত আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের আসন সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। মার্চ মাসের সমীক্ষা অনুযায়ী এই সংখ্যা দাড়িয়েছে ২৮।

আর এই সমীক্ষার পরেই ফের জাতীয় রাজনীতিতে আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে মমতার দল। লোকসভা নির্বাচনের অঙ্ক কষতে গিয়ে কিছু দিন ধরেই অনেকে বলছিলেন, এ বারের লোকসভা নির্বাচনে বড় ভূমিকা নিতে চলেছেন তিন মহিলা। আম্মা, বহেনজি এবং দিদি। কিন্তু ‘আম্মা’ জয়ললিতা এবং ‘বহেনজি’ মায়াবতীকে পিছনে ফেলে ‘দিদি’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভাবে আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে এক নম্বরে উঠে আসছেন, তাতে তাঁকে নিয়ে শুধু কংগ্রেস বা বাম মহলে নয়, আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে বিজেপির অন্দরেও। গত লোকসভা নির্বাচনে মমতার দলের প্রাপ্ত আসন সংখ্যা ছিল ১৯। এবিপি আনন্দ-এসি নিয়েলসেনের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসের সমীক্ষা অনুযায়ী তৃণমূলের সম্ভাব্য আসনপ্রাপ্তির হিসেব ছিল যথাক্রমে ২৬ ও ২৯। এ বারের সমীক্ষা সম্পর্কে বলতে গিয়ে তৃণমূল নেতা মুকুল রায়ের মন্তব্য, “সমীক্ষার তুলনায় আসন সংখ্যা আরও বাড়বে।”

তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হল, গত দু’টি সমীক্ষার নিরিখে ‘বহেনজি’ মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টির আসন সংখ্যা কিছুটা বাড়তে পারে বলে মার্চ মাসের প্রকাশিত ফলাফলে জানিয়েছে এবিপি নিউজ-এসি নিয়েলসেন। মায়াবতীর দলের আসন সংখ্যা বেড়ে ১৮ হতে পারে বলে জানিয়েছে তারা। এর কারণও রয়েছে। উত্তরপ্রদেশে শাসক দল সমাজবাদী পার্টির বিরুদ্ধে জনমত ক্রমশ প্রবল হচ্ছে। মাত্র দেড় বছরের মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ সিংহ যাদবের সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ চরমে উঠেছে। এই ক্ষোভকে মূলধন করেই ভোট বাড়ছে বিএসপি-র। গত কয়েক বছর ধরে দলিত ভোটের পাশাপাশি উচ্চবর্ণের ভোটও নিজের ঝুলিতে ভরার কৌশল নিয়েছিলেন মায়াবতী। এ বারে অখিলেশ-মুলায়মের মুসলিম ভোটব্যাঙ্কেও থাবা মারতে উদ্যত হয়েছেন তিনি। আর সেই কৌশল সফল হলেই মায়াবতীর আসন সংখ্যা বাড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে আসন সংখ্যার নিরিখে দ্বিতীয় স্থানে থাকার কথা তামিলনাড়ুর জয়ললিতার দলের। এবিপি নিউজ-এসি নিয়েলসেনের সমীক্ষা অনুযায়ী, রাজ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী করুণানিধির ডিএমকে-র তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে এডিএমকে। এই রাজ্যে কংগ্রেস বা অন্য দলগুলির শক্তি অনেকটাই কম। তামিল আবেগে ভর করে ১৯৬৭ সালে কংগ্রেসকে হারিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিল ডিএমকে। তার পর থেকে তামিলনাড়ুর রাজনীতিতে কংগ্রেস তার হারানো জমি ফিরে পায়নি। ১৯৭২ ডিএমকে ভেঙে জন্ম হয় আণ্ণা-ডিএমকে-র। যা বর্তমানের এডিএমকে। এ বারের ভোটে জয়ললিতার দল ভাল করলেও তাদের আসন সংখ্যা ২১-র বেশি হবে না বলে জানিয়েছে সমীক্ষা। সেখানে ডিএমকে পেতে পারে ১০টি আসন।


সবিস্তারে...

মমতা, জয়ললিতা এবং মায়াবতীর দল বাদ দিলে অন্য আঞ্চলিক দলগুলির ফল কিন্তু এ বারের ভোটে তেমন ভাল হবে না বলেই সমীক্ষায় জানা গিয়েছে। যেমন অন্ধ্রপ্রদেশে তেলুগু দেশম। স্থানীয় আবেগকে পুঁজি করেই ১৯৮০-র দশকে জন্ম হয় দলটির। অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকারের জোটসঙ্গী চন্দ্রবাবু নায়ডু আর্থিক সংস্কারের হাওয়া তুলে অন্ধ্রপ্রদেশের আইকন হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তা তিনি ধরে রাখতে পারেননি। বরং কৃষক মৃত্যু থেকে তেলঙ্গানা ক্রমশ শক্তি খুইয়েছেন তিনি। ছেড়েছেন বিজেপি-সঙ্গ। সংখ্যালঘু ভোট হারানোর আশঙ্কায় এ বারেও তিনি বিজেপির হাত ধরবেন না বলে ঘোষণা করেছেন। কিন্তু তাতেও তাঁর দলের ফল খুব ভাল হবে না বলেই ইঙ্গিত মিলেছে। চন্দ্রবাবুর দল খারাপ ফল করলেও অন্ধ্রপ্রদেশের কংগ্রেস নেতা তথা প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী রাজশেখর রেড্ডির ছেলে জগন্মোহনের দল ওয়াইএসআর কংগ্রেস কিন্তু তাদের প্রথম লোকসভা নির্বাচনেই ১৭টি আসন পেতে পারে বলে সমীক্ষায় জানিয়েছে এবিপি নিউজ-এসি নিয়েলসেনের সমীক্ষা।

রাজ্য রাজনীতিতে যুযুধান চন্দ্রবাবু এবং জগন্মোহন দু’জনেই বিজেপির সঙ্গে যাবেন না বলে ঘোষণা করলেও বিজেপির এখনও আশা, দু’জনেরই সমর্থন মিলবে। উত্তরপ্রদেশে যুযুধান হলেও মায়াবতী এবং মুলায়ম যেমন ইউপিএ সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন করেছিলেন, অন্ধ্রের দুই নেতাও তেমনই করবেন বলে আশা গেরুয়া শিবিরের।

শক্তি কমতে পারে বিহারে জেডিইউয়ের নীতীশ কুমারেরও। সমীক্ষায় প্রকাশ, বিজেপি-সঙ্গ ছাড়ার পরে নীতীশের জনপ্রিয়তার ভাটার টান। যার ফলে তাঁর দলের আসন গত বারের ২০ থেকে কমে ৬ হতে পারে। এই অবস্থায় নীতীশ ফের তাদের দিকে আসবেন বলে বিজেপি আশা করলেও নীতীশের পক্ষে সরাসরি নরেন্দ্র মোদীকে সমর্থন করা কঠিন। মহারাষ্ট্রে শিবসেনার গত বারের আসন সংখ্যা ছিল ১১। এ বার তা বেড়ে হতে পারে ১২। অন্য দিকে পঞ্জাবে অকালি দল গত বারের ৪টি আসনের থেকে একটি বেশি পেতে পারে। মাত্র দেড় বছর আগে জন্ম নেওয়া অরবিন্দ কেজরীবালের আম আদমি পার্টি লোকসভায় চারটি আসন পেতে পারে বলে সমীক্ষায় জানা গিয়েছে।

আঞ্চলিক দলগুলির নেতাদের মধ্যে অন্যতম চিত্তাকর্ষক চরিত্র ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক। তিনি কংগ্রেস এবং বিজেপি কোনও দিকেই যাবেন না বলে জানিয়েছেন। এ বারের নির্বাচনে তাঁর দল বিজেডি ১৭টি আসন পেতে পারে বলে সমীক্ষায় জানানো হয়েছে।

এবিপি নিউজ-এসি নিয়েলসেনের সমীক্ষা থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট, আঞ্চলিক দলগুলির আসন সংখ্যা যতটা বাড়বে বলে দু’মাস আগেও মনে করা হয়েছিল, ততটা বাড়ছে না। তবে তারা বহু ক্ষেত্রেই জাতীয় দলগুলির মাথাব্যথা হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে বিজেপিকে ঠেকাতে কংগ্রেস জয়ললিতার সঙ্গে দূত মারফৎ যোগাযোগ রাখছে। জয়ললিতাকে প্রধানমন্ত্রী করে বাইরে থেকে সমর্থন দেওয়ার কথাও ভাবা হচ্ছে। তবে কংগ্রেস একক ভাবে একশোর বেশি আসন পেলে তবেই এমন সম্ভাবনা গতি পাবে। কংগ্রেস নেতারাই বলছেন, সমীক্ষা অনুযায়ী যদি দল ৯১টি আসন পায় এবং বিজেপি ২০৯টি আসন পায়, তা হলে এই কৌশল বাস্তবায়িত করা কঠিন হয়ে যাবে।

বিজেপিকে ঠেকাতে জয়ললিতার মতোই আলোচনা চলছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়েও। রাজ্য-রাজনীতিতে যতই বিরোধ থাক, মমতার সঙ্গে জাতীয় স্তরে যোগসূত্র রাখতে চাইছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। মমতার জন্য দরজা সম্পূর্ণ বন্ধ করতে নারাজ তাঁরা। মমতার পাশাপাশি বামেদের সঙ্গেও সুসম্পর্ক রাখতে চাইছে কংগ্রেস। বাম দলগুলিকে বার্তা দিয়ে কংগ্রেস নেতা এ কে অ্যান্টনির বক্তব্য, যারা এই মুহূর্তে কংগ্রেসের সঙ্গে আসতে দ্বিধাবোধ করছে, তারা বিজেপিকে ঠেকাতে ভোটের পর নতুন করে চিন্তাভাবনা করতেই পারে।

আসরে নেমে পড়েছে বিজেপিও। জয়ললিতা, মমতাকে টানতে তারাও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও বিজেপি নেতৃত্ব ভালই জানেন, রাজ্যে সংখ্যালঘু ভোটের কথা মাথায় রেখে মমতা কিছুতেই মোদীর সরকারকে সমর্থন করতে পারবেন না। কারণ দু’বছর বাদে রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। এই অবস্থায় বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে নিজেদের আসন বাড়াতে মরিয়া। ঘটনা হল, বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে তাদের শতকরা ভোট কিছুটা বাড়াতে পারলেও তৃণমূলের ভোট কতটা কাটতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে তাদের দলেই! তাই বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রাপ্ত আসন সংখ্যা বাড়াতে সক্রিয় হলেও এসি নিয়েলসেনের সমীক্ষায় তারা মাত্র একটি আসন পেতে পারে বলে জানানো হয়েছে।

আর একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হল, পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের আসন সংখ্যা হ্রাস। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে সিপিএম শিবিরে। ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএমের শতকরা ভোট ছিল ১৮.২৭। দল আসন পায় ৪৪টি। এর পর সিপিএমের আসন ও শতকরা ভোট ক্রমশ বাড়তে থাকে। ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখলের পরে ৩৪ বছর টানা তারা ক্ষমতায় থেকে ২০১১ সালে মমতা-ঝড়ে বিদায় নেয়। সেই ধাক্কা তারা এখনও সামলে উঠতে পারেনি। সিপিএমের রক্তক্ষরণ এ বারের লোকসভা ভোটেও অব্যাহত থাকবে বলে সমীক্ষাতে স্পষ্ট হয়েছে। সিপিএমের এক শীর্ষ নেতার মতে, “কিছু কিছু ক্ষেত্রে তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে বিশেষত শহরে, একটা মোহভঙ্গের প্রক্রিয়া শুরু হলেও ৩৪ বছরের শাসনের জন্য বামেদের বিরুদ্ধে যে ঘৃণা ও ক্ষত মানুষের মনের ভিতরে জন্মেছে, তা উপশমে ব্যর্থ দল।”

ভারতের রাজনীতিতে আঞ্চলিক দলগুলির ভূমিকা এখন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। যদিও এই দলগুলি হয় কংগ্রেস অথবা বিজেপির ছাতার তলায় থাকতেই অভ্যস্ত। পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম দুর্বল হওয়ায় জাতীয় স্তরে প্রকাশ কারাটের তৃতীয় ফ্রন্ট গঠন এখন মরীচিকা মাত্র। সফল হয়নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফেডেরাল ফ্রন্ট গঠনের প্রয়াসও। অণ্ণা হজারের সঙ্গ ছেড়ে তিনি ফের নিজের রাজ্যে মনোনিবেশ করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও অঙ্কের হিসেবে তৃতীয় বৃহত্তম দল হয়ে উঠতে পারলে তিনি যে নির্ণায়ক ভূমিকা নিতে পারেন, তা বিলক্ষণ জানেন মমতা নিজেও। যদিও তাঁর নিজের কথায়, “এখন সবটাই পোস্টপেড। প্রিপেড নয়।” ইঙ্গিত স্পষ্ট, সব বোঝাপড়া ভোটের পরে।

প্রি হোক বা পোস্ট, আপাতত ভোট সমীক্ষায় দেশের সব আঞ্চলিক দলের মধ্যে সবার আগে মমতাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

jayanta ghosal tmc mamata loksabha election
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE