Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

খরচে রাশ টেনে মাটিতে পা, রেলের ভরসা বিদেশি লগ্নিও

ভোট-বাক্সকে মোক্ষ ঠাউরে দীর্ঘ দিন ভর্তুকির স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা রেলকে ধাক্কা দিলেন সদানন্দ গৌড়া। নরেন্দ্র মোদীর কর্নাটকি রেলমন্ত্রীর প্রথম বাজেটে বার্তা স্পষ্ট। তা হল, শুধু আমজনতার মন জয়ের ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার হতে গিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে রেলের। এক টাকা রোজগার করতে গিয়ে খরচ হচ্ছে প্রায় ৯৪ পয়সা। তাই এই অবস্থায় শুধু গুচ্ছ গুচ্ছ নতুন ট্রেন, স্টেশন আর প্রকল্প ঘোষণার রাস্তা থেকে সরে এসে আপাতত রেলের আর্থিক হাল ফেরানোয় মন দিচ্ছে মোদী-সরকার।

বাজেট পেশ করতে সংসদে রেলমন্ত্রী। মঙ্গলবার। ছবি: পিটিআই।

বাজেট পেশ করতে সংসদে রেলমন্ত্রী। মঙ্গলবার। ছবি: পিটিআই।

অনমিত্র সেনগুপ্ত
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৪ ০৪:০৮
Share: Save:

ভোট-বাক্সকে মোক্ষ ঠাউরে দীর্ঘ দিন ভর্তুকির স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা রেলকে ধাক্কা দিলেন সদানন্দ গৌড়া। নরেন্দ্র মোদীর কর্নাটকি রেলমন্ত্রীর প্রথম বাজেটে বার্তা স্পষ্ট। তা হল, শুধু আমজনতার মন জয়ের ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার হতে গিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে রেলের। এক টাকা রোজগার করতে গিয়ে খরচ হচ্ছে প্রায় ৯৪ পয়সা। তাই এই অবস্থায় শুধু গুচ্ছ গুচ্ছ নতুন ট্রেন, স্টেশন আর প্রকল্প ঘোষণার রাস্তা থেকে সরে এসে আপাতত রেলের আর্থিক হাল ফেরানোয় মন দিচ্ছে মোদী-সরকার। জোর দিচ্ছে আগে জরুরি পুরনো প্রকল্প শেষ করার উপর। টাকা জোগাড়ের জন্য আস্থা রাখছে বিদেশি বিনিয়োগ আর বেসরকারি পুঁজিতে।

খরচে রাশ টানার কথা বলেও বুলেট এবং দ্রুত গতির (হাইস্পিড) ট্রেন চালানোর কথা বলা হয়েছে এ বারের বাজেটে। যার জন্য প্রয়োজন বিপুল অঙ্কের লগ্নি। কিন্তু সেই টাকা জোগাড় যে মাত্র ৬০০ কোটি উদ্বৃত্ত হাতে থাকা রেলের পক্ষে সম্ভব নয়, তা কবুল করেছেন গৌড়া। এবং এ ক্ষেত্রে বিদেশি ও বেসরকারি লগ্নির উপর ভরসা রাখছেন তিনি। অর্থাৎ, অটলবিহারী বাজপেয়ীর সোনালি চতুর্ভুজের মতো এ বার রেলপথেও দেশের চার প্রান্তকে জুড়তে মোদী আগ্রহী ঠিকই। কিন্তু তার জন্য বেসরকারি ক্ষেত্রই টাকা জোগাবে বলে আশা করছে তাঁর সরকার।

দীর্ঘ দিন ধরেই রেল বাজেটকে হাতিয়ার করে একের পর এক জনমোহিনী ঘোষণা করে গিয়েছেন বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের রেলমন্ত্রীরা। যে কারণে অনেকেই মজার ছলে বলতেন, রেল মন্ত্রক আদপে মুখ্যমন্ত্রিত্বের রাস্তা। ভোট-বাক্স ভরার তাগিদে যথেচ্ছ নতুন ট্রেন, স্টেশন, প্রকল্পের ঘোষণা করে গিয়েছেন তাঁরা। গৌড়ার অভিযোগ, ওই সব প্রকল্পের অধিকাংশই না বাণিজ্যিক ভাবে সফল, না সামাজিক উন্নয়নের অংশীদার। ফলে লোকসানের বোঝা ক্রমশ পাহাড় হয়েছে। গতি হারিয়েছে রেল। শিকেয় উঠেছে পরিষেবা। চুলোয় গিয়েছে যাত্রী-সুরক্ষাও।

সংসদে রেল বাজেট শুনছেন মোদী। মঙ্গলবার। ছবি: পিটিআই।

আর সে কথা মাথায় রেখেই এ দিন মাত্র ৫৮টি নতুন ট্রেন ঘোষণা করেছেন গৌড়া। নয়া প্রকল্পের সংখ্যাও হাতে গোনা। বরং জোর দেওয়া হয়েছে যাত্রী সুরক্ষায়। পাখির চোখ করা হয়েছে উন্নততর পরিষেবাকে। শুধু পরিচ্ছন্নতাতেই বরাদ্দ বেড়েছে ৪০%।

সদ্য ভাড়া বেড়েছে রেলের। আগামী দিনেও যে তা নিয়মিত পর্যালোচনা করা হবে, তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে এ বারের বাজেটে। বলা হয়েছে, টিকিটের দাম আগামী দিনে ওঠা-নামা করবে জ্বালানির দরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। ফলে এই পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষ যে আরও নিরাপত্তা আর উন্নত পরিষেবা দাবি করবেন, তা বিলক্ষণ বুঝেছেন গৌড়া। আর সেই কারণেই ই-টিকিট কাটার ব্যবস্থা ঢেলে সাজার কথা বলেছেন। তুলে এনেছেন মোবাইল মারফত একগুচ্ছ পরিষেবার কথা। লাইনে ফাটল খুঁজতে হাত ধরতে চেয়েছেন আধুনিক প্রযুক্তির। আশ্বাস দিয়েছেন, আগামী দিনে লোকাল ট্রেন ছাড়ার আগেও তার দরজা বন্ধ হবে আপনিই। বিরোধীদের অবশ্য দাবি, এই সব পরিকল্পনা আগেই ছিল। বরং নিজস্ব চিন্তার কোনও অভিনবত্ব না-দেখিয়ে শুধু বেসরকারি ও বিদেশি লগ্নির মুখ চেয়ে বসে রয়েছে রেল।

অনেকে অবশ্য বলছেন, মোদীর আপনিই। বিরোধীদের অবশ্য দাবি, এই সব পরিকল্পনা আগেই ছিল। বরং নিজস্ব চিন্তার অভিনবত্ব না-দেখিয়ে শুধু বেসরকারি আর বিদেশি লগ্নির মুখ চেয়ে বসে রয়েছে রেল।

অনেকে অবশ্য বলছেন, মোদীর প্রতিশ্রুতিই ছিল কম সরকারি হস্তক্ষেপ কিন্তু দক্ষ প্রশাসন। রেল বাজেটে ঠিক সেটাই প্রতিফলিত হয়েছে। গৌড়া বুঝিয়েছেন, রেল শুধু ট্রেন চালাবে। আর পরিকাঠামো থেকে পরিষেবা বাকি সর্বত্র তারা বেসরকারি ক্ষেত্রের হাত ধরতে রাজি। গৌড়া এ দিন বুঝিয়ে দিয়েছেন, ভাল পরিষেবা পেতে হলে গাঁটের কড়ি খরচ করতে হবে যাত্রীকে।

রেল মন্ত্রকের দাবি, এ ছাড়া আর রাস্তা ছিল না। সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে ২০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে রেলকে। প্রতি কিলোমিটারে যাত্রিভাড়ায় তার পরিমাণ ২৩ পয়সা। ওই ঘাটতি মেটাতে যাত্রিভাড়া আর পণ্য মাসুল যথাক্রমে ৪৭% ও ২১% বাড়ানো জরুরি। কিন্তু এক লাফে ওই পরিমাণ ভাড়া বাড়ানো রাজনৈতিক আত্মহত্যার সামিল। তাই ধাপে ধাপে পরিস্থিতি শোধরানোর দিকে নজর দিচ্ছে তারা।

মন্ত্রকের মতে, ভাড়ায় ভর্তুকিই একমাত্র সমস্যা নয়। বিভিন্ন অলাভজনক ‘জনমুখী’ প্রকল্প রূপায়িত করতে গিয়েও দেনার পাহাড় চেপে বসেছে ঘাড়ে। গত তিন দশকে মোট ৬৭৪টি প্রকল্প ঘোষণা হয়েছে। অর্থমূল্য ১,৫৭, ৮৮৩ কোটি টাকা। অথচ তার মধ্যে শেষ হয়েছে মাত্র ৩১৭টি। গৌড়ার কথায়, “শুধু বকেয়া প্রকল্প শেষ করতেই দরকার পাঁচ লক্ষ কোটি টাকা।” রেলকে বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রেও এ বার যথেষ্ট রক্ষণশীল মনোভাব দেখিয়েছেন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। গত অন্তর্বর্তী বাজেটের তুলনায় তা বেড়েছে মাত্র ১০০ কোটি টাকা। আর সেই কারণেই আর্থিক ভাবে হাঁসফাঁস রেলকে ভর্তুকি-রাজ থেকে বার করে সংস্কারমুখী করতে চেয়েছেন মোদীর রেল-সেনাপতি গৌড়া। মোদীর দাবি, “শুধু রেলের নয়, সারা দেশের অভিমুখ ঠিক করে দেবে এই বাজেট।”

টাকার অভাবে রেলের উন্নতি বা আধুনিকীকরণ যাতে থমকে না যায়, সে জন্য বিদেশি বিনিয়োগ এবং সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের উপর ভরসা রেখেছেন গৌড়া। রেলে বিদেশি বিনিয়োগ টানতে বাণিজ্য মন্ত্রকের কাছে নিয়ম শিথিলের আবেদনও জানানো হয়েছে। আর রেলের ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ নতুন নয়। এর আগে জাফর শরিফ রেলমন্ত্রী থাকাকালীন রেলের জমি বেসরকারি সংস্থাকে লিজ দিয়ে আয় বাড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। পরিকাঠামো উন্নয়নে পিপিপি মডেলের উপর জোর দিয়েছিলেন লালুপ্রসাদ এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। কিন্তু তার কোনওটিই সে ভাবে সাফল্যের মুখ দেখেনি। তাই সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে গৌড়ার বক্তব্য, “সব দিক খতিয়ে দেখে তবেই মডেল বানাতে হবে।”

এক নজরে রেল বাজেট

সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

তবে পরিষেবার বিভিন্ন ক্ষেত্রে কেন্দ্র পিপিপি-মডেলকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে, তা এ দিনের বাজেট থেকেই স্পষ্ট। ব্র্যান্ডেড খাবার সরবরাহ, খাবারের মান যাচাই, স্টেশন ও ট্রেনের সাফাই থেকে শুরু করে লজিস্টিক পার্ক গঠনের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেসরকারি লগ্নিকে স্বাগত জানানো হয়েছে। যার তীব্র বিরোধিতা করেছে কংগ্রেস, তৃণমূল, সিপিএম-সহ সব বিরোধী শিবির। কংগ্রেস কর্মীরা ঘেরাও করেছেন খোদ রেলমন্ত্রীর গাড়ি। ভাঙচুর হয়েছে গৌড়ার বাড়ির দরজায়। অভিযোগ, কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে রেল নিজেই পরিষেবা উন্নত করতে পারত। তা না-করে পুরো রেলব্যবস্থাই বেসরকারি হাতে তুলে দিতে চায় মোদী-সরকার।

মন্ত্রকের অবশ্য দাবি, ভাঁড়ারের যা হাল, তাতে এ ছাড়া উপায় ছিল না। এক রেল কর্তার বক্তব্য, বাজেটের আগে ভাড়া বাড়ানোয় যে আট হাজার কোটি টাকা বাড়তি আসবে, তার বেশির ভাগটাই চলে যাবে ডিজেলের দাম খাতে বাড়তি খরচ মেটাতে। টাকার অভাবে বহু ক্ষেত্রে নতুন লাইন পাতা, ডাবলিং ও গেজ পরিবর্তনের কাজ কাঁটছাঁট করতে হয়েছে বলেও স্বীকার করছে মন্ত্রক।

অপারেটিং রেশিও (প্রতি একশো টাকা আয় করতে রেলকে যা খরচ করতে হয়) ৯৩.৫ শতাংশে ঠেকায় গৌড়া বলছেন, “এক টাকায় মাত্র ছ’পয়সা হাতে থাকছে রেলের। ফলে পরিকাঠামো খাতে ঢালার মতো অর্থ এখন রেলের নেই।”

বাজেটে ন’টি রুটে হাইস্পিড ট্রেন চালানোর জন্য সমীক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন রেলমন্ত্রী। বরাদ্দ করা হয়েছে একশো কোটি টাকা। এ ছাড়া মুম্বই ও আমদাবাদের মধ্যে বুলেট ট্রেন চালানোর পরিকল্পনাও ঘোষণা করা হয়েছে। তবে তার জন্য কোনও অর্থ বরাদ্দ করা হয়নি। রেল মন্ত্রকের বক্তব্য, বুলেট ট্রেন প্রকল্প পুরোটাই তৈরি হবে বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে। বেসরকারি বিনিয়োগ আহ্বান করা হয়েছে রেলের মাধ্যমে পর্যটন বিকাশেও। একাধিক ধর্মীয় ‘সার্কিট’ চিহ্নিত করে বাণিজ্যিক ভাবে ট্রেন চালানোর প্রস্তাব রাখা হয়েছে পর্যটন সংস্থাগুলির সামনে। খুলে দেওয়া হয়েছে পুরো কামরা এমনকী গোটা ট্রেন রিজার্ভ করার সুযোগ। পছন্দের কামরা এবং সিট বেছে নেওয়ার সুযোগ আনার কথাও বলা হয়েছে।

রেলের নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতা নিয়ে প্রশ্ন দীর্ঘ দিনের। সে কথা মাথায় রেখেই যাত্রী সুরক্ষায় ১৭ হাজার রেল পুলিশ নিয়োগের আশ্বাস দিয়েছেন গৌড়া। যার মধ্যে চার হাজার মহিলা পুলিশ। যাঁরা মূলত মহিলা যাত্রীদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবেন। স্টেশনগুলির নিরাপত্তা পোক্ত করতে সীমানা-প্রাচীর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রক। তবে বেসরকারি উদ্যোগে। ৫০টি স্টেশন সাফসুতরো রাখার দায়িত্বও বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরিস্রুত পানীয় জল দেওয়ার জন্য কর্পোরেটের পাশাপাশি এগিয়ে আসতে বলা হয়েছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও দাতব্য সংস্থাকে।

প্রত্যাশিত ভাবেই এই বাজেটকে স্বাগত জানিয়েছে শিল্পমহল। রাজ্যের বঞ্চনার অভিযোগ তুলে তৃণমূল যত তীব্র ভাবে বাজেটকে আক্রমণ করেছে, ঠিক ততটাই প্রশংসা করেছে শিল্পমহল। রেল বাজেটের দিনে শেয়ার বাজার প্রায় ৫১৮ পয়েন্ট পড়েছে ঠিকই। কিন্তু মূলত লগ্নিকারীদের লাভের কড়ি ঘরে তোলার তাগিদেই তা হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের দাবি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sadanand gowda rail budget anamitra sengupta
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE