Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
নিজস্বীর হুড়োহুড়িতে তিনি, খোলামেলা মোদী অধরাই

ছক ভাঙার বার্তা দিয়েও আপন পথে

হাত বাড়ালেন। কিন্তু ধরলেন কী? প্রশ্নটা তুলে দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেই! গত কালই তিনি আলোচনার দরজা খুলে দিয়েছেন বিরোধীদের জন্য। সংসদের বক্তৃতায় বার্তা দিয়েছেন ঐকমত্যের।

বিজেপির সদর দফতরে দিওয়ালি মিলন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে নিজস্বী তুলতে ব্যস্ত সাংবাদিকদের একাংশ। শনিবার নয়াদিল্লিতে।— পি টি আই

বিজেপির সদর দফতরে দিওয়ালি মিলন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে নিজস্বী তুলতে ব্যস্ত সাংবাদিকদের একাংশ। শনিবার নয়াদিল্লিতে।— পি টি আই

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:৫১
Share: Save:

হাত বাড়ালেন। কিন্তু ধরলেন কী? প্রশ্নটা তুলে দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেই!

গত কালই তিনি আলোচনার দরজা খুলে দিয়েছেন বিরোধীদের জন্য। সংসদের বক্তৃতায় বার্তা দিয়েছেন ঐকমত্যের। কিন্তু সাম্প্রতিক কালের যে সব ঘটনা সব চেয়ে বেশি ছায়া ফেলেছে রাজনীতিতে ও সমাজে— সেগুলি নিয়ে কোনও কথাই বলেননি। সহমত-সহিষ্ণুতার কথা বলেছেন, কিন্তু শাসক শিবিরের যাঁরা এর বিপরীতে কাজ করছেন বা কথা বলছেন, তাঁদের সম্পর্কে কী তাঁর অবস্থান, ধারই ঘেঁষেননি সে সবের। এর চব্বিশ ঘণ্টা পর আজ সকলের কাছে পৌঁছনোর সুযোগ পেয়েও প্রধানমন্ত্রী তা কাজে লাগালেন না।

প্রধানমন্ত্রী শুধুই কথার কথা বলছেন কি না, সেই সংশয় ঘোচানোর আজ একটি সুযোগ ছিল বিজেপির সদর দফতরে দেওয়ালি মিলন অনুষ্ঠানে। সেখানে তিনি এলেন বটে, কিন্তু কাল নিজের যে নয়া অবতার তিনি সামনে এনেছেন, সেটাই মেলে ধরলেন না। বাস্তবে প্রয়োগ করলেন না নিজেরই বলা গত কালের কথাগুলি। বিজেপি নেতারাও বুঝতে পারছেন, এমনকী অনেকে ঠারেঠোরে বলছেনও, প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আস্থায় যে ঘাটতিটা তৈরি হয়েছে, সেটি পূরণ করার সুযোগও হারালেন তিনি।

দেওয়ালি কেটে গিয়েছে সেই এক পক্ষকাল আগে। আজ তার মিলন অনুষ্ঠান পালন হল দিল্লিতে বিজেপির সদর দফতরে। প্রধানমন্ত্রী সেখানে এলেন। সাংবাদিককুলের সঙ্গে কথা বলতে, মধ্যাহ্নভোজে সঙ্গ দিতে। কিন্তু তিনি শুধু এলেনই। যেন আসতে হবে বলে। স্মরণকালের মধ্যে তাঁর সংক্ষিপ্ততম বক্তৃতা দায়সারা ভাবে শেষ করলেন মাত্র পাঁচ মিনিটে। তার পর আলাপচারিতার নামে মঞ্চ থেকে নেমে এলেন। গত বারের মতো এ বারেও কিছু সাংবাদিক হুমড়ি খেয়ে পড়লেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নিজস্বী তুলতে। তাতে আধ ঘণ্টা সময়ও ব্যয় করলেন। ব্যস। ওইটুকুই! এর পরেই সটান ছাড়লেন দলের সদর দফতর। না সে ভাবে আলাপচারিতা করলেন। না মুখ খুললেন সাম্প্রতিক কালে ঘটে যাওয়া কোনও ঘটনা নিয়ে। মধ্যাহ্নভোজে সকলকে আমন্ত্রণ জানিয়েও নিজে শরিক হলেন না। যেন চিত্রনাট্যে যেটুকু লেখা ছিল, সেটি নমো-নমো করে পালন করলেন। আর পাঁচটা ইভেন্টের মতো।

গত বার যখন দলের সদর দফতরে সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, সেই সময় মোদী ছিলেন একেবারে অন্য মেজাজে। বক্তৃতাও ছিল দীর্ঘ। রসিকতায় ভরা। সাংবাদিকদের নিজস্বী তোলার হিড়িক সে বারে ছিল অপ্রত্যাশিত। কিন্তু এ বারেও যে কিছু সাংবাদিক নিজস্বী তুলতে হুড়মুড়িয়ে এগোবেন, সেটি জানাই ছিল। মোদী তাই বক্তৃতা শেষ করে বাকি সময়টিকে যেন চিত্রনাট্য মেনেই একটি ইভেন্টের মতো কাজে লাগালেন। ফ্ল্যাশের ঝলকানিতে ক্যামেরাবন্দি হল সেই ছবি।

সাংবাদিকদের একাংশের এই হুড়োহুড়ি নিয়ে কটাক্ষ করেছেন জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা। টুইটারে লিখেছেন, ‘‘এই সংবাদমাধ্যমই কি সরকারকে শক্ত শক্ত প্রশ্ন করবে বলে আমরা আশা করি?’’ বিজেপির অনেক নেতা কিন্তু প্রশ্ন তুলছেন মোদীকে নিয়েই। বলছেন, এমন দায়সারা ভাবে সারার বদলে আরও ভাল করে মেলামেশার সুযোগ ছিল প্রধানমন্ত্রীর। অন্তত তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে যখন একের পর এক অভিযোগ উঠছে, সেগুলি নিয়েও মুখ খুলতে পারতেন। এমনিতেই সরকারে আসার পর গত আঠারো মাসে একটিও সাংবাদিক বৈঠক করেননি। যখন যা বলার, তা বলেন হয় কোনও মঞ্চ থেকে, কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে।

গত কাল সংসদেও তিনি বি আর অম্বেডকরের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে যে বক্তৃতা করেছেন, তাতেও অনেক ফাঁক থেকে গিয়েছিল। এক ঘণ্টার বেশি বক্তৃতায় ঐকমত্য, বৈচিত্র্য, গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ নিয়ে অনেক কিছু বলেছেন। কিন্তু দাদরির ঘটনা? লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিকদের পুরস্কার ফেরত দেওয়া থেকে বিজেপি নেতা মায় কেন্দ্রের মন্ত্রী, রাজ্যপালদের প্ররোচনামূলক মন্তব্য? এ সব নিয়ে টুঁ শব্দটি করেননি কাল। আজ অন্তত সাংবাদিককুলের সামনে খোলামেলা ভাবে বলতে পারতেন সে সব প্রসঙ্গ। নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে পারতেন।

প্রশ্নটা উঠছে এখানেই। যে মোদী এখন নিজের চেনা ছন্দ ভেঙে ঐকমত্যের বার্তা দিচ্ছেন, সনিয়া গাঁধী, মনমোহন সিংহকে বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিলে সমর্থন চাইছেন, তিনি কি আদৌ খোলস ছাড়তে পেরেছেন? ঐকমত্য রচনার এই নব্য প্রয়াস নিয়ে বিরোধীরা অবশ্য বিস্তর কটাক্ষ করে চলেছেন। যেমন, দিগ্বিজয় সিংহের মতো কংগ্রেস নেতা আজ বলেছেন, ‘‘বিহারের মানুষকে ধন্যবাদ। তাঁরা মোদীকে আকাশ থেকে মাটিতে নামিয়ে এনেছেন। না হলে ঐকমত্যের ভিত্তিতে দেশ চালানোর কথা মোদী কখনও বলতেন না। এত দিন দেশে-বিদেশে বলতেন, কংগ্রেস ষাট বছরে কিছু করেনি। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীদের কৃতিত্বও এখন নজরে আসছে তাঁর।’’

কিন্তু ছক ভাঙা বার্তা দিয়েও মোদী যেন তাঁর গত ভেঙে বেরোতে পারেননি। এত দেরিতে দেওয়ালি মিলন করার দায়টি এ দিন নিজের ঘাড়ে নিলেন। বললেন, তাঁরই সময় হয়নি এত দিন। আর একটু দেরি হলে বড়দিন চলে আসত। কিন্তু দলের সকলেই জানেন, বিহারের বিপর্যয়ের জন্যই এই দেরি। সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় মোদী অবশ্য হাল্কা করে ছুঁয়ে গেলেন সহিষ্ণুতার প্রসঙ্গ। উৎসব কোনও ভেদাভেদ করে না— এমন সব মন্তব্য করে। কিন্তু যাবতীয় বিষয় নিয়ে কঠোর বার্তা দেওয়ার যে সুযোগ ছিল, সেটি এ বারেও হাতছাড়া করলেন।

লালকৃষ্ণ আডবাণীর বাড়িতে আজ সন্ধেয় একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠান ছিল। গত ৮ নভেম্বর জন্মদিন গিয়েছে তাঁর। সে দিন বিহার ভোটের ফল বেরোনোর পর মোদী গিয়েছিলেন তাঁর বাড়িতে। ঠিকই ছিল, জন্মদিনের অনুষ্ঠানটি হবে পরে। দেখা গেল, আডবাণীর বাড়িতে আজ সেই পারিবারিক অনুষ্ঠানে এসেছেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু দেখা গেল না মোদীকে। সংসদের এ বারের অধিবেশনের প্রথম দিনে প্রধানমন্ত্রী এলে আডবাণী উঠে নমস্কার করলেও, মোদীর প্রতি-নমস্কারে ‘শীতলতা’ নজরে এসেছিল অনেকেরই। ঘরোয়া আলোচনায় বিরোধীরা বলছেন, নিজ দলেরই প্রবীণ নেতাদের সঙ্গে সম্পর্কে যাঁর এত কাঠিন্য, তিনি বিরোধীদের বা সাংবাদিকদের কাছে খোলামেলা হবেন, এটা কি আশা করা যায়?

জিএসটি-সহ গুরুত্বপূর্ণ সব বিল পাশ করানো ও নিজের উদ্ধত ভাবমূর্তির অপবাদ ঘোচানোর দায় থেকে সংসদে কাল অনেক উদার কথাই বলেছেন মোদী। অম্বেডকরের প্রশংসা করতে গিয়ে আত্মসমালোচনার সুরে বলেছেন, ‘‘কেউ কটূ কথা বলে দিলে মনে গেঁথে যায়। দীর্ঘদিন খচখচ করে। মুখোমুখি হলে ব্যক্তিটি নয়, সামনে ভেসে ওঠে সেই তিক্ত কথাগুলি। অথচ, সারা জীবন নানা রকম তিক্ততার মধ্যে দিয়ে গেলেও অম্বেডকর বদলার ভাব নয়, অমৃতটুকুই (সংবিধান) দিয়ে গিয়েছেন, সমাজকে যা জোড়ে।’’ বিরোধী শিবিরের অভিযোগ, মোদী মহানুভবতার কথা মুখে বলছেন বটে, কিন্তু সমাজে যারা বিভাজন ঘটানোর চেষ্টা করছে, অসহিষ্ণুতাকে উস্কে দিচ্ছে, তাঁদের সম্পর্কে মুখই খুলছেন না। পদক্ষেপ করা তো দূর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE