Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

জল চেয়ে খেয়েই গুলি, ঝাঁঝরা মা ও শিশুরা

গ্রামের নাম ফুলবাড়ি। জেলা কোকরাঝাড়। আর পাঁচটা আদিবাসী গ্রাম যেমন হয় ফুলবাড়িও ব্যতিক্রম নয়। সর্বত্র দারিদ্র। জঙ্গি হামলার পর গ্রাম প্রায় ফাঁকা। সাংবাদিক বলেই বোধহয় এ দিক-ও দিক দু-একটা মুখ উঁকি মারল। তাঁদেরই এক জনের কথায়, গ্রামে জঙ্গি হানার আশঙ্কা কয়েক দিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল।

উল্টো খাটিয়াই স্ট্রেচার। নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দেহ। ফুলবাড়িতে। ছবি: এএফপি

উল্টো খাটিয়াই স্ট্রেচার। নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দেহ। ফুলবাড়িতে। ছবি: এএফপি

নিজস্ব সংবাদদাতা
ধুবুরি ও গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:০২
Share: Save:

গ্রামের নাম ফুলবাড়ি। জেলা কোকরাঝাড়। আর পাঁচটা আদিবাসী গ্রাম যেমন হয় ফুলবাড়িও ব্যতিক্রম নয়। সর্বত্র দারিদ্র। জঙ্গি হামলার পর গ্রাম প্রায় ফাঁকা। সাংবাদিক বলেই বোধহয় এ দিক-ও দিক দু-একটা মুখ উঁকি মারল। তাঁদেরই এক জনের কথায়, গ্রামে জঙ্গি হানার আশঙ্কা কয়েক দিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল। সে দিন বিকেলে সেনার পোশাকে গ্রামে আসে এক দল মানুষ। জঙ্গি বলে আমরা ভাবিইনি। প্রথমে গেলমরনা সাহুর বাড়িতে। ঘরে ঢুকে খাবার জল চায় তারা। মরনা বাড়িতে ছিল না। সেনা দেখে খানিকটা ভরসা পায় তার বউ। জল এনে দেয়। পাশে তখন দুই বাচ্চা দাঁড়িয়ে সেনাদের ‘বন্দুক’ দেখছে পরম আগ্রহে। জল খেয়ে গ্লাস মাটিতে রেখে ওরা নিমেষে ওই মহিলা ও তার দুই শিশুকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিল। তত ক্ষণে গ্রামবাসীরা বুঝে গিয়েছেন ওরা কারা। যারা পালাতে পারল পালাল, যারা পারল না মরল!

গ্রামের নাম উত্তর সোনাজুলি। বুকের দুধ খাচ্ছিল কোলের শিশুটি। পাশে খেলা করছিল আর দুই সন্তান। জঙ্গিদের অতর্কিত আক্রমণের মুখে কোলের ছেলেটিকেও সরাবার সময় পাননি মা। শিশুর পিঠ ফুঁড়ে গুলি ঢুকে মায়ের বুক ভেদ করে বেরিয়ে যায়। রক্ষা পায়নি পাশে বসা অন্য দুই শিশুও। আধা-সামরিক বাহিনী যখন গ্রামটিতে যায় তখনও প্রাণহীন স্তন্যদাত্রী মা বুকের শিশুটিকে বুকেই চেপে বসে আছে। ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে উত্তর ভারতীয় আধা-সামরিক জওয়ানটির চোখও ছলছল করে উঠল।

মা মেরি আর শিশু যিশুখ্রিস্টের মূর্তি তৈরির কাজ শেষ গির্জায়। সামনেই বড়দিন। সংখ্যাগরিষ্ঠ আদিবাসীর সব চেয়ে বড় উত্‌সব। সেই উত্‌সব পালনের জন্য সীমিত সামর্থ্য নিয়েই তৈরি হচ্ছিল কোকরাঝাড়, শোণিতপুরের প্রত্যন্ত গ্রামগুলি। সাজানো হচ্ছিল গির্জা। কিন্তু এক রাতে বদলে গেল পুরো ছবিটা। খ্রিস্টোত্‌সব উদ্‌যাপনের আতসবাজি নয়, জঙ্গিদের স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের লাগাতার গুলির শব্দ আছড়ে পড়ল অসমের দু’টি জেলা শোণিতপুর ও কোকরাঝাড়ের উল্টাপানি, পাভৈ, বাতাসিপুর, সেরফাংগুড়ি-সহ বিভিন্ন গ্রামে। রক্তাক্ত হয়ে লুটিয়ে পড়লেন শতাধিক। যার মধ্যে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৭০ জনের। সংখ্যাটি ক্রমবর্ধমান। নিহতদের মধ্যে এখনও অবধি ২১ জন মহিলা। ১৮টি শিশু। প্রাণভয়ে ভীত, মানুষগুলির একমাত্র আশ্রয়স্থল এখন উত্‌সবের জন্য সেজে ওঠা গির্জা।

এরই মধ্যে একের পর এক গ্রাম থেকে নতুন হিংসার খবর আসছে। গত কালের ঘটনার রেশ কাটার আগেই নতুন করে উদালগুড়ি, ঢেকিয়াজুলি, চিরাংয়ে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। রাজ্যে সতর্কতা জারি থাকা ও সেনা অভিযান চলার মধ্যেই উদালগুড়ির লামাবাড়িতে ফের আদিবাসী গ্রামে গুলি চালায় সন্দেহভাজন বড়ো জঙ্গিরা। তিন জন জখম হন। বহু গ্রামে রাতের গণহত্যার পরে প্রাণভয়ে সকলে গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছেন। আজ সকালে ফের সেই সব গ্রামে ফিরে এসে সব বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে যায় জঙ্গিরা।

এরই পাশাপাশি, আজ সকালে মৃতদেহ নিয়ে মিছিল করে যাওয়ার সময়ে উত্তেজিত আদিবাসীরা উদালগুড়ি বাজারে আগুন লাগিয়ে দিলে পুলিশ গুলি চালায়। এতে ন’জন জখম হন। ঢেকিয়াজুলিতে মৃতদেহ নিয়ে প্রতিবাদকারীরা থানা ঘেরাও করলেও পুলিশ গুলি চালায়। পদপিষ্ট হয়ে ও গুলিতে অনেকে জখম হন। এই ঘটনায় ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আজ জঙ্গি হানার প্রতিবাদ করতে গিয়ে আদিবাসীদের রাগ গিয়ে পড়েছে সাধারণ বড়োদের উপর। ফুলগুড়ি ও চিরাং-এ আদিবাসীরা বড়ো গ্রামে আগুন লাগিয়ে দেয়। রুনিখাটায় আদিবাসীদের আক্রমণে দু’জন বড়ো নিহত হয়েছে। জখমের সংখ্যা ২০। উদালগুড়ির মাঝবাটে আদর্শ বাহাদুর গ্রামে আদিবাসীরা বড়োদের ৫০টি বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। বিশ্বনাথে বালিডেঙা, লক্ষ্মী সেন্টার, সিমেনপুপি, পাহারলুং, ফুলবাড়ি-সহ ১০টি গ্রামের কম করে ২০০ বাড়িতে আগুন লাগানো হয়। আদিবাসী সংগঠনগুলির দাবি, পুলিশ অবিলম্বে হত্যাকারীদের শাস্তি না দিলে সব চা-বাগান বন্ধ করে তারা নিজেরাই অস্ত্র হাতে জঙ্গি দমনে নামবে। পরিস্থিতি সামলাতে শোণিতপুর, উদালদগুড়ি, বাক্সা, কোকরাঝাড়ে কার্ফু ঘোষণা করা হয়েছে।

মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ আট মন্ত্রী ও পরিষদীয় সচিবকে গত রাতেই ঘটনাস্থলে যেতে বললেও আজ বেলা আড়াইটে পর্যন্ত কোথাও কোনও সরকারি প্রতিনিধি না আসায় মানুষের ক্ষোভ বেড়েছে। বেলা তিনটে নাগাদ গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী রকিবুল হুসেন ও পরিষদীয় সচিব (স্বরাষ্ট্র) এটোয়া মুন্ডা ফুলবাড়ি যান। তবে জনরোষের ভয়ে তাঁরা ঘটনাস্থলে যেতেই পারেননি।

আলফা প্রধান পরেশ বরুয়া আজ এক বিবৃতিতে জানান, “এই ঘটনা পেশোয়ার হত্যাকাণ্ডের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। যে ভাবে নির্বিচারে মহিলা ও শিশুদের হত্যা করা হয়েছে, তা কোনও যুক্তিতেই সমর্থন করা যায় না।” এনডিএফবি-র আলোচনাপন্থী গোষ্ঠীও এই বর্বরতার নিন্দা করেছে। গুয়াহাটির বিভিন্ন স্থানে আসু, কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতির প্রতিবাদও চলেছে। বিভিন্ন স্থানে আদিবাসীরা পথ অবরোধ করে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা অগপ নেতা প্রফুল্ল মহন্ত অবিলম্বে অসমে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার দাবি জানিয়েছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE