Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

ডি-ভোটার সন্দেহে শচীন্দ্রর বদলে জেলে গেলেন সুচন্দ্রা

ডি-ভোটার (ডাউটফুল ভোটার) সন্দেহে তাঁকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। আদালতে জামিন পেয়ে তিন দিন পর জেল থেকে ছাড়া পেলেন কাছাড় জেলার মালুগ্রামের সুচন্দ্রা গোস্বামী। পরিজনরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও, শান্তিতে নেই সুচন্দ্রাদেবী। একটাই প্রশ্ন তাঁকে তাড়া করছে— তাঁর নাম শচীন্দ্র না হলেও, কেন গ্রেফতার করা হল? উত্তর পাননি কারও কাছেই। পুলিশ বলেছে, আদালতে জিজ্ঞাসা করুন। জেল সুপার বলেছেন— কপালের দোষ। আজ আদালত জানায়, আপাতত মুক্তি দেওয়া হল। ট্রাইব্যুনালে সঠিক নথি দাখিল করতে পারলেই মিলবে নিষ্কৃতি!

সুচন্দ্রা গোস্বামী। — নিজস্ব চিত্র

সুচন্দ্রা গোস্বামী। — নিজস্ব চিত্র

উত্তম সাহা
শিলচর শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০১৫ ০৩:০৩
Share: Save:

ডি-ভোটার (ডাউটফুল ভোটার) সন্দেহে তাঁকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। আদালতে জামিন পেয়ে তিন দিন পর জেল থেকে ছাড়া পেলেন কাছাড় জেলার মালুগ্রামের সুচন্দ্রা গোস্বামী।
পরিজনরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও, শান্তিতে নেই সুচন্দ্রাদেবী। একটাই প্রশ্ন তাঁকে তাড়া করছে— তাঁর নাম শচীন্দ্র না হলেও, কেন গ্রেফতার করা হল?
উত্তর পাননি কারও কাছেই। পুলিশ বলেছে, আদালতে জিজ্ঞাসা করুন। জেল সুপার বলেছেন— কপালের দোষ। আজ আদালত জানায়, আপাতত মুক্তি দেওয়া হল। ট্রাইব্যুনালে সঠিক নথি দাখিল করতে পারলেই মিলবে নিষ্কৃতি!
সুচন্দ্রাদেবীর স্বামী গৌরাঙ্গ গোস্বামী জানান, বছর দু’য়েক আগে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল থেকে একটা নোটিস এসেছিল। তাতে লেখা ছিল— শচীন্দ্র গোস্বামীকে (স্বামী গৌরাঙ্গ গোস্বামী, বাড়ি ভাঙ্গারপার, কাছাড়) বিদেশি বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। তিনি যেন নির্ধারিত তারিখে ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত হন। কিন্তু শচীন্দ্র গোস্বামীকে চেনেন না গৌরাঙ্গবাবু। তাঁর স্ত্রীর নাম তো সুচন্দ্রা। তাই তখন বিষয়টিকে গুরুত্ব দেননি। তাঁর যুক্তি ছিল, শচীন্দ্রর নোটিস হাতে নিয়ে সুচন্দ্রা কেন ট্রাইব্যুনালে যাবে?

পরিচিতদের এ ভাবে বললেও তাঁর যুক্তি আদালতে পৌঁছয়নি। বিবাদীর অনুপস্থিতিতে বিচারক একতরফা রায় দেন। শচীন্দ্রকে ধরে ‘ডিটেনশন ক্যাম্পে’ নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ জারি করেন। সেই মতো বড়খলা থানার পুলিশ ভাঙ্গারপারে গৌরাঙ্গ গোস্বামীর বাড়িতে হানা দেয়। সেখানে তাঁরা জানতে পারেন, গৌরাঙ্গবাবু সপরিবার এখন মালুগ্রামে থাকেন। শনিবার দুপুরে পুলিশ যখন সেই ঠিকানায় হানা দেয়, তখন স্বামী-স্ত্রী কেউ বাড়িতে ছিলেন না। গৌরাঙ্গবাবু ছোট দুধপাতিল হাই স্কুলের শিক্ষক। সুচন্দ্রা গিয়েছিলেন বাপের বাড়ি। মালুগ্রামেই। সেখানেই তাঁর জন্ম, হাতেখড়ি। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনা। সেই বাড়িতে থেকেই কাছাড় কলেজে গিয়েছেন, বিএসসি করেছেন।

ছেলে গৌরবের কাছে পুলিশ আসার খবর পেয়ে বাপের বাড়ি থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যান সুচন্দ্রা। তাঁকে পুলিশ জানিয়ে দেয়, সদর থানায় যেতে হবে। কী ব্যাপার? নাগরিকত্বের প্রমাণ দেখাতে হবে। ১৯৬৭ সালের ২৭ মে শিলচরে শিবসুন্দরী নারী শিক্ষাশ্রমে সুচন্দ্রার জন্ম। বাবা মুকুল রায়চৌধুরী বন বিভাগে চাকরি করে অবসর নিয়েছেন। স্বামী সরকারি কর্মী। দীর্ঘ দিন ধরে শিক্ষকতা করছেন। নিজে সরকার অনুমোদিত স্বল্প সঞ্চয় এজেন্ট। তিন বছর পর পর ‘পুলিশ ভেরিফিকেশন’ জমা করতে হয়। রয়েছে প্যান কার্ড, সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্র-সহ যাবতীয় কাগজপত্র। তাঁর নাগরিকত্বের কী সমস্যা?

গৌরাঙ্গবাবুকে ফোনে খবর দিয়ে তিনি পুলিশের সঙ্গেই অটোরিকশায় ওঠেন। কিন্তু সদর থানা নয়, তাঁকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় শিলচর সিভিল হাসপাতালে। স্বাস্থ্য পরীক্ষার কোনও কথাই নেই। হাতের তালুর ছাপ, আঙুলের ছাপ রাখা হয়। সুচন্দ্রার বুঝতে বাকি ছিল না, তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কেন গ্রেফতার করা হল? পুলিশ জানায়, আদালতকে জিজ্ঞেস করুন।

এ দিন বাড়ি ফিরে সুচন্দ্রাদেবী বললেন, ‘‘দুপুর আড়াইটেয় বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বিকেল সাড়ে চারটেয় জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। বার বার জানতে চাই, কী আমার অপরাধ? কেন জেলে ঢোকানো হচ্ছে? এক জন বললেন— তুমি ডি ভোটার। এখন জেলেই থাকবে।’’

তখনই সুচন্দ্রাদেবীর মনে পড়ে শচীন্দ্র গোস্বামীর নামে জারি নোটিসের কথা। তিনি পুলিশকে বলেন— ‘ওটা তো শচীন্দ্রর নোটিস। আমি সুচন্দ্রা।’ কোনও কথা কেউ শুনতে রাজি হননি। স্বামী, ছেলে, বাবা— সবাই দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। তত ক্ষণে রাত ঘনিয়ে আসে। পর দিন রবিবার। গত কাল জামিনের আবেদন জানানো হয়। বিচারক কাগজপত্র পরীক্ষা করে আবেদন মঞ্জুর করেন। কিন্তু জেলে নির্দেশ পৌঁছনোর পাশাপাশি অন্য প্রক্রিয়াগত কাজকর্ম শেষ হতে বিকেল গড়িয়ে যাওয়ায় রাতটা জেলেই কাটাতে হয়। এ দিন দুপুরে তিনি বাড়ি ফেরেন।

তিন দিন দৌড়ঝাঁপের পর বাড়ির লোক ফিরে আসায় সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। কিন্তু একে মুক্তি বলতে রাজি নন সুচন্দ্রাদেবী। আগামী ৩০ মে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে তাঁর নাগরিকত্ব নিয়ে শুনানি হবে। শেষ পর্যন্ত না বিদেশি হিসেবে প্রমাণ করে তাঁকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়— সেই আশঙ্কায় রয়েছেন তিনি। বারবার জানতে চাইছেন, কার ভুলে ভোটার তালিকায় সুচন্দ্রার নাম বদলে শচীন্দ্র হল। আর শচীন্দ্রর জন্য জারি কারাবাসের নির্দেশে তাঁকেই শাস্তি পেতে হল।

এ সব কথা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে জানাতে চান সুচন্দ্রাদেবী। তাঁর সরকারের আমলে অসমের বঙ্গভাষীরা কেমন রয়েছেন— তা বলতে চান। ভারতে জন্মেও কেন তাঁকে বিদেশি তকমা বইতে হবে— সেই প্রশ্ন করতে চান মোদীজিকে। গৌরাঙ্গবাবু জানান, তাঁরা মানবাধিকার কমিশনে বিচার চাইবেন।

কী ভাবে ঘটল এই ঘটনা?

কাছাড় জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গায়ত্রী কোঁয়র জানিয়েছেন, গৌরাঙ্গবাবুদের মূল বাড়ি বড়খলা থানার ভাঙ্গারপারে। ১৯৯৪ সালে সেখানেই বিয়ে হয় সুচন্দ্রার। পরে তাঁরা শিলচর শহরে চলে আসেন। ভাঙ্গারপারের ভোটার তালিকায় নাম থেকে যায়। শিলচর পুর এলাকার ২৪ নম্বর ওয়ার্ডেও সকলে নাম তোলেন। নতুন ঠিকানা অনুসারে সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্র হয়। ভাঙ্গারপার থেকে যেমন নিজেদের নাম কাটাননি, তেমনি সেই ভোটার তালিকায় সুচন্দ্রা কবে কী ভাবে শচীন্দ্র হয়ে যায়— সেই খবরও রাখেননি। ডি-ভোটার তৈরির প্রক্রিয়ায় শচীন্দ্রকে পুলিশের বাংলাদেশি বলে সন্দেহ হয়। নাম যায় ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল ও নির্বাচন কমিশনে। কমিশন ডি ভোটার বলে চিহ্নিত করে। ট্রাইব্যুনাল পাঠায় উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ। কিন্তু গৌরাঙ্গবাবু নোটিস রেখেও স্ত্রীকে ট্রাইব্যুনালে হাজির না করানোয় গত বছর ১৫ ফেব্রুয়ারি বিচারক তাঁকে বিদেশি বলে রায় দেন।

কিন্তু তাই বলে শচীন্দ্র গোস্বামীকে গ্রেফতারের নির্দেশে সুচন্দ্রাকে ধরে নিয়ে যাবেন? অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের জবাব, ‘‘নাম যা-ই হোক, গৌরাঙ্গ গোস্বামীর স্ত্রীকে বাংলাদেশি বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। তাঁকেই আদালত জেলে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। আমরাও গৌরাঙ্গবাবুর স্ত্রীকেই ধরে দিয়েছি। এখন শচীন্দ্র কি সুচন্দ্রা, ভারতীয় কি বাংলাদেশি সব বিতর্ক আদালতে নিষ্পত্তি হবে।’’

পুলিশের বক্তব্যে বিস্মিত গ্রামবাসী। প্রতিবেশী অতনু চক্রবর্তী, অমিত সিকদাররা বললেন— ‘নাম মিলল না, এর পরও একটা মানুষকে এ ভাবে জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হল! এ কেমন ব্যবস্থায় রয়েছি! এই হেনস্থা কি শুধু অসমের বঙ্গভাষী বলেই?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE