Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
আনন্দবাজারের সাফল্য

নাজিরাকে সাহায্য সুইৎজারল্যান্ড প্রবাসীর

শিলচরের নাজিরা বেগম লস্করের জন্য সুইৎজারল্যান্ড থেকে ২৫০ ডলার পাঠালেন প্রসেনজিত পোদ্দার। টাকার হিসেবে তা প্রায় ১৭ হাজার। কে প্রসেনজিত পোদ্দার, জানে না নাজিরা। নাজিরাকেও চেনেন না পোদ্দারবাবু। ডলার এসেছে রেণুবালা চৌধুরীর ঠিকানায়।

নাজিরা। পাশে মা। ছবি: স্বপন রায়।

নাজিরা। পাশে মা। ছবি: স্বপন রায়।

উত্তম সাহা
শিলচর শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:৫৩
Share: Save:

শিলচরের নাজিরা বেগম লস্করের জন্য সুইৎজারল্যান্ড থেকে ২৫০ ডলার পাঠালেন প্রসেনজিত পোদ্দার। টাকার হিসেবে তা প্রায় ১৭ হাজার।

কে প্রসেনজিত পোদ্দার, জানে না নাজিরা। নাজিরাকেও চেনেন না পোদ্দারবাবু। ডলার এসেছে রেণুবালা চৌধুরীর ঠিকানায়। রেণুদেবী বা পোদ্দারবাবু, তাঁরাও পরস্পরকে জানেন না। তবে তিন জনই একটি বিষয় ভালো করে জানেন— নাজিরার লেটার-সহ মাধ্যমিকে প্রথম বিভাগে পাশের খবর ১২ জুন প্রকাশিত হয়েছিল আনন্দবাজার পত্রিকায়।

বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পর নাজিরা বেগমের জীবন ভিন্ন খাতে বইতে শুরু করে। মা-ভাইদের সঙ্গে সে’ও নগাঁও ছেড়ে শিলচরে দাদুর বাড়ি চলে আসে। শুরু হয় অন্যের বাড়িতে বাসনমাজা, জল তোলার কাজ। সঙ্গে সর্বশিক্ষা মিশনের জ্যোতিকেন্দ্রে যাওয়া। সেই মেয়ে এ বার মাধ্যমিক পরীক্ষায় সমাজবিদ্যায় লেটার নিয়ে প্রথম বিভাগে পাশ করেছে। ফলাফল জেনে পরিচিতজনেরা বাহবা দিলেও চিন্তায় পড়ে নাজিরা। উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তির জন্য ২ হাজার ৫৫০ টাকা প্রয়োজন। পরে চাই বইপত্র, পোশাক আরও কী কী। কে দেবে ভর্তির টাকা। কে জোগাবে বাকি সব। মানুষের বাড়ি ঝিয়ের কাজ করে মার পক্ষে তা একেবারে অসম্ভব।

আনন্দবাজার পত্রিকার ইন্টারনেট সংস্করণে এই সংবাদ পড়ে নাজিরার পড়ার খরচ তিনিই জোগাবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন পোদ্দারবাবু। ৩৫ বছর আগে দেশ ছেড়েছেন। চাকরি থেকে অবসর নিলেও সুইৎজারল্যান্ডেই থেকে যান। একমাত্র মেয়ে সে দেশেই উচ্চপদে কর্মরত। মূল বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের ফরিদপুরে। ভারতে ফেরার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবু নিজের দেশের খবর জানতে আনন্দবাজার পত্রিকার ইন্টারনেট সংস্করণ নিয়মিত পড়েন।

নাজিরার খবর পড়ে তাঁর মনে হয়েছে, এক মেয়ের পড়ার খরচ কত আর! কিন্তু সমস্যা হল, তাকে কোথায় খুঁজবেন। এই মেয়ের ঠিকানা কোথায় পাবেন। আনন্দবাজার পত্রিকার খবরটিতে এ সংক্রান্ত শুধু দু’টি

তথ্য রয়েছে। প্রথম, নাজিরা শিলচরের মালুগ্রাম গার্লস স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসেছে। দ্বিতীয়, সে স্কুলেরই শিক্ষিকা রেণুবালা চক্রবর্তী (আসলে চৌধুরী) তাঁকে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন।

ব্যস, দেড়শো ডলারের চেক কেটে রেণুবালা চক্রবর্তী, মালুগ্রাম গার্লস স্কুল, শিলচর লিখে পাঠিয়ে দেন। ডলারভর্তি খাম এসেছে বটে। কিন্তু এ কে চক্রবর্তী লেখা, অন্য দিকে সুইৎজারল্যান্ড থেকে কেউ তাঁকে কিছু পাঠানোর কথাই নয়। দিনকাল ভালো নয়, কী থেকে কী হয়! তাই প্রথমে তা রাখতে রাজি হননি রেণুদেবী।

বিপাকে পড়েন ডাক কর্তৃপক্ষ। রেজিস্টার্ড চিঠি প্রাপক রাখতে রাজি না হলে তা প্রেরকের কাছে ফেরত পাঠাতে হয়। এ যে এখন সুইৎজারল্যান্ডে পাঠাতে হয়! এ কি চাট্টিখানি কথা। স্থানীয় ডাককর্মী সঞ্জীবন চৌধুরীর নজরে পড়ে, চিঠিতে পোদ্দারবাবুর মেল-ঠিকানা দেওয়া রয়েছে। তিনিই ই-মেলে পোদ্দারবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সুইৎজারল্যান্ড থেকে জবাব পেয়ে সঞ্জীবনবাবু ছুটে যান রেণুদেবীর কাছে। খাম খুলে সবাই বিস্মিত। এ-ও হয়! খামের ভেতরে পার্থবাবুর লেখা চিঠি— ‘বহু দিন হল দেশ ছেড়েছি। তবু ভারত ও ভারতবাসীকে নিয়েই আমার সব ভাবনা। নাজিরার জন্য দেড়শো মার্কিন ডলার পাঠালাম। প্রাপ্তি স্বীকারের পর আরও ১০০ ডলার পাঠাব। অর্থের জন্য তার পড়াশোনা আটকাবে না।’

কথামত কয়েক দিন পরই আসে আরও ১০০ মার্কিন ডলার। সঙ্গে একটি ডিকশনারি-সহ কিছু শিক্ষাসামগ্রী। আজ সে সব আনুষ্ঠানিক ভাবে নাজিরার হাতে তুলে দেওয়া হয়। কাছাড় জেলার বিদ্যালয় পরিদর্শক কাবিলউদ্দিন বিভাগীয় কাজে আচমকা এ দিন মালুগ্রাম গার্লস স্কুলে আসেন। নাজিরার কথা জেনে তিনিও অভিভূত হন। সঙ্গে সঙ্গে নিজের পকেট থেকে নাজিরাকে দেন পাঁচ হাজার টাকা। ঘোষণা করেন, এই ধরনের মেধাবী দুঃস্থ ছাত্রদের জন্য সরকারের ৬ হাজার টাকার একটি বৃত্তি রয়েছে। তিনি নাজিরাকে সেই টাকাও পাইয়ে দেবেন। সব দেখে-শুনে কথা সরছিল না নাজিরার মা মেরাবজুন্নেসা বেগমের। চোখে জল আসে শিক্ষিকা রেণুবালা চৌধুরীরও। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ‘স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া’র চিফ ম্যানেজার রুচিন্দু চক্রবর্তীও। তিনিই নাজিরার নামে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে সাহায্য করেন। পোদ্দারবাবুর পাঠানো ডলার দ্রুত টাকায় রূপান্তরে তিনি সাহায্যের অঙ্গীকার করেন।

এর মধ্যে নাজিরা অবশ্য শিলচর মহিলা মহাবিদ্যালয়ে কলা বিভাগে ভর্তি হয়েছে। স্কুলের প্রধানশিক্ষিকা হেমারানি সিংহ জানান, এত ভাল ফলের পরও মেয়েটি ফি-র কথা ভেবে ভর্তির জন্য আবেদন করেনি জেনে তাকে ডেকে পাঠাই। শিক্ষক-শিক্ষিকারাই দেন ভর্তির পুরো টাকা।

আজ সুদূর সুইৎজারল্যান্ড থেকে ফোনে পোদ্দারবাবু আনন্দবাজারের প্রতিনিধিকে বলেন, ‘‘আমারও তো মেয়ে রয়েছে। যদিও সে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করছে। তবু আমি নাজিরার সংবাদ পড়ে সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিই, আমি তার পড়াশোনার যাবতীয় দায়িত্ব নেব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE