Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

ফাঁসির সিদ্ধান্ত ঝুলিয়ে না রেখে দৃষ্টান্ত প্রণবের

ইয়াকুব মেমনের আগে আরও ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড মকুবের আর্জি খারিজ করেছেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। পরে আরও ৮ জনের। এর মধ্যে ইয়াকুব, আফজল গুরু ও আজমল কাসভ ছাড়া বাকিদের এখনও কেন ফাঁসি হয়নি, সে অন্য বিতর্ক।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

শঙ্খদীপ দাস
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০১৫ ২২:০৪
Share: Save:

ইয়াকুব মেমনের আগে আরও ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড মকুবের আর্জি খারিজ করেছেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। পরে আরও ৮ জনের। এর মধ্যে ইয়াকুব, আফজল গুরু ও আজমল কাসভ ছাড়া বাকিদের এখনও কেন ফাঁসি হয়নি, সে অন্য বিতর্ক। দীর্ঘসূত্রিতার কার্যকারণে কোথাও কোথাও, এমনকী, রাজনীতির রংও মিশে রয়েছে। কিন্তু যত দূর প্রণববাবুর প্রসঙ্গ, সিদ্ধান্ত ঝুলিয়ে রাখার কোনও দায় নিজের উপর রাখলেন না রাষ্ট্রপতি। বরং এ ব্যাপারে তাঁর টেবিল পরিষ্কার রেখে হালফিলের মধ্যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন তিনি।

রাইসিনা সূত্রের কথায়, প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম যখন অবসর নেন, তখনও মৃত্যুদণ্ড মকুবের প্রায় দু’ডজন ফাইল পড়ে ছিল তাঁর টেবিলে। পরবর্তীকালে প্রতিভা পাটিলের জমানায় তিরিশ জনের ফাঁসির সাজা মকুব হলেও, সব কটি প্রাণভিক্ষার আর্জি নিয়ে তিনিও সিদ্ধান্ত নেননি। রাষ্ট্রপতি পদে প্রণববাবুর মেয়াদ ঠিক তিন বছর পূর্ণ হয়েছে। তাঁর সচিবালয় সূত্রে বলা হচ্ছে, এর মধ্যেই ২৬টি প্রাণভিক্ষার আর্জি বিবেচনা করে দেখেছেন রাষ্ট্রপতি। ২৪ জনের মৃত্যুদণ্ড মকুবের আর্জি খারিজ করেছেন তিনি। দু’জনের ফাঁসির সাজা মকুব করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পক্ষে রায় দিয়েছেন। ইয়াকুব মেমনকে নিয়ে তাঁর তিন বছরের মেয়াদে তিন জনের ফাঁসিও হল। ফাঁসি মকুবের ব্যাপারে আর কোনও ফাইল বকেয়া নেই তাঁর কাছে।

সংবিধানের ৭২ নম্বর ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি কারও ফাঁসির সাজা রদ করতে পারেন, বা মকুব করতে পারেন ও তার পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাবাসের পক্ষে মত জানাতে পারেন। যদিও রাষ্ট্রপতি নিজেই সেই সিদ্ধান্ত নেন না। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক তথা মন্ত্রিসভার পরামর্শেই এই সিদ্ধান্ত নেন প্রণববাবু। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে দেখা গিয়েছে, মৃত্যুদণ্ড মকুবের আর্জি বিবেচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারটি ক্ষেত্র বিশেষে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক ও রাষ্ট্রপতির তরফে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আবেদন জানানোর কত দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, সে ব্যাপারে যেহেতু কোনও সময়সীমা বেঁধে দেওয়া নেই, তাই এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলারও জায়গা থাকছে না। তাই রাষ্ট্রপতি পদে তাঁর পাঁচ বছরের মেয়াদে এপিজে আবদুল কালাম, কেবলমাত্র দু’টি সিদ্ধান্ত নেন। এক, ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের ফাঁসি মকুবের আর্জি খারিজ করেন। দুই, খেরাজ রাম নামে এক অপরাধীর ফাঁসি মকুব করে যাবজ্জীবন কারাবাসের পক্ষে মত দেন। কালামের আগে রাষ্ট্রপতি ছিলেন কে আর নারায়ণন। ’৯৭ সাল থেকে ২০০২ পর্যন্ত তাঁর মেয়াদে প্রাণভিক্ষার কোনও আবেদন নিয়েই তিনি সিদ্ধান্ত নেননি।

এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকার আজ প্রশংসা করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মুকুল রোহতগি। তিনি বলেন, ‘‘এর আগে সরকার ও রাষ্ট্রপতির তরফে বহু প্রাণভিক্ষার আবেদন দিনের পর দিন ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এটা ভাল যে বর্তমান রাষ্ট্রপতি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।’’প্রসঙ্গত, একুশ শতকে দাঁড়িয়ে ফাঁসির সাজা আর প্রাসঙ্গিক ও মানবিক কি না তা নিয়েও এখন তুমুল বিতর্ক চলছে। এমনকী, প্রাক্তন কেন্দ্রীয়মন্ত্রী শশী তারুর আজ বলেন, ফাঁসি দিয়ে কোনও ভাবেই অপরাধ দমন করা যায় না। কোনও দৃষ্টান্তও তৈরি হয় না। কিন্তু মুকুল রোহতগি তারুরের মন্তব্য খারিজ করতে চেয়ে বলেন, ‘‘আদালত ফাঁসির নির্দেশ দেওয়ার পর তা নিয়ে যে রকম দীর্ঘসূত্রিতা হয়, সেটাই বড় কারণ। নইলে এই শাস্তি অপরাধীদের মনে ভীতি তৈরি করতে পারত।’’ প্রাণভিক্ষার আর্জি বিবেচনা না করে দীর্ঘ দিন ঝুলিয়ে রাখার কারণে গত বছর সর্বোচ্চ আদালতও সরকারের সমালোচনা করেছিল। সেই কারণে খলিস্তানি সন্ত্রাসবাদী দেবেন্দ্র পাল সিংহ ভুল্লারের ফাঁসির সাজা খারিজ করে তাঁকে যাবজ্জীবনের কারাবাসের সাজা দেয় আদালত। তবে দেবেন্দ্রর মানসিক রোগও এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে একটা কারণ ছিল।

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক যুগ্মসচিব অবশ্য আজ বলেন, আদতে প্রাণভিক্ষার আবেদন নিয়ে যে দীর্ঘসূত্রিতা ও সিদ্ধান্তহীনতার আবহ তৈরি হয়েছিল তা আদতে প্রণববাবুর আগে তিন জন রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রেই হয়েছে। অনেক সময় রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত ধর্মীয় ভাবনাও এক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। নইলে দেখা যাবে অতীতে রাষ্ট্রপতি আর বেঙ্কটরমনের মেয়াদে ৪৪ জনের প্রাণভিক্ষার আবেদন খারিজ হয়েছিল। এখনও পর্যন্ত কোনও রাষ্ট্রপতির পাঁচ বছরের মেয়াদে সেই পরিসংখ্যানটাই সর্বোচ্চ।

এখন প্রশ্ন হল, প্রণববাবু যে আরও ২১ জনের আবেদন খারিজ করেছেন, তাঁদের আদৌ ফাঁসি হবে কি না বা কবে হবে? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফে বলা হচ্ছে, ব্যাপারটা অনেকাংশে আদালত ও রাজ্য সরকারের উপর নির্ভর করছে। কারণ, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক তথা রাষ্ট্রপতি প্রাণভিক্ষার আর্জি খারিজ করার পর তা রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতরকে জানিয়ে দেওয়া হয়। তারাই আদালতের সঙ্গে আলোচনা করে ফাঁসির দিন স্থির করেন। অনেক ক্ষেত্রে অপরাধী আবার আদালতের দ্বারস্থ হন। তা ছাড়া গোটা ব্যাপারটাই যে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল তা এত দিনে পরিষ্কার। তাই ক্রমিক সংখ্যা না মেনে কারও কারও ক্ষেত্রে প্রাণভিক্ষার আবেদন আগে খারিজ করে দেওয়া হয় ও ফাঁসিও হয়ে যায়। যেমন আফজল গুরুর ক্ষেত্রে যা হয়েছে এবং যা আজ ইয়াকুব মেমনের ক্ষেত্রে হল। মেমনের আগে আরও ১৩ জনের আবেদন খারিজ হলেও তাঁদের ফাঁসি এখনও হয়নি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE