Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

বাদল মেঘেই কঠিন যুদ্ধ সেনাপতি জেটলির

জীবনের প্রথম ভোটযুদ্ধটাই যে এমন কঠিন হয়ে উঠবে, শাহি দিল্লিতে বসে টেরই পাননি ৬৪ বছরের দুঁদে আইনজীবী। আজ ৩৬ দিন হয়ে গেল, রাজধানীর বন্ধুবান্ধব, লোধি গার্ডেনের ওয়াকার্স ক্লাব, আশৈশব আড্ডা— সব ছেড়েছুড়ে এখানকার লরেন্স রোডের চাড্ডা হাউসে এক অতি সাধারণ অগোছালো ঘরে প্রায় ঘাড়ের ওপর উঠে পড়া মানুষজনের সঙ্গে দিন গুজরান। কেমন লাগছে অরুণ জেটলির? রসিক প্রবাদ বলে, ঠিক সময়ে বিয়ে না করলে বুড়ো বয়সে সুযোগ্যা সুন্দরী পাত্রী পেলেও বিয়ে করতে পা কাঁপে।

জয়ন্ত ঘোষাল
অমৃতসর শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৪ ০২:৫৯
Share: Save:

জীবনের প্রথম ভোটযুদ্ধটাই যে এমন কঠিন হয়ে উঠবে, শাহি দিল্লিতে বসে টেরই পাননি ৬৪ বছরের দুঁদে আইনজীবী।

আজ ৩৬ দিন হয়ে গেল, রাজধানীর বন্ধুবান্ধব, লোধি গার্ডেনের ওয়াকার্স ক্লাব, আশৈশব আড্ডা— সব ছেড়েছুড়ে এখানকার লরেন্স রোডের চাড্ডা হাউসে এক অতি সাধারণ অগোছালো ঘরে প্রায় ঘাড়ের ওপর উঠে পড়া মানুষজনের সঙ্গে দিন গুজরান। কেমন লাগছে অরুণ জেটলির?

রসিক প্রবাদ বলে, ঠিক সময়ে বিয়ে না করলে বুড়ো বয়সে সুযোগ্যা সুন্দরী পাত্রী পেলেও বিয়ে করতে পা কাঁপে। রাজ্যসভার বর্তমান বিরোধী দলনেতা তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কখনও লোকসভায় না লড়ে এই বুড়ো বয়সে এসে সেই ঝুঁকিটাই যে সত্যি সত্যি নেবেন, তাঁর স্ত্রী ডলিও ভাবতে পারেননি। পঞ্জাবি ব্রাহ্মণ নেতাটি নিজেও বোঝেননি যে, অমৃতসর লোকসভা কেন্দ্র মোটেই কুসুমাস্তীর্ণ নয়! তবে ভরসা এই যে, অমৃতসর থেকে তাঁকে জিতিয়ে আনাটা দু’টি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে মর্যাদার প্রশ্ন। এক জন পঞ্জাবের প্রকাশ সিংহ বাদল। অন্য জনের ইদানীং পরিচিতি বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে। নিজের প্রধান সেনাপতির কেন্দ্রে আগামিকাল জনসভা করতে আসছেন নরেন্দ্রভাই মোদী।

মোদীর সেনাপতি বনাম সনিয়া গাঁধীর ‘ক্যাপ্টেন’। অমৃতসর জমজমাট।

প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন অমরেন্দ্র সিংহ যে দলনেত্রীর পরামর্শে শেষ মুহূর্তে অরুণের বিরুদ্ধে প্রার্থী হতে রাজি হয়ে যাবেন, সেটাও ছিল এক রকম ভাবনার বাইরে! ক্যাপ্টেনের বয়স চুয়াত্তর, কিন্তু এখনও ফিট। হাই সুগার তাঁর, কিন্তু যেখানেই যাচ্ছেন হয় অমৃতসরি কালাকাঁদ, নয় গুড় দিয়ে তৈরি মুগ ডালের হালুয়া অবিরাম খেয়ে যাচ্ছেন! হালে ‘সেনাপতি’র ওজন কমেছে পাঁচ কেজি। ক্যাপ্টেন এক কেজি পিছিয়ে। সে সবে থোড়াই-কেয়ার তিনি দাপটে বলছেন, “অরুণেরও সুগার আছে। তা-ও যদি ঢকঢক করে লস্যি খেতে পারেন, তা হলে আমিই বা কালাকাঁদ খাব না কেন?”

সাতশো গ্রাম আর সাত শহর রয়েছে ১৬ লক্ষ মানুষের এই লোকসভা কেন্দ্রে। তেমন এক গ্রামের নাম— ইসলামাবাদ!

গ্রামে ঢুকলেন সেনাপতি অরুণ। হেঁটে হেঁটে যাচ্ছেন ঘরে ঘরে। সম্পন্ন কৃষকদের একতলা-দোতলা দেশলাই বাক্সের মতো বাড়ি। ওয়াশিং মেশিনে (ঠিক পড়েছেন, ওয়াশিং মেশিনেই) মাখন আর দই দিয়ে লস্যি বানানো হচ্ছে। স্টিলের পেল্লায় গ্লাসে সেই লস্যি পান করছিলেন অরুণ। কিন্তু ভোটটা চাওয়ার আগেই ঝাঁঝিয়ে উঠলেন গৃহকর্তা। গর্জে উঠলেন বাদল সরকারের বিরুদ্ধে— “অকালি সরকার এত দিনে কী করেছে আমাদের জন্য? বলেছিল, চাষের জন্য টিউবওয়েল বসবে বিনা পয়সায়। এখন সেটাই পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকা গাঁটের কড়ি খরচ করে বসাতে হচ্ছে।” লস্যি খেতে খেতে অরুণ দেখলেন, ইতস্তত ক্ষোভের বিস্ফোরক ঠাসা রয়েছে আরও। ওই যে ইরাবতী নদী, তার তটে জমা বালি। আর সেই বালির ঠিকাদারি করে স্থানীয় মানুষ। সেই সব বন্ধ করে অন্য লোকেদের দিতে চাইছেন বাদল-তনয় সুখবীর সিংহ। তাতে আবার লরি ব্যবসায়ীরাও খেপে গিয়েছেন। তাঁদের ব্যবসা নাকি লাটে উঠতে বসেছে।

অরুণ যেটা জানতেন না, গত সাত বছরের অকালি সরকারের বিরুদ্ধে এখানকার শিখ জনসমাজও এত ক্ষিপ্ত! বৃদ্ধ বাদলের সঙ্গে তাঁর দারুণ সম্পর্ক। এতটাই ভাল যে, অরুণকে সম্ভাব্য উপপ্রধানমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরে তাঁকে বেশ অস্বস্তিতেই ফেলে দিয়েছিলেন ক’দিন আগে। কেন্দ্রে মনমোহন সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষের ঝড় যতই উঠুক, পাক সীমান্ত লাগোয়া এই এলাকা কিন্তু বাদল-বিরোধী জনমতের এক বড় রঙ্গমঞ্চ।

বিধানসভা কেন্দ্র আটটি। তার ৬টি এখন অকালি-বিজেপি জোটের দখলে। বাকি দু’টি কংগ্রেসের। ঘটনা হল, বিজেপি বিধায়কদের কাজেও খুশি নয় মানুষ। নভজ্যোৎ সিংহ সিধু ছিলেন দু-দুবারের লোকসভা সাংসদ। তাঁর স্ত্রী স্থানীয় বিজেপি বিধায়ক। কিন্তু সিধুর সঙ্গে অকালির অহি-নকুল সম্পর্ক। আসলে যতই পুরনো শরিক হোন না কেন, বিজেপির কোনও শিখ নেতা দীর্ঘদিন সংসদে থেকে এখানে ছড়ি ঘোরাবেন, সেটাও আবার চান না বাদল। বিজেপি নেতারা বলছেন, সিধু প্রার্থী হলে অকালি নেতারাই সর্বশক্তি দিয়ে তাঁকে হারাতে সক্রিয় হতেন।

ঠিক এই পটভূমিতে ক্যাপ্টেনের জনসভা থেকে কী বোঝা যাচ্ছে?

বোঝা যাচ্ছে যে, অমরেন্দ্র সিংহের আসল লক্ষ্যটা হল অমৃতসরের মন জয় করে ফের পঞ্জাবের তখ্তে পৌঁছনো। জাতীয় কোনও বিষয় নিয়ে সুর চড়ানোর চেয়ে আগামী দিনে ফের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আশ্বাস বিক্রি করাতেই তাঁর বেশি মন। ক্যাপ্টেনের কথায়, “আমার সঙ্গে অরুণের ফারাক কোথায় জানেন? আমার প্রথম অগ্রাধিকার অমৃতসর, তার পর চণ্ডীগড়, তার পর দিল্লি। আর অরুণের অভিমুখ প্রথমে দিল্লি, তার পর চণ্ডীগড়। সবশেষে অমৃতসর।” এ যেন পা-টা নীচে করে দিয়ে হেগেলের মূর্তি সোজা করে দেওয়ার মার্ক্সবাদী কৌশল। জুনিয়র বাদলের শ্যালক বিক্রম সিংহ মাজেঠিয়া রাজ্যের মন্ত্রী। তাঁর বিরুদ্ধে উঠেছে মাদক ব্যবসা এবং আরও হরেক কিসিমের দুর্নীতি ও দাদাগিরির অভিযোগ। অমরেন্দ্র মুখের আগল না রেখে প্রকাশ্য জনসভায় বলছেন, “ও হল একটি বাঁদর!” এই শালাবাবুকে নিয়ে অরুণও বিব্রত। তাঁর মঞ্চে সুহেল শেঠকে দেখা গেলেও শালাবাবুকে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু তাঁকে ব্রাত্য করতেও তো পারছেন না অরুণ। কেন-না এই অকালি নেতাটিই আবার গ্রামকে নিয়ন্ত্রণ করেন অনেকটা অনুব্রত মণ্ডলের স্টাইলে!

আসলে অকালির জনভিত্তি গ্রাম। তারা চায় সেটা ধরে রাখতে। কংগ্রেস মূলত শহর-কেন্দ্রিক। কিন্তু দূরদর্শী ক্যাপ্টেন এ বার চান গ্রামেরও দখল নিতে। ঠিক যেমন এক সময়ে পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম থাকত সিপিএমের দখলে। এখন যার দখল নিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ক্যাপ্টেনের কৌশল ভোঁতা করতে অরুণও প্রচারে গুরুত্ব দিচ্ছেন ‘স্থানীয়’ আবেগকে। জাতীয় নানা বিষয় আর মোদী-মন্ত্রের পাশাপাশি বলছেন অমৃতসরের উন্নয়ন নিয়েও। জালিয়ানওয়ালাবাগ থেকে স্বর্ণমন্দির, সাধুদের আখড়া থেকে বাল্মীকি সমাজ, কখনও বা দেড় লক্ষ দলিতের বস্তি। অরুণ ভরসা দিচ্ছেন মোদী হবেন প্রধানমন্ত্রী। আর তা হলে দুঃখ ঘুচবে অমৃতসরের। তরক্কি হবে। স্বপ্ন বিক্রির নানা কৌশল।

এই কঠিন লড়াইয়েও অরুণকে অপ্রত্যাশিত অক্সিজেন দিয়েছে চুরাশির দাঙ্গা নিয়ে ক্যাপ্টেনের আকস্মিক মন্তব্য। যাতে জগদীশ টাইটলারকে ক্লিন চিট দিয়ে বসেছেন তিনি। অমরেন্দ্র অবশ্য পরিস্থিতি সামলাতে যুক্তি দিচ্ছেন যে, অমৃতসরের শিখেরা ততটা কংগ্রেস-বিরোধী নন। চুরাশির দাঙ্গা হয়েছে দিল্লি-কানপুরে। আক্রান্ত শিখেরা তো অমৃতসরে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। অমৃতসরের শিখেরা যে-হেতু দাঙ্গায় আক্রান্ত নন, তাই শোরগোল করে বিজেপির বিশেষ লাভ হবে না।

আর তা শুনে অরুণদের হুঁশিয়ারি ‘ভাবের ঘরে চুরি করবেন না, ক্যাপ্টেন! শিখরা আর যা-ই হোক, কংগ্রেসকে কিছুতেই সমর্থন করবেন না।’ তাঁরা বোঝাচ্ছেন, স্বর্ণমন্দিরে কোথাও একটা হিন্দিতে লেখা বিজ্ঞপ্তি নেই। বোঝাচ্ছেন, আজও শিখেরা নাকি দিল্লি, কংগ্রেস আর হিন্দি তিনটে শব্দকেই একই রকম ঘৃণা করেন। তাই অমরেন্দ্রও বলছেন, “আমি ইংরেজি আর পঞ্জাবি জানি, কিন্তু হিন্দি ভাল জানি না। আর চুরাশির ওই ঘটনার প্রতিবাদে আমি নিজেই তো কংগ্রেস ছেড়ে শিরোমণি অকালি দলে যোগ দিয়েছিলাম। তার পর ইন্দিরা গাঁধী আবার আমাকে ফিরিয়ে আনেন।”

শহিদগঞ্জে তখন সন্ধে নামছে। কুচকুচে কালো দু’টো মোষে টানা গাড়ি। সেই গাড়িতে এলাকার সরপঞ্চ ঘরে ফিরছেন। মোষের গায়ের রং চকচকে কালো রাখতে সরপঞ্চ সুরজিৎ তাদের শরীরে নিয়মিত হেয়ার ডাই লাগান। উচ্চকণ্ঠে গুরমুখীতে তাঁর দুই মোষের গল্প করতে করতে সুরজিৎ বললেন, “সমস্যাটা অরুণের নয়! আমাদের অকালিদেরই। কিন্তু এটাও জানবেন, অরুণকে সবাই পঞ্জাবের পুত্তর বলেই মনে করেন। কেউই ওঁকে বাইরের লোক ভাবে না। আর এখন তো ওঁকে জেতানো বাদল সাহেবের ইজ্জত কা সওয়াল। অরুণের হার মানে বাদলের হার।”

প্রত্যন্ত গ্রামের পেটা চেহারার সরপঞ্চ কিন্তু এই নির্বাচনের সার সত্যটি বলে দিলেন। ঠিক সেই কারণেই বাদল আজকাল অরবিন্দ কেজরীবালের দলের প্রার্থী দলজিৎ সিংহের খুব প্রশংসা শুরু করেছেন। আসলে অকালি-বিজেপি ভাবছে, দিল্লিতে যা-ই হোক, এলাকায় জনপ্রিয় এই পদ্মশ্রী পাওয়া চিকিৎসকটি বেগ দিলে ক্যাপ্টেনকেই বেশি দেবেন। বাদল সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানবিরোধী ভোট, যা ক্যাপ্টেনের ঝুলিতে যেতে পারে, তাতেই ভাগ বসাবেন আম আদমি পার্টির প্রার্থীটি।

কাল মোদী আসছেন শেষ কামড়টি দিতে। ফোনে তিনি অরুণকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, “তুমি আমার প্রধান সেনাপতি। তোমাকে হারতে আমি দেব না।” বাদল+মোদী। এই যৌথ আশ্বাসেই সম্ভবত রাত্তিরে অমৃতসরি কুলচা আর কিমা কলিজাটা বেশ তৃপ্তি সহকারেই খাচ্ছেন বিজেপি প্রার্থী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

jayanta ghoshal election in amritsar arun jetli
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE