Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

বৃহন্নলাদের জন্যও সংরক্ষণের রায়

কখনও নামের পাশে অপরাধীর তকমা জুড়ে দেওয়া। কখনও বা সমাজ থেকেই একেবারে ব্রাত্য করে রাখা। দীর্ঘদিন ধরে বৃহন্নলা বা হিজড়ে সম্প্রদায়ের মানুষ বঞ্চনা-বৈষম্যের এই অভিজ্ঞতার সঙ্গেই অভ্যস্ত। আজ সেই অভ্যাসেই ছেদ টানতে সক্রিয় হল সুপ্রিম কোর্ট। ঐতিহাসিক এক রায়ে শীর্ষ আদালত জানিয়ে দিল, সামাজিক এবং শিক্ষাগত দিক থেকে অনগ্রসর শ্রেণি হিসেবে বৃহন্নলা সম্প্রদায়কে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হবে।

রায় বেরোনোর পর আনন্দে মেতেছেন বৃহন্নলা। ভুবনেশ্বরে পিটিআইয়ের তোলা ছবি।

রায় বেরোনোর পর আনন্দে মেতেছেন বৃহন্নলা। ভুবনেশ্বরে পিটিআইয়ের তোলা ছবি।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৪ ০৪:১৪
Share: Save:

কখনও নামের পাশে অপরাধীর তকমা জুড়ে দেওয়া। কখনও বা সমাজ থেকেই একেবারে ব্রাত্য করে রাখা। দীর্ঘদিন ধরে বৃহন্নলা বা হিজড়ে সম্প্রদায়ের মানুষ বঞ্চনা-বৈষম্যের এই অভিজ্ঞতার সঙ্গেই অভ্যস্ত।

আজ সেই অভ্যাসেই ছেদ টানতে সক্রিয় হল সুপ্রিম কোর্ট। ঐতিহাসিক এক রায়ে শীর্ষ আদালত জানিয়ে দিল, সামাজিক এবং শিক্ষাগত দিক থেকে অনগ্রসর শ্রেণি হিসেবে বৃহন্নলা সম্প্রদায়কে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং চাকরির ক্ষেত্রে তাঁদের জন্য সংরক্ষণ সুনিশ্চিত করতে হবে। রায়ে বলা হয়েছে, বৃহন্নলা বা হিজড়ে সম্প্রদায়ের (ট্রান্সজেন্ডার) সব মানুষ তৃতীয় লিঙ্গ বলে গণ্য হবেন।

কোর্ট জানিয়েছে, এ দেশে বৃহন্নলাদের ধারাবাহিক ভাবে লাঞ্ছনা এবং বঞ্চনার এক তিক্ত অভিজ্ঞতার শরিক হতে হয়েছে। তা কোনও ভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। তাঁদের মানবাধিকার রক্ষা করা সমাজের কর্তব্য। তাই হিজড়ে সম্প্রদায়ের মানুষকে সমাজের মূলস্রোতে অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি শীর্ষ আদালত চায়, সব ধরনের সামাজিক কলঙ্ক থেকে তাঁদের মুক্তি দেওয়া হোক। যাতে তাঁদের আর ভয়, লজ্জা, হতাশা বা অন্য কোনও সামাজিক চাপের শিকার না হতে হয়।

বিচারপতি কে এস রাধাকৃষ্ণন এবং বিচারপতি এ কে সিক্রির বেঞ্চ আজ বলেছে, “বৃহন্নলারাও এই দেশের নাগরিক। আর পাঁচ জন নারী বা পুরুষের মতো তাঁরাও সব সাংবিধানিক অধিকার ভোগ করবেন।” শিক্ষা এবং চাকরির সংরক্ষণের পাশাপাশি কোর্ট তাঁদের জন্য পৃথক শৌচাগারের ব্যবস্থা রাখারও নির্দেশ দিয়েছে। লিঙ্গের স্ত্রী-পুরুষ দ্বিভাজনের বাইরে গিয়ে তৃতীয় লিঙ্গের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে তাঁদের।

তৃতীয় লিঙ্গের প্রতি সমাজের মানসিকতা পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেছে শীর্ষ আদালতের বেঞ্চ। আদালতের পর্যবেক্ষণ রেল স্টেশন-বাসস্ট্যান্ড-স্কুলকলেজ-অফিস-শপিং মল-থিয়েটার এমনকী হাসপাতাল যে কোনও প্রকাশ্য জায়গায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ কোণঠাসা। সমাজের কাছে তাঁরা যেন অস্পৃশ্য। তাঁদের মূলস্রোতে ফেরাতে সামাজিক অনিচ্ছাও প্রকট।

বিচারপতিদের মতে, “এই সম্প্রদায়ের মানুষকে কী অসম্ভব যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়, আমাদের সমাজ খুব কম ক্ষেত্রেই সেটা বোঝে। তাঁদের মনের গভীরে কী টানাপড়েন চলে, সেটা অনুধাবন করার মানসিকতাও আমাদের নেই। সব চেয়ে বেশি যন্ত্রণা তাঁদেরই, যাঁরা প্রাকৃতিক ভাবে যে লিঙ্গ নিয়ে জন্মেছেন, তার সঙ্গে তাঁদের মানসিক গঠন সাযুজ্যপূর্ণ নয়। আমাদের সমাজ তাঁদের নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করে। পদে পদে অসম্মান করা হয় তাঁদের।”

এই মানসিকতা পরিবর্তনের প্রশ্ন নিয়েই উদ্বিগ্ন বৃহন্নলাদের কেউ কেউ। সুপ্রিম কোর্টে রায়ে খুশি হওয়ার পরেও এইখানেই থেকে যাচ্ছে কাঁটা। বৃহন্নলাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরফে সন্তোষ গিরি জানালেন, “সুপ্রিম কোর্টের রায় খুবই ইতিবাচক, সন্দেহ নেই। কিন্তু রায় দিলেই তো সব হয়ে যায় না। এখন দেখতে হবে সরকার এই গোটা বিষয়টা কী ভাবে বলবৎ করে।”

মেট্রোয় উঠে কোন আসনে বসবেন, শুধু তার জন্যই এখনও প্রতি দিন সন্তোষকে নিজের সঙ্গে লড়াই করতে হয়। বসতে হয় মহিলা আসনে। যেটা তাঁর পছন্দ নয়। সুপ্রিম কোর্ট আজ সংরক্ষণের কথা তো সেই জন্যই বলেছে? সন্তোষ উল্টে প্রশ্ন তুলছেন, “শিক্ষা ক্ষেত্রে সংরক্ষণ ভাল কথা। কিন্তু কোন বাবা-মা ছোটবেলায় বা কৈশোরে মেয়েলি ছেলে বা পুরুষালি মেয়েকে সাগ্রহে সংরক্ষণের আওতায় আনবেন?”

বৃহন্নলাদের দাবিদাওয়া নিয়ে কাজ করেন পবন ঢাল। রায়কে স্বাগত জানালেও তা বলবৎ কী ভাবে হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনিও। নীতিগত ভাবে সংরক্ষণের বিরোধী পবন বলছেন, “পুরুষ-নারীর মতোই সমান অধিকার চাই আমরা। সংরক্ষণে সবাই সুবিধা পায় না।” তবে এই রায়ের পর থেকে মেডিক্যাল সার্টিফিকেট দেখিয়ে নিজেদের পরিচয় বোঝাতে হবে না, এতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন পবন। তাঁর কথায়, “যে কেউ সহজেই নিজের পরিচয় দিতে পারবে।”

বৃহন্নলাদের তৃতীয় লিঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে। সেই সূত্রেই আজ আদালতের এই রায়। এই সূত্রে বেশ কয়েকটি ধর্মগ্রন্থের কথা উল্লেখ করে কোর্ট বলেছে, ইতিহাসের দিক থেকে দেখলে সমাজে বৃহন্নলাদের যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। কিন্তু চিত্রটা পুরোপুরি পাল্টে যায় ঔপনিবেশিক শাসনের সময় থেকে। ব্রিটিশরা এই সব মানুষের গায়ে সরাসরি অপরাধীর তকমা সেঁটে দেয়। কোর্টের মতে, “সেই মানসিকতাই আমরা বয়ে চলেছি। বৃহন্নলাদের অধিকার রক্ষার জন্য আমাদের দেশে কোনও আইনই তৈরি হয়নি। আর সেই জন্যই এই সম্প্রদায়ের মানুষ ধারাবাহিক ভাবে বৈষম্যের শিকার হয়ে এসেছেন।”

আইন না থাকায় এই সব মানুষ সাধারণ হয়রানির পাশাপাশি যৌন হিংসারও শিকার হন। প্রকাশ্য স্থানে, বাড়িতে, জেলখানায় এমনকী পুলিশের হাত থেকেও ছাড় পান না তাঁরা। পাকিস্তান বা নেপাল-সহ বেশ কিছু প্রতিবেশী দেশেই বৃহন্নলাদের অধিকার রক্ষায় সক্রিয় হয়েছে প্রশাসন। সুপ্রিম কোর্ট সেই নজিরও তুলে ধরেছে। বৃহন্নলাদের মধ্যে যাঁরা রূপান্তরকামী, তাঁরা পুরুষ বা নারী যা-ই হতে চান না কেন, অস্ত্রোপচারের পরে তাঁদের সেই লিঙ্গ পরিচয় দেওয়ার অধিকারও আছে বলে জানিয়েছে আদালত। এ প্রসঙ্গে কোর্ট পঞ্জাবের উদাহরণ দিয়েছে। সে রাজ্যে বৃহন্নলাদের প্রত্যেককেই ‘পুরুষ’ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। যা একেবারেই সমর্থনযোগ্য নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

eunach supreme court reservation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE