Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

ভগবতীর শিষ্যত্ব ভুলে আচমকা অমর্ত্য-পন্থী

তবে কি গুরু বদল করলেন নরেন্দ্র মোদী? মনমোহন সিংহ জমানায় যখন একের পর এক সামাজিক নিরাপত্তার প্রকল্প ঘোষণা হতো, সেই সময় বিজেপি তাকে ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি বলে কটাক্ষ করত। যখন নরেন্দ্র মোদীকে বিজেপির প্রধানমন্ত্রীর প্রার্থী করা হল, তখন ইউপিএর এই প্রকল্পগুলির পিছনে অর্থনৈতিক ভাবনাকে তুলোধনা করে ঝাঁঝালো প্রচার শুরু করেছিলেন আজকের প্রধানমন্ত্রী।

দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০১৫ ০৩:২৫
Share: Save:

তবে কি গুরু বদল করলেন নরেন্দ্র মোদী?

মনমোহন সিংহ জমানায় যখন একের পর এক সামাজিক নিরাপত্তার প্রকল্প ঘোষণা হতো, সেই সময় বিজেপি তাকে ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি বলে কটাক্ষ করত। যখন নরেন্দ্র মোদীকে বিজেপির প্রধানমন্ত্রীর প্রার্থী করা হল, তখন ইউপিএর এই প্রকল্পগুলির পিছনে অর্থনৈতিক ভাবনাকে তুলোধনা করে ঝাঁঝালো প্রচার শুরু করেছিলেন আজকের প্রধানমন্ত্রী। লোকসভা নির্বাচনের সময় বিতর্ক তুঙ্গে উঠেছিল মোদীর বিশ্বাস অর্থনীতিবিদ জগদীশ ভগবতীতে, যিনি মনে করেন, দেশের বৃদ্ধির হার সুনিশ্চিত করার জন্য জোরকদমে সংস্কার করতে হবে; আর সনিয়া গাঁধীর আস্থা অমর্ত্য সেনে, যাঁর মত, মানব সক্ষমতায় সরকারি খরচ না বাড়ালে বৃদ্ধি অর্থহীন। লোকসভা নির্বাচনের সময় অমর্ত্য বনাম ভগবতীর লড়াই আসলে হয়ে উঠেছিল মোদী বনাম গাঁধীর লড়াই। বারবার মোদী স্পষ্ট করেছিলেন, খয়রাতির অর্থনীতিতে তিনি বিশ্বাসী নন। ইউপিএ জমানায় আইনের মাধ্যমে খাদ্য, কাজ, শিক্ষার অধিকার দেওয়ার তীব্র সমালোচনা করে তিনি বলতেন, মানুষকে পাইয়ে দেওয়ার রেওয়াজ থেকে বের করে তিনি বরং তাঁদের সক্ষম করতে চান।

কিন্তু আজ মোদী সরকারের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাজেটে মোদীকে আশ্রয় নিতে দেখা গেল অমর্ত্য সেনের ভাবনায়। অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি একে একে ঘোষণা করলেন সামাজিক নিরাপত্তার প্রকল্প। তা সে ‘অটল পেনশন যোজনা’ হোক বা ‘প্রধানমন্ত্রী সুরক্ষা দুর্ঘটনা বিমা’। অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা, ধীরে ধীরে ভারতের সব নাগরিকের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা চালু করাই সরকারের লক্ষ্য। শুধু কি তাই, সদ্য গত কাল ইউপিএ জমানার

একশো দিনের প্রকল্প নিয়ে সংসদে কংগ্রেসকে তীব্র কটাক্ষ করেছেন মোদী, আর আজ সেই প্রকল্পেই ‘সব থেকে বেশি’ বরাদ্দ করলেন অর্থমন্ত্রী। থামলেন না সেখানেও। একে একে ইউপিএ আমলে ঘোষিত শিশু উন্নয়ন প্রকল্প, শিশু নিরাপত্তা প্রকল্প, প্রধানমন্ত্রী কৃষি সেচ যোজনাগুলিতে আরও বেশি বরাদ্দ করার কথাও ঘোষণা করেন জেটলি।

এর পরেই রাজধানীর অলিন্দে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, তা হলে কি গুরু বদল করলেন মোদী? এত দিন ভগবতীর দিকে ঝুঁকে থেকেও শেষমেশ কি তাঁর অর্থনীতির ‘গুরু’ বদল করতে হল? আর যদি করলেনই বা, তা হলে কেন?

বিজেপি শিবিরে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে তার জবাব। বিজেপির নেতারা বলছেন, এর একটা বড় কারণ হল দিল্লি নির্বাচনের ধাক্কা। যে নির্বাচন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, লোকসভা থেকে মোদীর যে বিজয়-রথ চলে আসছিল, তা এসে থেমে গিয়েছে দিল্লিতে। আম আদমি পার্টির মতো একটি আঞ্চলিক দলের ঝড়ে ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছে বিজেপি। বিজেপি বড়লোকদের দল এই অভিযোগ তুলে গরিব, মধ্যবিত্তদের সমীহ আদায় করে নিয়েছেন অরবিন্দ কেজরীবাল। এই ভোটব্যাঙ্ক হাতছাড়া হতে শুরু করেছে বিজেপির থেকে। আর মোদীর নাকের ডগায় রাজধানীতে হার অক্সিজেন জুগিয়েছে সব বিরোধী দলকেও, যারা এখন এককাট্টা হয়ে জমি বিল নিয়ে মোদী-বিরোধী আন্দোলন শুরু করেছে। সেখানেও অভিযোগের সুর একই। মোদী সরকার গরিব-বিরোধী, কৃষক-বিরোধী। আর সে কারণেই এ বারের বাজেটে অর্থনৈতিক দর্শন বদলাতে হল সরকারকে। খোয়াতে বসা ভোটব্যাঙ্ক ধরে রাখতে ছাপ রাখতে হল আমআদমির। বাজেটে একগুচ্ছ সামাজিক নিরাপত্তার প্রকল্প ঘোষণা করে সরকারকে দেখাতে হল, মোদী সরকার আদৌ গরিব-বিরোধী নয়। বাজেটের পর বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ হোন বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ, সকলেই এই গরিবের সামাজিক নিরাপত্তারই ঢাক পেটাতে শুরু করেছেন।

এত দিন অমর্ত্য সেনের অর্থনীতির বিরোধিতা করে কেন সেই অর্থনৈতিক ভাবনাতেই ফিরতে হল? এই প্রশ্ন করা হয়েছে অর্থমন্ত্রীকেও। জেটলির জবাব, “আমি এর মধ্যে কোনও বিরোধ দেখি না। আমি শিল্পের জন্য ভাল পদক্ষেপ করছি বলেই গরিবদের উপেক্ষা করব, তার কোনও মানে নেই।” আর তার জন্যই ঘোষণা হল প্রধানমন্ত্রী সুরক্ষা বিমা যোজনা। বছরে মাত্র ১২ টাকা দিয়ে ২ লক্ষ টাকার দুর্ঘটনা বিমা পাওয়া যাবে। অটল পেনশন যোজনায় বছরে হাজার টাকা করে সরকার অর্ধেক অর্থ দেবে। ১৮ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে বছরে ৩৩০ টাকা প্রিমিয়াম দিয়ে দু’লক্ষ টাকার বিমা পাওয়া যাবে প্রধানমন্ত্রী জীবন জ্যোতি বিমা যোজনায়। পিপিএফ এবং ইপিএফ-এর তহবিলে পড়ে থাকা ৯ হাজার কোটি টাকা দিয়ে প্রবীণ নাগরিকদের কল্যাণ তহবিল গড়া হচ্ছে। দারিদ্রসীমার নীচে বৃদ্ধ, ছোট ও প্রান্তিক চাষিরা এর সুবিধা পাবেন। দেশের সাড়ে ১০ কোটি বৃদ্ধের মধ্যে ১ কোটির বয়স ৮০ বছরের উপরে। তার মধ্যে ৭০ শতাংশ গ্রামে থাকেন, দারিদ্রসীমার নীচে।

জেটলির ঘোষণা, কাউকেই যাতে অসুখবিসুখ বা দুর্ঘটনায় পয়সার অভাবের চিন্তা করতে না হয়, তার ব্যবস্থা করবে সরকার। তফসিলি জাতি, জনজাতি, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণিভুক্ত ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার মুদ্রা ব্যাঙ্ক গড়েও সাহায্যের কথা ঘোষণা হয়। তফসিলি জাতি, জনজাতি, মহিলাদের জন্য ১ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দও করা হয়। জগদীশ ভগবতী এই দানসত্রে খুশি হবেন বলে মনে হয় না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

central budget 2015 agni roy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE