গঙ্গা দূষণ রোধ নিয়ে বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর ডাকা বৈঠকে হাজির ছিলেন না পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। নিজে যেতে পারবেন না বলে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রকে পাঠাতে চেয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু কেন্দ্র জানিয়ে দেয় এই বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীকেই থাকতে হবে। ফলে গত কালের বৈঠকে রাজ্যের কোনও প্রতিনিধি ছিল না। আসেননি উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবও। বস্তুত, কেন্দ্রের নীতি নির্ধারণের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীদের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা অনুচিত বলে মনে করছে অনেক রাজ্যই। বিহারের নীতীশ কুমার, অসমের তরুণ গগৈ, ওড়িশার নবীন পট্টনায়কদেরও বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রীকেই আসতে হবে, প্রতিনিধি পাঠালে চলবে না এমন নিয়ম যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রের পরিপন্থী।
মমতা এই নিয়ম প্রত্যাহারের পক্ষে হলেও এটা নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে সংঘাতে যেতে চাইছেন না। আজ তিনি বলেন, “বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন কাজে আমাকে ঘুরতে হয়। এই তো সামনেই দার্জিলিং যাচ্ছি। এখন নীতি আয়োগ থেকে শুরু করে মুখ্যমন্ত্রী পরিষদের বৈঠকে যদি আমাকে প্রতিনিধি রাখার অনুমতি না দেওয়া হয়, তা হলে অনিচ্ছাকৃত ভাবেই আমাদের অনুপস্থিত থাকতে হবে। পরিস্থিতিটা এমন দাঁড়াচ্ছে যে আমরা বয়কট করতে চাইছি না। কিন্তু অনুপস্থিত থাকতে বাধ্য হচ্ছি।”
এ বিষয়ে কেন্দ্রের বক্তব্য, নীতি নির্ধারণে নির্ণায়ক ভূমিকা নেওয়ার জন্যই মুখ্যমন্ত্রীদের বেশি করে দিল্লি আসা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী নিজেই একাধিক বার বলেছেন, রক্ত শুধু হৃদপিণ্ডে জমা হলে যেমন মানুষ বাঁচে না, তেমনই ক্ষমতা শুধু দিল্লিতে কেন্দ্রীভূত হলে দেশের উন্নয়ন হতে পারে না। অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিও তাঁর বাজেট বক্তৃতায় সহযোগিতা মূলক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কথা বলেছেন। মুখ্যমন্ত্রীরা যত বেশি দিল্লি এসে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করবেন, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ততই শক্তিশালী হবে।
উত্তরে রাজ্য সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, কেন্দ্রীয় নীতি প্রণয়নের জন্য যদি মুখ্যমন্ত্রীকে দিল্লিতে ‘ডেলি প্যাসেঞ্জারি’ করতে হয়, তা হলে রাজ্য চালানো কঠিন। আর রাজ্যের নীতি প্রণয়নে কেন্দ্রের প্রতিনিধি থাকা প্রয়োজন, এই পাল্টা যুক্তিতে যদি ক্যবিনেট সচিবকে ফি-সপ্তাহে কলকাতায় ডাকা হয়, তা হলে তিনি কি আসতে পারবেন? অতীতে গঙ্গা নিয়ে বৈঠকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁর নগরোন্নয়ন মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যকে পাঠাতেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের জন্য। জ্যোতিবাবু পাঠাতেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বা অসীম দাশগুপ্তকে। তা হলে মমতাকেই বা কেন প্রত্যেকটি বৈঠকে হাজিরা দিতে দিল্লি যেতে হবে?
মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতি ছাড়াও আর একটি বিষয় নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক সংক্রান্ত বিতর্ক শুরু হয়েছে। সেটা হল, রাজ্যের মুখ্যসচিবদের সঙ্গে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর ভিডিও কনফারেন্সিং। অনেক মুখ্যমন্ত্রীই এই ঘটনা ঘিরে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন। এত দিন কেন্দ্রের তরফে রাজ্যের মুখ্যসচিবদের সঙ্গে বৈঠক করতেন ক্যাবিনেট সচিব। জওহরলাল নেহরু মাসে দু’বার মুখ্যমন্ত্রীদের চিঠি লিখলেও কখনও মুখ্যসচিবদের চিঠি লেখেননি। মোদীই প্রথম যিনি সরাসরি মুখ্যসচিবদের সঙ্গে কথা বললেন। রাজীব গাঁধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন এক বার ডিএমদের দিল্লি ডেকে পাঠিয়ে সম্মেলন করেছিলেন। তাঁর ‘পিএম টু ডিএম, মাইনাস সিএম’ নীতির ঘোর বিরোধিতা করে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার। তাদের অভিযোগ ছিল, এটা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বলবৎ করার চেষ্টা।
প্রধানমন্ত্রী সচিবালয় অবশ্য বলছে, নরেন্দ্র মোদী তো শুধু কেন্দ্রের নন, রাজ্যগুলিরও প্রধানমন্ত্রী। কেন্দ্রীয় নীতি ও প্রকল্পগুলির বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তিনি কী চাইছেন, সেটা শুধু মুখ্যমন্ত্রী নন, মুখ্যসচিবেরও জানা দরকার। তা ছাড়া, মুখ্যসচিব নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত করে কেন্দ্রের নিয়োগ সম্পর্কিত মন্ত্রিসভার কমিটি। এই কমিটির সদস্য দু’জন। প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। রাজ্য সরকার নামের প্যানেল পাঠায়। তার থেকে কেন্দ্র একটি নাম মনোনীত করে।
কিন্তু মমতা-নীতীশদের পাল্টা বক্তব্য, নিয়োগের পর মুখ্যসচিব রাজ্যপালের মতো কেন্দ্রের প্রতিনিধি নন। তিনি রাজ্য সরকারের প্রথম আমলা। অতীতে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী কেন্দ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে রাজ্যে মুখ্যসচিবের বদলে সরাসরি ক্যাবিনেট সচিব নিয়োগ করেছিলেন। যা নিয়ে দিল্লিতে প্রবল প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। এখন অবশ্য কেন্দ্র মমতা-নীতীশদের অসন্তোষ খতিয়ে দেখারই পক্ষপাতী। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় সূত্র বলছে, মুখ্যমন্ত্রীদের বাধ্যতামূলক উপস্থিতির বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে সাত রেসকোর্সে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy