Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

শেষ আর্জি, ভুল হলে ক্ষমা করবেন

ভোর ৪টে ৫৫। সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত নির্দেশ আসতেই বদলে যায় সংশোধনাগারের ছবিটা। নিমেষে দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত হয় নাগপুর জেল। আজ সকাল সাড়ে ছ’টায় এখানেই ৯৩-এর মুম্বই বিস্ফোরণে দোষী সাব্যস্ত ইয়াকুব মেমনের ফাঁসির সাজা কার্যকর হয়েছে।

সংবাদ সংস্থা
নাগপুর শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০১৫ ০৪:২০
Share: Save:

ভোর ৪টে ৫৫। সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত নির্দেশ আসতেই বদলে যায় সংশোধনাগারের ছবিটা। নিমেষে দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত হয় নাগপুর জেল।

আজ সকাল সাড়ে ছ’টায় এখানেই ৯৩-এর মুম্বই বিস্ফোরণে দোষী সাব্যস্ত ইয়াকুব মেমনের ফাঁসির সাজা কার্যকর হয়েছে। গত ৩১ বছরে এই প্রথম নাগপুর জেলে ফাঁসি হল কোনও আসামির। বুধবার রাতেই ইয়াকুবের প্রাণভিক্ষার আবেদন খারিজ করে দিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। তবে আজই ফাঁসির আদেশ কার্যকর হবে কি না, তা নিয়ে রাতভর জল্পনা চলে। চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষায় বিনিদ্র রাত কাটিয়েছেন ইয়াকুবের আইনজীবীরা, পরিবারের সদস্যেরা। দু’চোখের পাতা এক করতে পারেননি নাগপুর জেল কর্তৃপক্ষও।

কোর্টের নির্দেশ শোনামাত্র মিনিটের ব্যবধানে নাগপুর জেল চত্বর ঘিরে ফেলে রাজ্য পুলিশ, আধাসামরিকবাহিনী। জেলের বাইরে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ল্যান্ড-মাইন প্রতিরোধক গাড়ি। টিভিতে তত ক্ষণে ছড়িয়ে পড়েছে খবরটা। জেলের আশাপাশে ভিড় জমিয়েছেন অগুন্তি মানুষ। তাঁদের সামাল দিতে রীতমতো হিমশিম খান জেল কর্তৃপক্ষ।

ফাঁসি যে হচ্ছেই, গত কাল রাতেই মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল ইয়াকুব। জেলের এক রক্ষীকে বলেছিল, ‘‘এখন কোনও চমৎকারই বাঁচাতে পারে আমায়। যদি কোনও ভুল করে থাকি ক্ষমা করে দেবেন।’’ জেল সূত্রের খবর, গত দু’দিন ধরে মুখে কিছুই তোলেনি সে। বুধবার রাতে জেলে ইয়াকুবের সঙ্গে দেখা করতে এসছিলেন বড় ভাই সুলেমান আর তুতো ভাই উসমান। ভাইদের পেয়ে ভেঙে পড়েছিল ইয়াকুব। পরিবারের সকলের কথা জিজ্ঞেস করছিল বারবার। সুলেমানকেই ইয়াকুবকে কিছু খাইয়ে দিতে অনুরোধ করেছিলেন রক্ষীরা। রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ রুটি, মাংস দেওয়া হয়েছিল তাকে। ঘটনাচক্রে এ দিন জন্মদিনও ছিল ইয়াকুবের। ভাইয়ের ৫৩তম জন্মদিন উপলক্ষে বুধবার কেকও এনেছিলেন সুলেমানরা। ভাইদের পাশাপাশি জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন জেল কর্তৃপক্ষও। দু’-চার টুকরো রুটি খেলেও কেক মুখে তোলেনি ইয়াকুব।

নিয়মমাফিক ইয়াকুবের শেষ ইচ্ছে জানতে চেয়েছিলেন জেল কর্তৃপক্ষ। মেয়ে জুবেদার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল সে। সুযোগ মেলেনি। অগত্যা ফোনে মেয়ের গলা শুনেই ক্ষান্ত থাকতে হয়েছে। জেল থেকে বেরিয়ে সুলেমান জানিয়েছিলেন, মেয়ের সঙ্গে কথা বলে বেশ ফুরফুরে ছিল ইয়াকুব। ভাইকে আশ্বাস দিয়েছিলেন, ‘‘ঈশ্বরে ভরসা রাখো। তোমার জন্য লড়াই করছি। এখনও সব রাস্তা বন্ধ হয়নি।’’ শীর্ষ আদালতে অন্তিম আবেদন জমা দেওয়ার কথাটাও জানিয়েছিলেন। শেষ রক্ষা হয়নি।

ভোর সাড়ে তিনটেয় তোলা হয় ইয়াকুবকে। পাঁচটা নাগাদ আদালতের রায় জানাজানি হতেই শুরু হয়ে যায় ফাঁসির প্রক্রিয়া। ধর্মগ্রন্থ তুলে দেওয়া হয় ইয়াকুবের হাতে। জেলের কুঠুরিতেই নমাজ পড়ে সে। আধ ঘণ্টা মতো মাথা নিচু করে বসেছিল। মুখে রা-কাড়েনি। সাড়ে পাঁচটায় গরম জলে স্নান করানো হয় তাকে। নতুন জামাকাপড় তুলে দেওয়া হয় তার হাতে। দেওয়া হয় জলখাবারও। ইয়াকুব খায়নি। চিকিৎসকেরা তার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা পরীক্ষা করতে গেলেও মুখ ফিরিয়ে নেয়। বলে, ‘‘সুস্থ আছি। চেক-আপের দরকার নেই।’’ নাগপুরের অদূরে একটি হোটেলে টিভিতে তখন চোখ আটকে সুলেমানদের।

সকাল সাড়ে ছ’টা। ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে আসা হয় ইয়াকুবকে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন নাগপুরের মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট এমএম দেশপান্ডে, অতিরিক্ত ডিজিপি মীরান বরওয়ানকার, জেল সুপারিন্টেনডেন্ট যোগেশ দেশাই, এক জন মেডিক্যাল অফিসার ও আরও কয়েক জন। ৬.৩৫-এ ফাঁসি হয় ইয়াকুবের। ৭.১০-এ তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা। সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ সুলেমানদের হাতে তুলে দেওয়া হয় ইয়াকুবের দেহ। ৯.৪৫-এ নাগপুর জেল ছাড়েন তাঁরা। এয়ার অ্যাম্বুল্যান্সে চলে যান মুম্বই।

ফাঁসির সময় জেলের বাইরে উপস্থিত ছিলেন ইয়াকুবের এক আইনজীবীও। মঙ্গলবারই মক্কেলের সঙ্গে দেখা হয়েছে তাঁর। ফাঁসির খবরে তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘মৃত্যুই হয়তো ওর কপালে ছিল। আশা করি সম্মানজনক মৃত্যুই হয়েছে।’’ তবে তাঁর আক্ষেপ, মৃত্যুর আগে সম্পত্তির দলিলটুকু করার সময়ও পেল না ইয়াকুব। স্ত্রী রহিনা আর মেয়ে জুবেদা উত্তরসূরি হিসেবে সম্পত্তির দাবিদার হলেও তাঁদের নানান আইনি জটিলতা যুঝতে হবে বলে আশঙ্কা তাঁর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE