Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

সদিচ্ছায় কাটবে পিপিপি-খরা, আশায় সরকার ও শিল্পমহল

“স্রেফ পিপিপি পিপিপি পিপিপি করলেই কি পয়সা আসবে? আমরাও চেষ্টা করেছিলাম, কেউ আসেনি বিনিয়োগ করতে। কেন কেউ লগ্নি করবে?” রেল বাজেট পেশ হওয়ার পরেই আজ এই প্রশ্ন তুললেন প্রাক্তন রেলমন্ত্রী লালুপ্রসাদ।

প্রেমাংশু চৌধুরী
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৪ ০৩:৫৯
Share: Save:

প্রশ্নটা ভুক্তভোগীর।

“স্রেফ পিপিপি পিপিপি পিপিপি করলেই কি পয়সা আসবে? আমরাও চেষ্টা করেছিলাম, কেউ আসেনি বিনিয়োগ করতে। কেন কেউ লগ্নি করবে?” রেল বাজেট পেশ হওয়ার পরেই আজ এই প্রশ্ন তুললেন প্রাক্তন রেলমন্ত্রী লালুপ্রসাদ।

নরেন্দ্র মোদী সরকারের প্রথম রেল বাজেটে সব থেকে বেশি ভরসা রাখা হয়েছে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ বা পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের উপর। ছোট করে বললে পিপিপি। রেলমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, ভবিষ্যতের সিংহভাগ রেল প্রকল্প পিপিপি-র মাধ্যমে তৈরি হবে। বিদেশি বিনিয়োগও টানার চেষ্টা করবেন তিনি। যাকে দু’হাত তুলে স্বাগত জানিয়েছে শিল্পমহল ও বণিকসভা। সদানন্দ গৌড়ার এই রেল বাজেটে নতুন বিনিয়োগের সম্ভাবনা দেখছেন শিল্পপতিরা।

কিন্তু প্রশ্ন, পিপিপি কি সত্যিই রেলের সব অসুখের ওষুধ হয়ে উঠতে পারবে? লালুপ্রসাদ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে মল্লিকার্জুন খাড়্গের জমানা, রেল মন্ত্রকের অভিজ্ঞতা বলছে, এত দিন এই শিল্পমহলই রেলের পিপিপি মডেলে লগ্নি করতে কোনও উৎসাহ দেখায়নি। তা হলে এ বার কেন পিপিপি-তে টাকা ঢালবে বেসরকারি সংস্থাগুলি?

সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

নরেন্দ্র মোদী সরকারের বক্তব্য, অতীতে হয়নি মানেই যে এ বার হবে না, তার কোনও অর্থ নেই। বেসরকারি সংস্থাগুলিকে লাভের রাস্তা তৈরি করে দিতে হবে। লালু-সহ আরও অনেকের প্রশ্নের মুখে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পীযূষ গয়ালের জবাব, “আসলে এই ধরনের প্রচেষ্টায় সাফল্য মাত্র ৫ শতাংশ নির্ভর করে নীতির উপর। বাকি ৯৫ ভাগই নির্ভর করে সেই নীতি কার্যকর করার উপরে।” নতুন সরকারের শিল্পবন্ধু নীতি, বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরির সদিচ্ছা, প্রচেষ্টা এবং সরকারের উপর শিল্পমহলের ভরসা এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠবে বলে তাঁর দাবি। শিল্পপতিরাও এই যুক্তিকেই সমর্থন করছেন। তাঁদের মত, এই রেল বাজেটে সাফাইয়ের কাজ থেকে শুরু করে তথ্যপ্রযুক্তি পরিকাঠামোর মতো নতুন ক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগের সম্ভাবনা খুলেছে। বণিকসভা অ্যাসোচ্যামের সভাপতি, ইয়েস ব্যাঙ্কের সিইও রাণা কপূর বলেন, “আমরা নিশ্চিত, অতীতে না হলেও এবার পিপিপি-তে বিপুল বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগ আসবে। কারণ নতুন সরকার কাজ করে দেখানোর ক্ষেত্রে বেশি ভরসাযোগ্য।”

লালুপ্রসাদ, মমতা বা খাড়্গের সময়েও রেল মন্ত্রক পিপিপি-র মাধ্যমে নতুন পরিকাঠামো তৈরির চেষ্টা করেছে। লাভ হয়নি। ২০১৩-’১৪ আর্থিক বছরে রেল নতুন পরিকাঠামো তৈরিতে যে পরিমাণ ব্যয় করবে বলে লক্ষ্য স্থির করেছিল, তার থেকে ৫৯ হাজার কোটি টাকা কম ব্যয় হয়েছে। যার প্রধান কারণ পিপিপি-র ব্যর্থতা। আজ রেলমন্ত্রীও সেই ব্যর্থতার কথা মেনে নিয়েছেন। তা সত্ত্বেও সেই পিপিপি-তেই ভরসা রেখেছেন তিনি। রেলমন্ত্রী সদানন্দ গৌড়ার ৩২ পাতার বাজেট বক্তৃতায় পিপিপি শব্দটি এসেছে মোট ১২ বার। দ্রুত গতির ট্রেন থেকে যাত্রী পরিষেবা, ফুটওভার ব্রিজ থেকে স্টেশনের বাইরের পাঁচিল সবেতেই সদানন্দের ভরসা পিপিপি।

কিন্তু ভরসা রাখতে পারছেন না প্রাক্তন রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী। তাঁর বক্তব্য, “পরিকাঠামোয় পিপিপি-তে গিয়ে লাভ হয় না। ক্যাটারিংয়ের মতো ব্যবসায় বেসরকারি সংস্থাগুলি উৎসাহ দেখায়। কিন্তু পরিকাঠামো তৈরিতে কোনও বেসরকারি বিনিয়োগকারীই এগিয়ে আসে না।” যোজনা কমিশনের হিসেবও সে কথাই বলছে। ২০০৭-২০১২, একাদশ যোজনা কালে টেলিযোগাযোগে ৮২%, বন্দরে ৮০%, বিমানবন্দরে ৬৪% ও বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে ৪৪% বেসরকারি লগ্নি এসেছে। কিন্তু রেলে এসেছে মাত্র ৪%। করুণ অবস্থা সড়কেও। সেখানে বেসরকারি লগ্নির ভাগ মাত্র ১৬%। সড়ক প্রকল্পে লগ্নিকারী সংস্থাগুলির দাবি, তাদের আরও লাভের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হোক। সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, “আসলে টেলিযোগাযোগ, বিদ্যুৎ, বন্দর, বিমানবন্দরের মতো যে সব ক্ষেত্রে শুল্ক বা মাসুল বাড়িয়ে লগ্নির খরচ তুলে নেওয়ার সুযোগ আছে, সেখানেই পিপিপিতে বেসরকারি লগ্নি এসেছে।”

এই অবস্থায় কী বলছে শিল্পমহল?

তাদের বক্তব্য, লগ্নিকারীরা কী চাইছেন, সরকারকে তা বুঝতে হবে। লোকসানে চলা প্রকল্প বেসরকারি সংস্থার হাতে ছেড়ে দিয়ে যদি আশা করা হয়, সেগুলি লাভের মুখ দেখবে, তা হলে সেটা ভুল ধারণা। বণিকসভা সিআইআই-এর রেল বিষয়ক টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান সুমিত মজুমদার বলেন, “প্রকল্পগুলিকে যদি বেসরকারি লগ্নিকারীদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলা যায়, তা হলে অবশ্যই বেসরকারি বিনিয়োগ আসবে। আসবে প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নিও।” পিপিপি-তে টাকা এলেই রেলে লগ্নির অভাব কেটে যাবে ও আধুনিকীকরণের কাজ সহজ হবে বলে মনে করছেন ফিকি-র সভাপতি সিদ্ধার্থ বিড়লাও।

এবার কি তা হলে পিপিপি-র খরা কাটবে? মোদী সরকার যেমন শিল্পমহলের উপর ভরসা রাখছে, বিনিয়োগকারীরাও তেমন সরকারের উপর ভরসা রাখছেন। ইয়েস ব্যাঙ্কের সিইও রাণা কপূর বলছেন, “বোধহয় এই প্রথম বার রেলমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা ১ একটি লক্ষ ৪৭ হাজার কোটি টাকার কর্পোরেট সংস্থার বিবৃতির মতো শুনিয়েছে, যারা গ্রাহকদের পরিষেবা দিতে চাইছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE