উত্তাল সমুদ্রে বিপদে পড়া কোনও জাহাজ থেকেই যেন ভেসে আসছিল কাটা কাটা কথাগুলো।
‘‘এত বড় ঢেউ দেখেছি সেই সুনামির সময়ে!’’
ঠিক মাঝসমুদ্রে না হলেও খ্যাপা সমুদ্রের গা ঘেঁষেই এখন রয়েছেন উত্তরপাড়ার বাসিন্দা অপূর্ব বন্দ্যোপাধ্যায়। আপাতত তাঁর ঠিকানা আন্দামানের নিল দ্বীপ। বেড়াতে গিয়ে সপরিবার আটকে সেখানেই। ফোনে আতঙ্কিত গলায় অপূর্ববাবু বলছিলেন, ‘‘পাশেই সমুদ্র। তার গর্জন আর ঢেউয়ের চেহারা দেখে ভয় হচ্ছে।’’
অপূর্ববাবুর মতো সাড়ে বারোশোরও বেশি পর্যটক এই মুহূর্তে আটকে রয়েছেন আন্দামানের হ্যাভলক ও নিল দ্বীপে। এঁদের একটা বড় অংশই বাঙালি। আপাতত এই পর্যটকদের মূল ভূখণ্ড পোর্ট ব্লেয়ারে ফেরার কোনও উপায় নেই। কারণ উত্তাল সমুদ্রে স্টিমার, জাহাজ, ক্যাটামের্যান— কিচ্ছু চলছে না। ঘণ্টায় ৫৫ কিলোমিটার বেগে ঝোড়ো হাওয়া আর জলোচ্ছ্বাসের দাপটে বুধবার নৌসেনার জাহাজ পর্যন্ত ভিড়তে পারেনি নিল-হ্যাভলকের জেটিতে। তাই এ দিন রাত পর্যন্ত ওই দুই দ্বীপে আটকে থাকা পর্যটকদের উদ্ধার
করা যায়নি।
নাগাড়ে আকাশভাঙা বৃষ্টি শুরু হয়েছে মঙ্গলবার সকাল থেকে। সঙ্গে প্রবল ঝোড়ো হাওয়া। হাওয়া অফিসের পূর্বাভাসও ভাল নয়। উল্টে তারা জানাচ্ছে, বৃহস্পতিবারের পরে পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। এমনকী আন্দামানের উত্তর প্রান্তের এই দ্বীপগুলি ঘিরে সামুদ্রিক ঘুর্ণিঝড়ের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না। তবে আন্দামান প্রশাসন এবং দুই দ্বীপের হোটেল মালিকেরা জানান, দুর্যোগের চেহারা যা-ই হোক, পর্যটক ও স্থানীয়দের প্রাণনাশের আশঙ্কা নেই। তাঁরা নিরাপদে রয়েছেন। তবে টান পড়তে শুরু করেছে রসদে। বিস্তীর্ণ এলাকায় বিদ্যুৎও নেই।
আজ, বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার যে পর্যটকদের আন্দামান থেকে বিমানে নিজেদের শহরে ফেরার কথা, তাঁদের পোর্ট ব্লেয়ার (সেখান থেকেই বিমান ধরতে হবে) নিয়ে যেতে নৌবাহিনীর সাহায্য চাওয়া হয়েছে। দুর্যোগ মাথায় করেই এ দিন দুই দ্বীপের জেটিতে লাইন দিয়েছিলেন পর্যটকেরা। কিন্তু লাভ হয়নি। সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কম্যান্ডের মুখপাত্র এস এস বিরদি এ দিন বলেন, ‘‘হ্যাভলকে আটকে পড়া ৮০০ পর্যটককে আনতে ভোরে চারটি জাহাজ পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু উত্তাল সমুদ্রে জাহাজ জেটিতে ভেড়ানো যায়নি।’’ দুর্গত পর্যটকের সংখ্যা হ্যাভলকেই বেশি। নৌবাহিনী সূত্র জানাচ্ছে, সম্ভবত ওই চারটি জাহাজের মধ্যেই একটি কি দু’টির নিল দ্বীপে যাওয়ার কথা ছিল। ওই দ্বীপে অন্তত ৪৮০ জন আটকে পড়েছেন বলে খবর। পর্যটকদের উদ্ধারের জন্য যাওয়া জাহাজগুলিতেই দ্বীপবাসীদের জন্য খাবার, পানীয় জল, ওষুধ, চিকিৎসক এমনকী প্রশিক্ষিত ডুবুরিও পাঠিয়েছে নৌবাহিনী। কিন্তু এ দিনের মতো সে সবই রয়ে গিয়েছে জাহাজে।
এ দিন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকেও আটকে পড়া পর্যটকদের খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে। রাজ্যের বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের মন্ত্রী জাভেদ খান জানান, মুখ্যমন্ত্রী উদ্বিগ্ন। প্রয়োজনে আন্দামানে বিশেষ দল পাঠাতে বলেছেন তিনি। জাভেদের কথায়, ‘‘আন্দামানের বিপর্যয় মোকাবিলা সচিবের সঙ্গে আমাদের সচিবের কথা হয়েছে। পরিস্থিতি বেশ খারাপ। আবহাওয়া একটু ভাল হলে উদ্ধারকাজ শুরু হবে।’’ নবান্ন থেকে এ দিন জানানো হয়, আটকে থাকা পর্যটকদের খোঁজ দেওয়ার জন্য নিকোবরে একটি কন্ট্রোল রুম (নম্বর: ০৩১৯২-২৪০১২৭, ২৩৩০৮৯) খোলা হয়েছে।
হ্যাভলকের বেয়ারফুট রিসর্টের ম্যানেজার সঞ্জীব কুমার এ দিন ফোনে বলছিলেন, ‘‘কিছু জায়গায় ঝড়ে গাছ পড়ে বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে গিয়েছে। ফলে দ্বীপের বিস্তীর্ণ এলাকা অন্ধকারে। জেনারেটর দিয়ে এখনও কাজ চালাচ্ছি। তবে জ্বালানিও ফুরিয়ে আসছে।’’ তিনি জানান, পর্যটকদের তালিকা তুলে দেওয়া হয়েছে প্রশাসনের হাতে। কিন্তু নৌসেনার জাহাজে উঠতে না পেরে অনেকে আবার হোটেলে ফিরছেন। ফলে টান পড়তে শুরু করেছে খাবারের ভাঁড়ারে।
হ্যাভলকে আটকে থাকা বাঙালি পর্যটক পৃথা মুখোপাধ্যায়কে অনেক কষ্টে ফোনে ধরা গেল। বললেন, ‘‘হোটেলে বন্দি হয়ে আছি। এখান থেকে নিল-এ যাওয়ার কথা ছিল। সেটা বাতিল করেছি। এখন বাড়ি ফিরতে পারলে বাঁচি।’’ এয়ার ইন্ডিয়ার প্রাক্তন ডেপুটি ম্যানেজার, টালিগঞ্জের অরূপ সরকার আবার নিল-এ আটকে। তাঁর হ্যাভলক যাওয়ার কথা ছিল। সেটা তো বাতিল করেইছেন, ফোনে বললেন, ‘‘দরকার নেই বেড়ানোর। যথেষ্ট হয়েছে। এখন শুধু ফিরতে চাইছি।’’ নিল দ্বীপের অমূল্য হোটেলের ম্যানেজার অসীম ভট্টাচার্য জানান, তাঁদের হোটেলে ৬৩ জন পর্যটক আটকে। বুধবার কলকাতায় ফেরার কথা ছিল ১৩ জনের।
কিন্তু আবহবিদেরা যে পূর্বাভাস দিয়েছেন, তাতে সেই ফেরার দিন কবে আসবে— তা ভেবেই আপাতত ‘দ্বীপান্তরের জীবন’ কাটছে পর্যটকদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy