Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

লাওয়ারিস রোগীদের কাছে দেবদূত গুরমিত

যাঁর কেউ নেই তাঁর গুরমিত আছেন! শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা তিনি আসেন। পটনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচয়হীন মানুষজনের কাছে তিনি সান্তাক্লজ! তিনিই গুরমিত সিংহ।

দিবাকর রায়
পটনা শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০১৬ ১৬:০৪
Share: Save:

যাঁর কেউ নেই তাঁর গুরমিত আছেন! শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা তিনি আসেন। পটনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচয়হীন মানুষজনের কাছে তিনি সান্তাক্লজ! তিনিই গুরমিত সিংহ।

হাসপাতালের উল্টোদিকের আবাসনের বাসিন্দা। সন্ধ্যার পর তাঁর দেখা পাওয়া যাবে হাসপাতালে ওই নির্দিষ্ট ওয়ার্ডে। গত ২০ বছর ধরে নিয়ম করে সন্ধ্যাবেলা এই ওয়ার্ডে আসেন গুরমিত। রোগীদের খাবার থেকে ওষুধের ব্যবস্থা করেন। এমনকী পরিবারের লোকেদের খুঁজে বের করে তাঁদের বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থাও করেন।

সরকারি চিকিৎসা পরিষেবার অবস্থা যে কোথায় পৌঁছেছে তা প্রায় ৯০ বছরের পুরনো, ১৭৬০ শয্যার পটনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ‘লাওয়ারিস’ ওয়ার্ডে পৌঁছলে বোঝা যায়। নামমাত্র সুবিধার এই ওয়ার্ডের মেঝেতে কোথাও কোথাও গর্ত হয়ে গিয়েছে। দেওয়ালের রঙ উঠে গিয়েছে। পলেস্তারা খসে পড়ছে। ওয়ার্ডে রোগীদের জন্য থাকা বিছানা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বাসি খাবার আর বাথরুমের গন্ধে টেকা দায়। রাতের বেলা ইঁদুররা খাবারের খোঁজে হানা দেয় এই ওয়ার্ডে। এখানে রোগীদের রাতের খাবারে রয়েছে পাতলা ডাল, ভাত আর নামমাত্র তরকারি। সারাদিনে এক বারের জন্য চিকিৎসক ও নার্সরা আসেন। কোনও রকমে ঘুরে চলে যান। বাকি সময়টা এখানে রোগীরা নিজেদের ভাগ্যের ভরসায় কাটিয়ে দেন।

আসলে এটা হাসপাতালের ভবঘুরেদের ওয়ার্ড। ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ রোগীদের স্থান হয় এখানে। যাঁদের কোনও আত্মীয়-পরিজন নেই। অথবা পরিবারের সদস্যেরা তাঁদের ফেলে চলে গিয়েছেন। কোনও ভাবে যাঁরা সুস্থ হয়ে যান, তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয় অথবা রাস্তা দেখিয়ে দেওয়া হয়। আর কিছু লোক মাসের পর মাস এখানেই কাটিয়ে দেন।

দিন কয়েক আগের ঘটনা। এই ওয়ার্ডের বাসিন্দা মঞ্জু (নার্সরা তাঁকে এই নামেই ডাকেন) মেঝেতে খুব চিৎকার করছিলেন। খোঁজ নিতে জানা গেল ইঁদুরে তাঁকে কামড়ে দিয়েছে। মাসখানেক আগে রেললাইনের পাশ থেকে মঞ্জুকে উদ্ধার করে পুলিশ। ট্রেন দুর্ঘটনায় তাঁর হাত-পা কেটে গিয়েছে। গর্ভবতী অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। নিজের পরিবার-পরিজনদের নাম ভুলে গিয়েছেন মঞ্জু। কিচ্ছু মনে নেই। প্রায় সব সময়ে কেঁদে যাচ্ছেন। সেই মঞ্জুর চোখেই ঝিলিক খেলে গুরমিতকে দেখলে। খুশিতে ঝকমক করে ওঠেন মঞ্জু। নিজের হাতে খাবার মেখে মঞ্জুকে খাইয়ে দেন গুরমিত। শুধু মঞ্জু কেন, গোটা ওয়ার্ডের সকলেই দিনভর অপেক্ষা করেন গুরমিতের জন্য।

কেন এ ভাবে প্রতি রাতে হাসপাতালে আসেন গুরমিত! প্রশ্নের উত্তরে তিনি শোনান বহু বছর আগের এক ঘটনা। এক মহিলা প্লাস্টিকের ব্যাগ বিক্রি করতেন। কোনও ভাবে সেই ব্যাগে আগুন লেগে মহিলার কোলের শিশুটি জখম হয়। সেই মহিলা পটনা সিটিতে গুরমিতের কাপড়ের দোকানে এসেছিলেন। তাঁকে নিয়ে গুরমিত পটনার বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়েছেন। কিন্তু কোথাও চিকিৎসা হয়নি। শিশুটি মারা যাওয়ার পরে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেননি গুরমিত। গোলমাল করেছিলেন হাসপাতালে। পরে বুঝেছিলেন গোলমালে লাভ হবে না। তাঁর কথায়, ‘‘সে দিন খুব গরম ছিল। মহিলা কাঁদছিলেন। আমি ওর বাচ্চাটাকে দেখেছিলাম। পুরো অগ্নিগদ্ধ ছিল।’’

সেই শুরু। প্রতিদিন পটনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের লাওয়ারিস ওয়ার্ডে মানুষের সেবা করতে যান তিনি। গত ১৩ বছরে পটনার বাইরে যাননি গুরমিত। কখনও ছুটিও নেননি শুধুমাত্র আত্মীয়-পরিজনহীন মানুষগুলোর কথা ভেবে। গুরমিতের কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন তাঁর চার ভাই। মাসিক আয়ের ১০ শতাংশ দাদার হাতে তুলে দেন তাঁরা। লক্ষ্য, অসহায় রোগীদের যেন কোনও অসুবিধা না হয়।

পটনা শহর-সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে তাঁকে সংবর্ধনা-পুরস্কার দেওয়ার প্রস্তাবও এসেছে। সবিনয়ে তা ফিরিয়ে দিয়েছেন গুরমিত সিংহ। ছবি তোলার কথা বললে রাজি হতে চান না। পর্দার পিছনে থেকে কাজ করে যেতে চান গুরমিত। ওয়ার্ডের এক রোগী বলেন, ‘‘গুরমিতজি ভগবানের মতো।’’ সে কথায় কান না দিয়ে গুরমিত ওয়ার্ড ছেড়ে বেরিয়ে যান। কাল রাতে ফের আসবেন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

patna medical college
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE