Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

এই দেশে লংকাকে ‘মরিচ’ বলে

কলেজের গণ্ডি ডিঙোনোর পর পরই বনগাঁ দিয়ে পায়ে হেঁটে সীমান্ত পেরিয়েছিলাম। প্রায় দুই যুগ আগে, নতুন এক দেশে যাব বলে। জানতাম সে দেশের মানুষ আমার ভাষায় কথা বলে, আমাদের গান শোনা, কবিতা পড়া, মাছ-ভাত-ডাল ভরা ভালবাসা একই রকমের।

বাংলা নববর্ষে ঢাকায় উৎসব। ছবি: রাশেদ সুমন, ঢাকা

বাংলা নববর্ষে ঢাকায় উৎসব। ছবি: রাশেদ সুমন, ঢাকা

সাহানা বাজপেয়ী
শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৬ ০৩:০৫
Share: Save:

কলেজের গণ্ডি ডিঙোনোর পর পরই বনগাঁ দিয়ে পায়ে হেঁটে সীমান্ত পেরিয়েছিলাম। প্রায় দুই যুগ আগে, নতুন এক দেশে যাব বলে। জানতাম সে দেশের মানুষ আমার ভাষায় কথা বলে, আমাদের গান শোনা, কবিতা পড়া, মাছ-ভাত-ডাল ভরা ভালবাসা একই রকমের। ঠিক আমার দেশের মতোই, সেই দেশ আম-কাঁঠাল, জাম-জামরুলের; সে দেশেও সমান তালে ফুটে চলে কাশফুল, শিউলি, চাঁপা-চামেলি, কলাবতী-অপরাজিতারা। আমার দেশের নদী জন্ম-জন্মান্তর ধরে সে দেশের নদীর সঙ্গে সই পাতায়, আবার বর্ষায় ঝগড়া বাধায়। সে দেশের বটফল আমার দেশের পাখিরা খেয়ে যায়। বৃষ্টির দিনে, সে দেশের ইলিশ পাতে না পড়লে আমাদের মুখ ভার।

যদিও ইমিগ্রেশনে, পাসপোর্টে ছাপ হওয়ার অপেক্ষার সময়, এ-পারের চায়ের দোকানে গরুর দুধের চা খেয়ে, ও-পারে মিল্কমেড দেওয়া ঘন চা খেলাম, কেন যেন মনে হল না সীমান্ত পেরিয়েছি। হেঁটে আসতে দেখলাম দশ ফুট মতন মাঝখানে রেখে, দু’পাশে দুটো গ্রিলের ফটক।

দু’পাশে জ্বলজ্বল করছে দু’রকম পতাকা। দু’পাশে দু’রকম ইউনিফর্মধারী সীমান্তরক্ষী বাহিনী। বেশ হাসিই পেয়েছিল, সিরিল র‌্যাডক্লিফের কথা ভেবে। মনে মনে ইংরেজদের খানিক গালও পেড়েছিলাম।

সেই সময়ে, সবেমাত্র বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন-এর ‘ইম্যাজিন্‌ড কমিউনিটিজ’-এ মাথা ছোপানো হয়েছে, রং তখনও কাঁচা। ‘ন্যাশনাল কনশাসনেস’ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসু মন নিয়ে ‘এলেম নতুন দেশে’। সীমান্ত তো পেরোলাম— মাটির, ধানজমির ওপর দিয়ে, এক দেশে রান্নাঘর অন্য দেশে ধানের গোলা, গোয়ালঘর, বসতবাটি ভাগাভাগি করে এক জন ইংরেজ কার্টোগ্রাফারের আঁকা দাগ— দেখে মনে হয় ইতিহাসের বিচ্ছিরি অবুঝপনা! কিন্তু তার ওপর আবার কাঁটাতার সব কিছু ছাড়িয়ে মানুষের মনেও গভীর বাসা বেঁধেছে, তা বুঝেছি পরে। ঢাকা শহরে, কাঁচাবাজারে সবজি কিনতে গিয়ে।

কয়েক সপ্তাহের মধ্যে, তত দিনে, ঢাকাইয়া উচ্চারণ-ভঙ্গিতে বাংলা বলা কিছুটা আয়ত্তে এসেছে। যাইতেসি, গোসল করতেসিলাম, পানি গরম দিসি, বড়দের কথার উত্তরে ‘জি’, আপনে কই যান, খাইতেসি, এইটা জোস্ গান, বিলাই, ফকিরের মতো হাবভাব, খাওয়া খুব মজা হইসে— গড়গড় করে বলে চলেছি। মনে মনে নিজের পিঠ চাপড়াচ্ছি। সেই মধু-ঝরা বাংলায় সমৃদ্ধ হয়ে বাজার করতে গেছি এক শুক্রবার সকালে। ‘ভাইয়া, দুইশো গ্রাম লংকা দিবেন?’ যেই না বলা, অমনি সবজি-বিক্রেতা মিষ্টি হেসে, ‘আসুন দিদি, লংকা আছে, ইন্ডিয়া থেকে এসেছেন?’ ‘আসুন’-এর ‘উ’, আর ‘এসেছেন’-এর ‘ছ’-তে বেশ প্রাণবন্ত ও সচেতন জোর! আমি তো হতবাক! এই লোক ক্যামনে বুঝে ফ্যালাইলো আমি ভারতের? আমার বাজার-সঙ্গী ফিচেল হাসি দিয়ে কানে কানে বলল, ‘ব্যস, ধরা পড়ে গেলি তো? এই দেশে লংকাকে ‘মরিচ’ বলে।’

এইটুকুনি ভাষাগত হেরফেরে বুঝলাম, আমার একান্ত নিজের মতন করে, যে আমি সীমান্ত পেরিয়ে এসেছি। যে ভাষাকে ভর করে সীমান্ত পেরিয়েছি কি পেরোইনি তা বুঝিনি বা না-বোঝার ভান করেছি, সেই ভাষাই সীমান্তের অস্তিত্ব প্রকট করে দিল। মহা ‘irony’ বুঝি একেই বলে! ধীরে ধীরে ভাষার ও সংস্কৃতির সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনাগুলো রপ্ত করতে শিখলাম। নুনকে লবণ বলতে শিখলাম, জানলাম ফখরুদ্দিনের কাচ্চি বিরিয়ানি, আর বেইলি রোডের ফুচকা খেলেই ফটাস করে স্বর্গে চলে যাওয়া যায়। থুড়ি, বেহেশ্‌তে।

এই ‘খোয়াবনামা’র দেশে আমার জীবনের দীর্ঘ আট বছর কেটেছে। সেখানে ঘর বেঁধেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি পড়িয়েছি, গান শিখেছি-গেয়েছি, রান্নাবাটি খেলেছি; জীবনের শ্রেষ্ঠ বন্ধুত্বগুলোর বেশির ভাগের সেখানেই কুঁড়ি ফুটেছে— দানা বেঁধেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রমনা পার্ক চত্বরে প্রতি বছর বাংলা নববর্ষের আয়োজনে ডুবতে ডুবতে ভেবেছি, আমরাও তো এই রকম সবার রঙে রং মেলানো, পান্তাভাতে-ইলিশমাছে— নতুন বছরকে আহ্বান করতে পারি, কেন যে করি না!

বিশ্ববিদ্যালয়ের উঠতি-বয়সি কিছু ছাত্রছাত্রী আমার কী ধর্ম তা নিয়ে জিজ্ঞাসু হয়েছে, যা আমার কাছে এক বিরাট বিস্ময়, যেহেতু এই প্রশ্নের সম্মুখীন আমি আগে কখনওই হইনি।

বাংলা গানের প্রতি সারা দেশটার আকুল প্রেম দেখে, শিল্পীদের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ও গভীর ভালবাসা বুঝে, বাংলা ব্যান্ডগুলোর দুর্ধর্ষ গিটার-প্লেয়ারদের বাজনা শুনে, এই কথা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি যে এই দেশটার লোকেদের কাছে অতিথি সর্বার্থে নারায়ণ, তাঁদের ‘চা খেয়ে এসেছেন নাকি গিয়ে খাবেন’ বলা আক্ষরিক অর্থে পাপ। গোটা সমাজে ও সংস্কৃতিতে ‘আদব’ যে গভীর ভাবে ছড়িয়ে থাকতে দেখেছি— তা উপলব্ধি করে, সীমান্ত যে পার হয়েছি তা বুঝতে দেরি হয়নি।

সীমান্ত যে ভাবে আছে— মাটিতে, মনে, যাপনে— সেই ভাবেই যেন সীমান্তহীনতার জন্য আকুতি লালিত হয়। একে অপরের কাছ থেকে দেওয়া-নেওয়া, ছিটমহল নিয়ে ক্ষোভান্বিত জিজ্ঞাসা যেন বন্ধ না হয়। দুই দেশের মধ্যে ক্রিকেট-খেলাগুলো যেন জাতীয়তাবাদ দর্শানো দুর্গন্ধময় মনোবৃত্তি প্রকাশে পর্যবসিত না হয়। একই ভাবে, আমরা যারা গানবাজনা করি, তারা যেন ছেঁদো স্বদেশিয়ানার ঊর্ধ্বে উঠতে পারি— বোঝাতে পারি, সংগীতের কোনও সীমান্ত হয় না। শেষমেশ যে সমস্ত রাষ্ট্রীয় মন-কষাকষি আমাদের বন্ধুত্বকে দৃঢ় করার পরিবর্তে হানাহানি টেনে আনে, আমাদের মাঝখানে যে দাগ টানা হয়েছে সেটাকে আরও গাঢ় রঙে রাঙিয়ে প্রকট করে তোলে, সেই সমস্ত লেনদেনের মুখে যেন ছাই দেওয়ার শক্তি জোটাতে পারি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

bangladeah independence
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE