Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

রাজ্যের প্রাপ্তি শুধু দু’টি ট্রেন

ক্ষমতা থেকে যেতে যেতে অন্তর্বর্তী রেল বাজেটেও পশ্চিমবঙ্গের জন্য দশটি নতুন ট্রেন ঘোষণা করেছিল মনমোহন সিংহ সরকার। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী জমানার প্রথম রেল বাজেটে বাংলা পেল মাত্র দু’টি নতুন ট্রেন। এ বারের বাজেটে নতুন প্রকল্প প্রায় ঘোষণা হয়নি বললেই চলে।

শঙ্খদীপ দাস
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৪ ০৪:০১
Share: Save:

ক্ষমতা থেকে যেতে যেতে অন্তর্বর্তী রেল বাজেটেও পশ্চিমবঙ্গের জন্য দশটি নতুন ট্রেন ঘোষণা করেছিল মনমোহন সিংহ সরকার। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী জমানার প্রথম রেল বাজেটে বাংলা পেল মাত্র দু’টি নতুন ট্রেন। এ বারের বাজেটে নতুন প্রকল্প প্রায় ঘোষণা হয়নি বললেই চলে। তাই আলাদা করে এ ক্ষেত্রে বাংলার প্রাপ্তিরও প্রশ্ন নেই। আবার রেলের আর্থিক স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে চলতি সব প্রকল্পের জন্য উদারহস্ত হওয়ার পরিসরও ছিল না। তারও প্রভাব পড়ল কলকাতার প্রস্তাবিত চার নতুন মেট্রো-সহ বাকি প্রকল্পের জন্য আর্থিক বরাদ্দে।

ইউপিএ-র প্রথম জমানায় কেন্দ্রে সমর্থক ছিলেন বামেরা। সেই সুবাদে বাংলার প্রাপ্তি মন্দ ছিল না। এর পর রেলমন্ত্রী হয়ে রাজ্যের জন্য কল্পতরু হয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, দীনেশ ত্রিবেদী ও মুকুল রায়। এমনকী প্রতিমন্ত্রী হয়েও রাজ্যের জন্য কম লড়াই করেননি অধীর চৌধুরী। প্রাপ্তির সেই ধারাবাহিকতার সঙ্গে আজ ‘না পাওয়ার’ ফারাকটা আপাতদর্শনে তাই সবারই নজর কাড়ে। এবং সেই ফারাকটাই রসদ হয়ে ওঠে রাজনীতির। তৃণমূলের এবং কংগ্রেসের।

বাংলার প্রতি ‘বঞ্চনা’র জন্য অসন্তোষ জানিয়ে আজ এক দিকে সংসদে উগ্র বিরোধিতায় সরব হন তৃণমূল সাংসদরা। অন্য দিকে, হুগলির জনাইয়ের সভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এটা কী রেল বাজেট হয়েছে বলুন তো? আমার তো শুনে গা রি-রি করছে। ভাগ্যিস আমি লোকসভা বা রাজ্যসভায় ছিলাম না। থাকলে কী করতাম জানি না।” মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ, চলতি প্রকল্পগুলির ভবিষ্যৎ নিয়ে উদাসীন মোদী সরকার। অথচ তিনি নিজে রেলমন্ত্রী থাকার সময়ে ডানকুনিকে দু’টো কারখানা দিয়েছিলেন। দিয়েছিলেন তিনশো ট্রেন, পণ্য করিডর। মমতার কথায়, “এ বার মাত্র দু’টো (ট্রেন)! আমরা কি ভিখারি নাকি? আমরা ওটা ফিরিয়ে দেব। আমাদের ভিক্ষে চাই না।”

সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম কিন্তু মমতার সঙ্গে একমত নন। উল্টে তাঁর অভিযোগ মমতার জন্যই আজকের রেল বাজেটে বাংলার প্রাপ্তি শূন্য। সেলিমের মতে, মমতা স্রেফ রাজ্যে ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যেই একের পর এক প্রকল্প ঘোষণা করে গিয়েছিলেন। সেগুলি সম্পূর্ণ করার কোনও চেষ্টা তিনি করেননি। মমতা-জমানার কাজের শ্বেতপত্র প্রকাশেরও দাবি তুলেছেন সেলিম।

তবে অধীরবাবুকে পাশে পেয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি আজ বলেন, “এর নেপথ্যে কোনও অর্থনীতির দর্শন নেই। এই বঞ্চনা রাজনীতি প্রেরিত।” কলকাতার মেট্রো-সহ চলতি প্রকল্পগুলি এর পর মুখ থুবড়ে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

বাংলাকে বঞ্চনার এই অভিযোগ মানতে নারাজ রেলমন্ত্রী সদানন্দ গৌড়া। তাঁর যুক্তি, প্রাদেশিকতা ও হাততালি কুড়োনোর ঊর্ধ্বে উঠে এই রেল বাজেটে বাস্তব প্রয়োজনীয়তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। রেলকে আরও লাভজনক করে তুলতে হবে। তাই নতুন প্রকল্প ঘোষণার চেয়ে চলতি প্রকল্প শেষ করায় গুরুত্ব দিয়ে সেগুলিতে যথাসম্ভব অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। রেলমন্ত্রীর কথায়, “যে তিনটি রাজ্যে চলতি প্রকল্পের সংখ্যা সব থেকে বেশি, তার অন্যতম পশ্চিমবঙ্গ। মূলধন খাতে বিনিয়োগের একটা বড় অংশ যাবে সেখানে। এর পর বঞ্চনার অভিযোগ খাটে কি?”

বিজেপি নেতাদের কথায়, গত কয়েক দশকে জনমোহিনী রাজনীতির আঁতুড়ঘর হয়ে উঠেছিল রেল বাজেট। মাধবরাও সিন্ধিয়া, জাফর শরিফ, রামবিলাস পাসোয়ান, নীতীশ কুমার, লালু প্রসাদ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রা সেই রাজনীতি করে গিয়েছেন। যেখানে প্রকল্পের প্রয়োজন নেই, সেখানেও জোর করে ঘোষণা করেছেন। রেল বাজেটে সুইমিং পুল, প্রেক্ষাগৃহ, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণের মতো ঘোষণা হয়েছে, যেগুলি আদতে রেলের কাজই নয়। এমনকী মমতা এ-ও বলেছেন যে, তিনি কাজ করে যাওয়ার পরে আগামী বিশ বছরে নতুন প্রকল্পের প্রয়োজনই হবে না!

বিশেষজ্ঞদের অনেকের মতে, এই রাজনীতিতেই আজ ইতি টানতে চাইলেন মোদী। তাঁর লক্ষ্য, রেলকে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির ইঞ্জিন করে তোলা। তা ছাড়া, ঘরোয়া আলোচনায় এক বিজেপি নেতা বলেন, “ইউপিএ জমানায় বাম, কংগ্রেস ও মমতার দৌলতে পশ্চিমবঙ্গ শতাধিক নতুন ট্রেন পেয়েছে। দেশের বাকি রাজ্যগুলি কী অন্যায় করেছে?” এই যুক্তি উড়িয়ে অধীরবাবুর প্রশ্ন, “তা হলে কেন বারবার মুম্বই ও বেঙ্গালুরু-কর্নাটকের নাম উঠল? মহারাষ্ট্রে নির্বাচন আসন্ন এবং কর্নাটক রেলমন্ত্রীর নিজের রাজ্য!”

কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী প্রকাশ জাভরেকর অবশ্য জানাচ্ছেন, গত বাজেটে কলকাতার মেট্রো প্রকল্পগুলির জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল ৫২৯ কোটি টাকা। এ বার বাজেটে ওই চারটি প্রকল্পের জন্য (ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো ব্যতিরেকে) বরাদ্দ হয়েছে ৫৪০ কোটি টাকা। কাঁচরাপাড়া ও ডানকুনির রেল কারখানার জন্য গত বাজেটে যথাক্রমে মাত্র ২ কোটি এবং ১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। এ বার ওই দুই প্রকল্পে ৩৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। বঞ্চনার অভিযোগ এনে মানুষকে ভুল বোঝানোর চেষ্টা হলে বিজেপি-ও কাগজপত্র নিয়ে পাল্টা প্রচারে নামবে বলে হুঁশিয়ারি দেন তিনি।

তবে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, কলকাতার নতুন মেট্রো-সহ ঘোষিত প্রকল্পগুলির রূপায়ণ কত দিনে হবে, তা এক রকম অনিশ্চিত। বরাদ্দের তুলনায় প্রয়োজন যে অনেকটাই বেশি, সেটাও স্পষ্ট। রেল কর্তারা অবশ্য এর জন্য অবশ্য মমতা-সহ তৃণমূলের তিন রেলমন্ত্রীর দিকেই আঙুল তুলছেন। তাঁদের বক্তব্য, রেলের আর্থিক স্বাস্থ্যের কথা ওঁদের অজানা ছিল না। অন্য সব শহরে মেট্রো যখন বিদেশি ঋণ নিয়ে ও সরকার-বেসরকারি উদ্যোগে রূপায়িত হচ্ছে, তখন একমাত্র ব্যতিক্রম কলকাতা। জবরদস্তি এই প্রকল্পগুলিকে রেল বাজেটে ঢুকিয়ে গিয়েছেন রেলমন্ত্রীরা। তাই দীর্ঘসূত্রতার দায় কেন্দ্রের ওপর চাপিয়ে লাভ নেই। এর জন্য দায়ী রাজনীতিই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

rail budget sadanand gowda sankhadeep das
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE