Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

তেলে-জলে মিশ খেল বিহারে, ব্রাত্য মোদীই

নব্বইয়ের দশকে লালকৃষ্ণ আডবাণীর রথ আটকে দিয়েছিলেন লালু প্রসাদ যাদব। আর আজ নরেন্দ্র মোদীর চাকার হাওয়া চুপসে দিলেন লালু ও নীতীশ কুমার।

নিজস্ব সংবাদাতা
শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০১৫ ১৯:৪৫
Share: Save:

নব্বইয়ের দশকে লালকৃষ্ণ আডবাণীর রথ আটকে দিয়েছিলেন লালু প্রসাদ যাদব। আর আজ নরেন্দ্র মোদীর চাকার হাওয়া চুপসে দিলেন লালু ও নীতীশ কুমার।

বিহারের ২৪৩ টি আসনের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতাই শুধু নয়, দুই-তৃতীয়াংশও নয়, প্রায় তিন-চতুর্থাংশ ভোট পেয়ে বেনজির রেকর্ড গড়ল মহাজোট। প্রাক-ঘোষণা অনুযায়ী বিহারের পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী হতে চলেছেন নীতীশ কুমার। লালু প্রসাদ জেডি(ইউ)-এর থেকে বেশি আসন পাওয়া সত্ত্বেও। কিন্তু এই নির্বাচন প্রমাণ করে দিল, বিহারে শেষপর্যন্ত থেকে গেল জাতপাতের রাজনীতিটাই। যেটি উন্নয়নের স্লোগান বা ধর্মীয় মেরুকরণ দিয়েও ঢাকা গেল না। নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহের স্বপ্ন চুরমার করে বিজেপি এক ধাক্কায় তৃতীয় স্থানে চলে গেলেও দলের দাবি, তাদের ভোটব্যাঙ্ক কিন্তু অটুট রয়েছে। সেটি কমে গিয়েছে, তা নয়। কিন্তু জাতপাতের পাটিগণিতে মহাজোট বাজিমাত করল।

বিজেপিকে ধরাশায়ী করে মহাজোটের এই জয় জাতীয় রাজনীতিতেও বড়সড় প্রভাব ফেলল। জাতীয় রাজনীতিতে ফের বিহার আরও একবার বড়সড় ছাপ ফেলল। একসময়ে চম্পারণ থেকে সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করে গোটা দেশে প্রভাব ফেলেছিলেন মোহনদাস কর্মচন্দ্র গাঁধী। জরুরী অবস্থার সময় জয়প্রকাশ নারায়ণের হাত ধরে দেশজুড়ে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। আর আজ লোকসভা নির্বাচনে দেশজুড়ে নরেন্দ্র মোদীর হাওয়া থমকে দিলেন জয়প্রকাশেরই দুই শিষ্য। এরফলে লালু যেমন একদিকে আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠলেন, তেমনই বিজেপিকে পারস্ত করে জাতীয় রাজনীতিতে নিজের কাঁধ আরও বাড়িয়ে নিলেন নীতীশ কুমার। তিনি এ বারে যে শুধু মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতেই বসবেন তা নয়, ভবিষ্যতে মোদীকে মোকাবিলায় জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপি-বিরোধী শক্তিগুলির মুখও হয়ে উঠলেন।

মোদীর রথের চাকা থামাতে লালু-নীতীশের এই মেলবন্ধনের পিছনে সবথেকে গুরুদায়িত্ব যিনি পালন করেছেন, তিনি সনিয়া ও রাহুল গাঁধী। গোড়ার দিকে নীতীশের সঙ্গে হাত মেলাতে গড়িমসি করছিলেন লালু প্রসাদ। কিন্তু জাতপাতের পাটিগণিতে বাজি মারতে তিনজনকে একজোট যে হতেই হবে, সে কথা বারবার বুঝিয়েছেন সনিয়া-রাহুল। যদিও শুধু জাতপাতের অঙ্ক মেনে যে এই ফল এসেছে তা মানতে চাইছে না অনেকে। গুলাম নবি আজাদের কথায়, মন্ডলের রাজনীতিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে মহাজোট। এরসঙ্গে নীতীশ কুমারের উন্নয়নের মডেলও যোগ হয়েছে। নরেন্দ্র মোদী উন্নয়নের কথা বললেও, লক্ষ কোটির প্যাকেজ ঘোষণা করলেও গত ১৭ মাসে বাস্তবে কোনও উন্নয়নের ছবি মেলে ধরতে পারেননি।

বিজেপি নেতারা আজ স্বীকার করছেন, প্রথমে তাঁরা ভেবেছিলেন লালু-নীতীশ তেলে-জলে মিশবেন না। পাটিগণিতের অঙ্কে তাঁরা বরাবরই এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু বিজেপি সেটাই ভাঙ্গতে চেয়েছে বারবার। প্রতিটি সভায় মোদী-অমিত শাহরা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন জঙ্গলরাজের কথা। কিন্তু আজ দেখা যাচ্ছে, তেলে-জলে সত্যিই মিশ খেয়েছে। আর তাতেই বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক অটুট থাকলেও ভাঙ্গা যায়নি মহাজোটের অঙ্ক। লালু যখন মন্ডল-পার্ট টু ঘোষণা করেছেন, তারপর মোহন ভাগবতের সংরক্ষণ নিয়ে মন্তব্যের বিরোধিতা করে প্রচার করেছেন। হরিয়ানা দলিত মৃত্যুর ঘটনাকে সামনে রেখে বিজেপিকে দলিত বিরোধী বলে প্রচার করেছেন। নিজের মুসলিম ও যাদব ভোটব্যাঙ্কে কোনও ফাটল ধরতে দেননি। বারবার বলেছেন, লালু না থাকলে যাদববংশও থাকবে না।

অমিত শাহ ভেবেছিলেন, লালু-নীতীশ মুসলিম, যাদব, কুর্মি ভোট অটুট রাখলেও বাকি সম্প্রদায় বিজেপির দিকে আসবে। নরেন্দ্র মোদীর উন্নয়নের স্লোগানে জাতপাতের অঙ্ক চুরমার হয়ে যাবে। জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে ভোট দেবে যুব সম্প্রদায়। জঙ্গলরাজের ভয়ে মহিলারা হবেন বিজেপিমুখী। ঠিক যেটি হয়েছিল লোকসভা নির্বাচনে। কিন্তু তা হয়নি। শেষ বেলায় অমিত শাহের মেরুকরণের দাওয়াইতেও এককাট্টা হননি হিন্দুরা। অমিত শাহের বাড়িতে বৈঠকে এখন চুলচেরা বিশ্লেষণ হচ্ছে, কোন জাতের ভোট পেল বিজেপি। দলিতের একাংশ আর উচ্চবর্ণের ভোট পেলেও মুসলিমদের সঙ্গে যাদব, কুর্মির মত প্রভাবশালী মধ্যবিত্তের ভোটও গিয়েছে মহাজোটের ঝুলিতে।

বিজেপির দ্বিমুখী কৌশল যেখানে ভেস্তে গিয়েছে, সেখানে লালু-নীতীশের কৌশল কিন্তু কাজ দিয়েছে। মোদী-শাহকে গাল পেড়ে, নরভক্ষক বলে তাতিয়েছেন লালু প্রসাদ। কিন্তু আগাগোড়া নীতীশ কুমার নিজের সৌম্যভাব বজায় রেখেছেন। কুকথা বলেননি। কিন্তু লালুর ফাঁদে পড়ে পাল্টা আক্রমণাত্মক হয়েছেন মোদী। জাতপাতের অঙ্কে পাল্লা দিতে নিজেকে পিছিয়ে পড়া শ্রেণি হিসেবেও তুলে ধরেছেন। সংরক্ষণের কথা তুলে ধরে মেরুকরণের চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু শেষ বাজারের হুড়োহুড়িতে অঙ্ক মেলাতে পারেননি। জাতপাতের রাজনীতিই সেখানে বড় করে দেখা দিয়েছে। বিজেপির সাংসদ চন্দন মিত্র যে কারণে বলেছেন, মহাজোটের ঢাকঢোল না পিটিয়ে প্রচার, আর মৃদুভাষী নীতীশ কুমারকে তুলে ধরে বাজিমাত করেছে। তাই মানুষ অমিত শাহের তৈরি করা হাই-পিচ প্রচারকে প্রত্যাখ্যান করেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE