Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
বাংলায় মুখরক্ষা বিজেপির

অন্য রাজ্যে ফের আটকাল মোদীর দল

উপনির্বাচনে ফের বড়সড় ধাক্কা। জন্মদিনের এক দিন আগে পাওয়া ‘উপহার’টা নিশ্চিত ভাবেই ভুলে যেতে চাইবেন নরেন্দ্র মোদী। কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পরপরই উত্তরাখণ্ড এবং বিহারের উপনির্বাচনে ধাক্কা খেয়েছিল বিজেপি। এ বার দেশের আট রাজ্যের উপনির্বাচনেও বড় ধাক্কা খেল নরেন্দ্র মোদীর দল। মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানায় বিধানসভা নির্বাচনের আগে উত্তরপ্রদেশে বিজেপির জয়রথ আটকে দিয়ে পুনরুত্থান হল লোকসভায় ধরাশায়ী হওয়া মুলায়ম সিংহ যাদবের। রাজস্থানে বসুন্ধরা রাজের জয়ের ধারাবাহিকতা আটকে গেল কংগ্রেসের কাছে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:২৬
Share: Save:

উপনির্বাচনে ফের বড়সড় ধাক্কা। জন্মদিনের এক দিন আগে পাওয়া ‘উপহার’টা নিশ্চিত ভাবেই ভুলে যেতে চাইবেন নরেন্দ্র মোদী।

কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পরপরই উত্তরাখণ্ড এবং বিহারের উপনির্বাচনে ধাক্কা খেয়েছিল বিজেপি। এ বার দেশের আট রাজ্যের উপনির্বাচনেও বড় ধাক্কা খেল নরেন্দ্র মোদীর দল। মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানায় বিধানসভা নির্বাচনের আগে উত্তরপ্রদেশে বিজেপির জয়রথ আটকে দিয়ে পুনরুত্থান হল লোকসভায় ধরাশায়ী হওয়া মুলায়ম সিংহ যাদবের। রাজস্থানে বসুন্ধরা রাজের জয়ের ধারাবাহিকতা আটকে গেল কংগ্রেসের কাছে। এমনকী মোদীর নিজের রাজ্যেও ‘ক্লিন সুইপ’ তো হলই না, উল্টে কংগ্রেসের কাছে হারাতে হল তিনটে আসন! যার ফলে গোটা বিরোধী শিবির একজোটে বলতে শুরু করল, একশো দিনেই ফিকে হয়ে গিয়েছে মোদী-ঝড়! তবে এ সবের মধ্যে বিজেপির স্বস্তি একটাই। পশ্চিমবঙ্গ। যেখানে প্রায় দেড় দশক পরে বিধানসভায় ফের খাতা খুলল নরেন্দ্র মোদীর দল।

তা হলে কি সত্যিই মোদী-হাওয়া থেমে গিয়েছে?

বিরোধীদের সম্মিলিত উল্লাস আর নিজের দলের কর্মীদের হতাশার মুখে বিজেপি নেতারা অবশ্য বলে চলেছেন, মোদী-ঝড় এখনও অটুট। উপনির্বাচনে হারের কারণ ভিন্ন। কিন্তু তাঁরা এটাও বুঝছেন, পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ সর্বত্রই লোকসভার মেজাজের উল্টো ছবি নিছক কাকতালীয় হতে পারে না! ঘনিষ্ঠ মহলে বিজেপি নেতারা তাই বলছেন, এই ফলকে মোদীর হার বলা যায়। আবার যায়ও না। তাঁদের যুক্তি, নরেন্দ্র মোদীর ভরসাতেই জনগণ কেন্দ্রে একটা শক্তিশালী সরকারের পক্ষে রায় দিয়েছে। কিন্তু সেই সরকারের উপর যে পাহাড় প্রমাণ প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, মাত্র একশো দিনে তা পূরণ করা সম্ভব নয়। তার জন্য সময় চাই। আগামী দিনে যা-ই হোক, সেই পূরণ না হওয়া প্রত্যাশার ছায়া পড়েছে আজ উপনির্বাচনের ফলে। ফলে একে মোদীর হার বলা যেতেই পারে।

আবার উল্টো যুক্তিও আছে। উপনির্বাচনে বহু ক্ষেত্রেই বড় ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে দাঁড়ায় স্থানীয় বিষয়। লোকসভা ভোটের ক্ষেত্রে যেমন দেশের সরকার গঠন, রাজনীতি-অর্থনীতি-বিদেশনীতির মতো বিষয়গুলি জুড়ে থাকে, উপনির্বাচনে তেমন থাকে না। সেখানে বহু ক্ষেত্রেই ভোট হয় স্থানীয় প্রার্থী-সমস্যা-আবেগকে সামনে রেখে। এ বারও বেশ কয়েকটি আসনের ক্ষেত্রে স্থানীয় ‘ফ্যাক্টর’ বিরোধীদের পক্ষে ছিল বলেই প্রাথমিক ভাবে মনে করছেন বিজেপি নেতারা। তা ছাড়া চার মাস আগের লোকসভা ভোটে দলের মুখ হয়ে উঠেছিলেন মোদী। কিন্তু তিনটি লোকসভা এবং ৩২টি বিধানসভার উপনির্বাচনে সেই মুখকে তুলে ধরার কোনও চেষ্টাই করেনি বিজেপি। বরং সেখানে অন্য অঙ্কে বাজিমাত করার চেষ্টা হয়েছিল। সেই অঙ্কটাই মেলেনি।

কী সেই অঙ্ক?

প্রথমত, লোকসভা ভোটে নরেন্দ্র মোদীর তুরুপের তাস ছিল উন্নয়ন। গোবলয়ে এর সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল নরম হিন্দুত্বকে। এই দুই অঙ্কেই গোবলয়ে বিপুল জয় পেয়েছিল বিজেপি। যে সাফল্যের পুরস্কার হিসেবে অমিত শাহকে দলের সভাপতি করেন মোদী। আশা ছিল, অমিত-ম্যাজিক কাজ করবে এ বারেও। কিন্তু দেখা গেল, অমিত শাহ ব্যর্থ। বিজেপিরই অনেকে বলছেন, উপনির্বাচনে উন্নয়নের ধারেকাছে না গিয়ে অমিত শুধুই মেরুকরণের রাজনীতি করতে চেয়েছেন। সঙ্ঘের মাধ্যমে টেনে এনেছেন ‘লাভ-জিহাদ’ বিতর্ক। ব্যবহার করেছেন যোগী আদিত্যনাথের মতো উগ্র হিন্দু মুখকে। নিট ফল? সংখ্যালঘুরা এককাট্টা হয়ে মুলায়মের পুনরুত্থান ঘটালেন। আর হিন্দুত্ব না উন্নয়ন এই হিসেব মেলাতে না পেরেই ব্যর্থ হলেন মোদীর সেনাপতি।

দ্বিতীয়ত, লোকসভায় সর্বশক্তি দেওয়ার পর উপনির্বাচনে ঢিলেমি। বিজেপির ছোট-বড় প্রায় সব নেতাই মেনে নিচ্ছেন, লোকসভা ভোটে যে ভাবে গোটা গেরুয়া শিবির ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, এ বারে তা হয়নি। যার ফলে লোকসভার সময় ধামাচাপা পড়া বিজেপির গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তুলনায় সমাজবাদী পার্টি বা কংগ্রেস অনেক বেশি মরিয়া ছিল বিজেপিকে ধাক্কা দিতে। এককাট্টা হয়ে নিজেদের হারানো জমি ফেরত পেতে। কোথাও প্রার্থী না দিয়ে যে কাজে তাদের পুরোদস্তুর সাহায্য করেছে মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি। বিরোধীরা পুঁজি করেছে ভোটের আগে মোদীর দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ না হওয়াকে। বিরোধীরা ভালই জানে, প্রথম একশো দিনে যাবতীয় প্রতিশ্রুতি পালন সম্ভব নয়। কিন্তু সেটাকেই তুলে ধরে বাজিমাত করেছে তারা। সঙ্গে জাত-পাত, ধর্মের সমীকরণ। যে কারণে রাজস্থান, গুজরাতের মতো বিজেপি শাসিত রাজ্যেও ধাক্কা খেয়েছে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের দল।

সব মিলিয়ে উপনির্বাচনের ফলে পরিস্থিতি যা দাঁড়াল, তাতে বিরোধী দলগুলি আবার ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি পেল। উত্তরপ্রদেশে বিজেপির থেকে সাতটি বিধানসভা আসন ছিনিয়ে ও মৈনপুরীতে লোকসভা উপনির্বাচনে জয় ধরে রেখে মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব আজ তাই মোদীর উন্নয়নমুখী ছবিকে ‘সাম্প্রদায়িক’ তকমা এঁটে দিয়েছেন। বললেন, “মানুষ সাম্প্রদায়িক দলকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এ বারে রাজ্যে আরও উন্নয়ন হবে।” চার মাস আগের নির্বাচনে রাজস্থানে ধাক্কা খাওয়া সচিন পায়লট আজ বিজেপির থেকে তিনটি আসন কেড়ে নিয়ে রীতিমতো হিরো।

বলছেন, “মানুষের মেজাজ বদলাচ্ছে।” আর গুজরাতে মোদী-গড়ের তিনটি আসন ছিনিয়ে কংগ্রেসের শক্তিসিন গহিলরা বলছেন, “এই তো ছিল মোদীর গুজরাত-মডেলের বিপণন! মানুষ বুঝেছেন, পুরোটাই ভাঁওতা।”

অন্য দিকে বিজেপি শিবিরে কিছুটা হলেও ছায়া ফেলেছে হতাশা। ক’দিন আগেই দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজেপির ছাত্র সংগঠনের জয়কে সামনে রেখে গোটা দল ‘মোদী-ঝড়, মোদী-ঝড়’ বলে সরব হয়েছিল। আজ মোদী-ঝড় উচ্চারণই করেনি তারা! জন্মদিনে চিনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকের আগে আজই গুজরাতে পৌঁছেছেন মোদী। প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নেওয়ার পরে এই প্রথম নিজের রাজ্যে। সেখানে তাঁর চোখে-মুখে ছিল হতাশার ছাপ। উপনির্বাচনের ফল নিয়ে সরাসরি কোনও মন্তব্য করেননি। অতীতে গুজরাতেও হিন্দিতে বক্তৃতা দিতেন, যাতে তা পৌঁছয় দেশের সব প্রান্তে। আজ দিলেন শুধুই গুজরাতিতে! উপনির্বাচন কখনওই সামগ্রিক নির্বাচনের জনমানসের প্রতিফলন নয়, সেটি বিলক্ষণ জানে সব দলই। কংগ্রেস নেতৃত্বও জানেন, বিজেপি শাসিত রাজ্য হোক বা কেন্দ্রীয় সরকার জনমত পাঁচ বছরের। ফলে মোদী-অমিত জুটি ফের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনে মোদী-ঝড়ে যে ভাবে বাকি দলগুলি ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল, সেই পরিস্থিতি থেকে অন্তত ফের জমি ফেরতের প্রক্রিয়া শুরু হল। কর্মীদের চাঙ্গা করার জন্য এটি দরকার ছিল। কিন্তু এখনই বিজেপির ক্ষয় ধরতে শুরু করেছে, এটা বলার সময় আসেনি। আনন্দ শর্মারা আজ অন্তত এটুকু বলতে পারছেন, “প্রথম একশো দিনেই মোদীর উলটপুরাণ শুরু হয়েছে!” কিন্তু বিরোধীরা বিলক্ষণ জানেন, আগামী দিনে লড়াই আরওকঠিন হবে। বিজেপিও জানে, আগামী নির্বাচনগুলি আরও কঠিন হবে। মুখতার আব্বাস নকভিরা অবশ্য বলছেন, “শাপে বর হল। বিজেপি কর্মীরা এই হারের পর ফের নতুন উদ্যমে জেগে উঠবে আগামী দিনে।” উপনির্বাচনের ফল আপাতত শক্তি দিল মহারাষ্ট্রে বিজেপির শরিক শিবসেনাকে। গত ক’দিন ধরেই উদ্ধব ঠাকরে বলে আসছিলেন, মোদী-ঝড় বলে কিছু নেই। আসন সমঝোতার আগে আজ বিজেপি নেতৃত্বকে সেই বার্তা ফের স্মরণ করিয়েদিয়েছেন উদ্ধব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

byelection results bjp narendra modi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE