Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

শৌরির বোমায় বিদ্ধ মোদী, পাল্টা আক্রমণ বিজেপিরও

চলতি মাসেই এক বছর পূর্তি হতে চলেছে নরেন্দ্র মোদী সরকারের। তার ঠিক আগে সরকারের বিরুদ্ধে বোমা ফাটালেন এক সময়ে দলের অন্যতম শীর্ষ নেতা তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অরুণ শৌরি। মোদী সরকারের এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তার ব্যর্থতা নিয়ে বিভিন্ন মহল সরব হয়েছে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০১৫ ০৩:৩৪
Share: Save:

চলতি মাসেই এক বছর পূর্তি হতে চলেছে নরেন্দ্র মোদী সরকারের। তার ঠিক আগে সরকারের বিরুদ্ধে বোমা ফাটালেন এক সময়ে দলের অন্যতম শীর্ষ নেতা তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অরুণ শৌরি। মোদী সরকারের এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তার ব্যর্থতা নিয়ে বিভিন্ন মহল সরব হয়েছে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে সেই সূত্র ধরেই মোদী সরকারকে ‘খবরের শিরোনামে থাকতেই বেশি আগ্রহী’ বলে তীব্র কটাক্ষ ছুড়ে দিলেন শৌরি! অনেকেই মনে করছেন, শুক্রবার একটি টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বোমাটি শৌরি ফাটালেও বেশ কিছু দিন ধরেই এতে নীরবে ‘মশলা’র জোগান দিয়েছেন লালকৃষ্ণ আডবাণী, সুষমা স্বরাজ, রাজনাথ সিংহের মতো ‘বিক্ষুব্ধ’ নেতারা।

মোদী সরকারের বর্ষপূর্তির মুখে কেন হঠাৎ এ ভাবে মুখ খুললেন শৌরি? বিজেপির একটি সূত্রের বক্তব্য, এর পিছনে রয়েছে ক্ষোভের রাজনীতি। বাজপেয়ী মন্ত্রিসভার অন্যতম ক্ষমতাশালী মন্ত্রী ছিলেন শৌরি। গত বছর মোদীর মন্ত্রিসভা গঠনের সময় তাঁর নাম সম্ভাব্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসেবে উঠে এলেও শেষ পর্যন্ত ঠাঁই হয়নি তাঁর। তার উপর দলে আডবাণী-মুরলী মনোহর জোশী-শৌরির মতো প্রবীণদের গুরুত্ব ক্রমশ কমিয়েছেন মোদী-অমিত শাহরা। ফলে ক্ষোভ একটা জমছিলই। সরকারের বর্ষপূর্তির প্রাক্কালে শৌরি সেটাই উগড়ে দিয়েছেন বলে মনে করছেন বিজেপি নেতৃত্ব। অস্বস্তি এড়াতে প্রকাশ্যেই শৌরির কড়া সমালোচনা করেছেন দলের নেতারা। বিজেপি মুখপাত্র সম্বিত পাত্র এই প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে কটাক্ষ করে বলেন, ‘‘উনি দলের সুসময়ের বন্ধু!’’ আর কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎমন্ত্রী পীযূষ গয়াল মনে করেন, ‘‘পদ না পেয়েই ক্ষোভে এ সব কথা বলছেন শৌরি!’’

মোদী সরকারের কোন কোন ব্যর্থতা নিয়ে সরব হয়েছেন এনডিএ সরকারের প্রাক্তন বিলগ্নিকরণমন্ত্রী?

কোন বিষয়টি নয়! ‘দিশাহীন’ অর্থনীতি থেকে ‘ভুল’ বিদেশনীতি। পশ্চিমবঙ্গে পুর নির্বাচনে বিজেপির ব্যর্থতা থেকে শুরু করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রশ্নে মোদীর ইতিবাচক ভূমিকার অভাব। প্রায় সবক’টি ক্ষেত্রেই মোদী সরকারকে তুলোধনা করেছেন প্রাক্তন এই সাংবাদিক-নেতা-মন্ত্রী। এমনকী দল তথা সরকারের ব্যর্থতার পিছনে মোদী-অমিত শাহ-অরুণ জেটলির ‘আঁতাঁত’কে আক্রমণ করতেও ছাড়েননি তিনি।

বিজেপির অন্দরে অনেকেই মনে করেন, শৌরির তোলা বেশির ভাগ অভিযোগ ঠিক। বিশেষ করে মোদী-অমিত শাহ-জেটলি— এই ত্রিমূর্তির ভূমিকা নিয়ে তাঁর বক্তব্য সমর্থন করেন দলের বহু নেতা! ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় দলের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, অমিত দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে যে ভাবে ছড়ি ঘোরাতে শুরু করেছেন, তাতে অনেকেই আতঙ্কিত। শৌরি যা বলেছেন, তা অনেকেরই মনের কথা। যদিও প্রকাশ্যে বিজেপি নেত্রী তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নির্মলা সীতারমন বলেন, ‘‘উনি এক দিক থেকে বিচার করছেন। সামগ্রিক ভাবে দেখলে এই ভাবে মূল্যায়ন করতেন না।’’

দিল্লির রাজনৈতিক অলিন্দে মোদী-অমিত-অরুণ, এই ত্রিশক্তিকে নিয়ে আলোচনা নতুন নয়। নতুন হল, বিজেপি শিবিরে শৌরিই প্রথম, যিনি বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুললেন। দিন কয়েক আগেই বিষয়টি নিয়ে সংসদে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা মল্লিকার্জুন খড়্গে। বর্তমানে দলীয় কর্তৃত্বের রাশ মূলত মোদী ও অমিত শাহের হাতে থাকলেও সেই অক্ষে স্থান করে নিয়েছেন জেটলিও। গোটা মন্ত্রিসভায় একমাত্র জেটলিকেই কিছুটা ভরসা করেন মোদী। এতে অন্য মন্ত্রীরা কাজ করার আগ্রহ হারাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে দলের অন্দরেই। শৌরির মতে, রাজনাথ সিংহ, সুষমা স্বরাজ বা নিতিন গডকড়ীর মতো নেতাদের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও মোদী তাঁদের উপর আস্থা রাখেন না।

দল চালানোর প্রশ্নেও মোদীর তীব্র সমালোচনা করেছেন শৌরি। বিশেষ করে লোকসভা নির্বাচনের পরে বিভিন্ন রাজ্যে জয়ের কৃতিত্ব মোদী–অমিত শাহ যে ভাবে ভাগ করে নিয়েছেন, তা ভাল লাগেনি অনেকেরই। আবার এরাই দল হারলে তার দায় ঠেলে দিয়েছেন স্থানীয় নেতাদের ঘাড়ে। দিল্লিতে বিপর্যয়ের পরে আডবাণী-শিবির একবার চেষ্টা করেছিল, যাতে মোদী-অমিত শাহ জুটি হারের দায় নেয়। কিন্তু সেটা রুখতে সক্রিয় হন মোদী-অমিত শাহ। শেষ পর্যন্ত বেঙ্গালুরুতে কর্মসমিতির বৈঠকে হারের দায় ‘সফল ভাবে’ দিল্লির নেতাদের ঘাড়ে ঠেলে দিয়েছেন অমিত শাহ। শৌরির মতে, এর ফলে সংগঠনের ক্ষতি হচ্ছে। বিজেপি যে ভাবে গোটা দেশে ক্ষমতা বিস্তারের নীতি নিয়েছে, তাতে হিতে বিপরীত হবে বলেও মনে করেন তিনি। শৌরির মতে, এতে বিরোধী দলগুলি বিজেপিকে রুখতে এক জোট হচ্ছে। অন্য দিকে মোদী-অমিত-জেটলির আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে শরিকরা বিজেপির সঙ্গে দূরত্ব বাড়াচ্ছে। ফলে বিজেপি ক্রমশ শরিকহীন হয়ে পড়ছে।

দল চালানো এবং সংগঠনের প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গের পুর ভোটে বিজেপির ব্যর্থতাকেও টেনে এনেছেন শৌরি। পশ্চিমবঙ্গে শাসক তৃণমূলের সঙ্গে

সংঘাতের পথে হাঁটলেও সংসদে, বিশেষত রাজ্যসভায় একাধিক বিল পাশের ব্যাপারে তৃণমূলের সাহায্য চায় কেন্দ্রের শাসক দল। এই প্রসঙ্গেই শৌরির প্রশ্ন, কোন যুক্তিতে তৃণমূল সংসদে বিজেপিকে সাহায্য করবে, তা কি এক বারও ভেবে দেখছে দল? ঘটনাচক্রে, লোকসভা নির্বাচনে দেশ জুড়ে বিজেপির তুমুল সাফল্যের হাওয়ায় পশ্চিমবঙ্গেও দলের ভোট এক ধাক্কায় অনেকটাই বেড়ে যায়। কিন্তু সেই ভোট ক্রমশ কমছে। পশ্চিমবঙ্গে সদ্যসমাপ্ত পুরভোটেও তার ছাপ পড়েছে। বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের একাংশ মনে করেন, পশ্চিমবঙ্গে সংগঠন বাড়ানো নিয়ে অনেক কথা বললেও কার্যক্ষেত্রে মোটেই সক্রিয় হননি মোদী-অমিতরা। তার প্রমাণও মিলতে শুরু করেছে।

দলের অভ্যন্তরীণ নীতির পাশাপাশি শৌরি সবচেয়ে বেশি সরব হয়েছেন মোদী সরকারের অর্থনৈতিক নীতি প্রসঙ্গে। তাঁর প্রশ্ন, বিজেপি ক্ষমতায় এলে দেশ দ্রুত সংস্কারের পথে এগোবে বলে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন মোদী। কিন্তু সাফল্য কোথায়? সরকারের সামগ্রিক ব্যর্থতার মূল্যায়ন করতে গিয়ে তাঁর মন্তব্য, ‘‘দেশের অর্থনীতির দিশা কী হবে, তা সরকারের কাছে স্পষ্ট নয়। ফলে সংস্কার থমকে গিয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার হচ্ছে না। উল্টে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বা সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে সরকার।’’ শিল্পমহলের একাংশও এই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে। ব্যর্থতার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী দু’জনকেই দায়ী করে শৌরির বক্তব্য, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সংস্কারহীনতা ও ভুল নীতির ফলে আমেরিকা এ দেশে বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছে। বিদেশনীতির প্রশ্নে মোদী সরকারের চিন-নীতির প্রশংসা করলেও তাঁর পাকিস্তান নীতির সমালোচনা করেছেন তিনি। বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে কোণঠাসা করা হয়েছে বলেও অভিযোগ শৌরির।

প্রকাশ্যে গুরুত্ব না দিলেও শৌরির সমালোচনার পরের দিনই পরিকাঠামো নিয়ে বিভিন্ন দফতরের মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধানমন্ত্রী। সেই বৈঠকে হাজির ছিলেন জেটলিও। শৌরি-প্রসঙ্গে সরাসরি মন্তব্য এড়ালেও জেটলি-সহ দলের একাধিক নেতার বক্তব্য, আর্থিক সংস্কারের ক্ষেত্রে অনেকেই ভেবেছিলেন সরকার বদল হলেই পরিবর্তন হবে। কিন্তু তা আশু না হওয়ায় কিছু ক্ষেত্রের লোকের অসন্তোষ দেখা দিচ্ছে। জেটলির বক্তব্য, নীতি প্রণয়নের সময় সব ক্ষেত্রের ভাল-মন্দ বিচার করে এগোতে হয়। সরকারের কাজ দেশের জন্য নীতি প্রণয়ন করা, কোনও ব্যক্তিবিশেষ বা ক্ষেত্রের জন্য নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE