Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

জমি সংস্কার ফের রাজনীতির জলে

ঠিক আট মাস! এর মধ্যেই জমি আইন সংশোধন নিয়ে নরেন্দ্র মোদী সরকারের যাবতীয় রোমান্টিকতার অবসান ঘটে গেল! ক্ষমতায় আসার পরই সংস্কারের সাহস দেখিয়ে রাতারাতি জমি আইন সংশোধন করতে গিয়েছিল মোদী সরকার।

শঙ্খদীপ দাস
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০১৫ ০২:৫১
Share: Save:

ঠিক আট মাস! এর মধ্যেই জমি আইন সংশোধন নিয়ে নরেন্দ্র মোদী সরকারের যাবতীয় রোমান্টিকতার অবসান ঘটে গেল!

ক্ষমতায় আসার পরই সংস্কারের সাহস দেখিয়ে রাতারাতি জমি আইন সংশোধন করতে গিয়েছিল মোদী সরকার। কিন্তু সেই উদ্যোগে ইতি টেনে সরকার যে উল্টোরথে চড়তে চলেছে, ক’দিন আগেই ইঙ্গিত মিলেছিল তার। আর আজ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজে পেরেক পুঁতলেন কফিনে। আকাশবাণীতে তাঁর ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আজ বলেন, ‘‘আমরা একটা অধ্যাদেশ জারি করেছিলাম। কাল ৩১ অগস্ট তার মেয়াদ শেষ হচ্ছে। আমি ঠিক করেছি, মেয়াদ শেষ হতে দেওয়া হোক। যার মানে হল, আমার সরকার তৈরি হওয়ার আগে যে পরিস্থিতি ছিল, সেটাই ফিরিয়ে দেওয়া হবে।’’

কেন এই সিদ্ধান্ত? কেন্দ্রে সরকার গঠনের আগে যে নরেন্দ্র মোদী বুক ঠুকে শিল্প মহলকে আশ্বাস দিয়েছিলেন, ‘একশো দিনের মধ্যে আইন বদল করেই ছাড়ব’, তিনি কেন ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেলেন? এর জবাবও নিহিত ছিল প্রধানমন্ত্রীর ‘মন কি বাত’-এ। সামনে বিহার নির্বাচন। জমি অধ্যাদেশ নিয়ে জোর খাটাতে গেলে রাজনৈতিক ভাবে হাত পুড়তে পারে। এই প্রেক্ষাপটেই প্রধানমন্ত্রী আজ দাবি করেন, গরিব কৃষকরা যাতে ক্ষেতে জল পান, গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছয়, রাস্তা তৈরি হয়, নতুন প্রজন্ম কাজ পায় সে জন্যই জমি আইন সংশোধন করতে চেয়েছিলেন। প্রতি পদে এ ব্যাপারে কৃষকদের কাছে পরামর্শও চেয়েছেন। অথচ এ ব্যাপারে লাগাতার বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে। কৃষকদের ভয় দেখানো হয়েছে। মোদীর আশ্বাস, ‘‘কৃষকদের ভয় পাওয়ার কারণ নেই। আর আমি এমন কোনও সুযোগও দেব না, যাতে কৃষকদের কেউ ভয় দেখাতে পারে।’’ এর পরই অধ্যাদেশ বাতিল হতে দেওয়ার ঘোষণাটি করেন প্রধানমন্ত্রী।

সন্দেহ নেই আপাত ভাবে এটা এক পা এগিয়ে দু’পা পিছিয়ে আসা, শাসক দল ও কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক পরাজয়। এবং কংগ্রেস তথা সনিয়া ও রাহুল গাঁধীর বড় জয়। কারণ, অন্যান্য বিরোধী দল জমি অধ্যাদেশের কম-বেশি বিরোধিতা করলেও জাতীয় স্তরে এ নিয়ে বিরোধের পরিবেশ গড়ে তুলতে পুরোপুরি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এই দু’জন। প্রত্যাশিত ভাবেই পটনার গাঁধী ময়দানের সভায় আজ তার রাজনৈতিক কৃতিত্ব নিতে ছাড়েননি সনিয়া। বলেন, ‘‘জমি অধ্যাদেশ নিয়ে শেষ পর্যন্ত সরকারকে ঝুঁকতে আমরা বাধ্য করেছি।’’ মোদী সরকারের পিছু হটাকে জোটবদ্ধ বিরোধিতার জয় হিসেবে তুলে ধরেন নীতীশ কুমার, লালুপ্রসাদও। নীতীশ যেমন বলেন, ‘‘দেশের সামনে প্রধানমন্ত্রীকে ঝুঁকতে হয়েছে। হাঁটু মুড়তে হয়েছে। ফেরত নিতে হয়েছে জমি বিল।’’ ২০১৩ সালে ইউপিএ জমানায় পাশ হওয়া জমি আইনকে ‘প্রগতিশীল’ আখ্যা দিয়ে নীতীশ মনে করিয়ে দেন, সে সময় তাঁরা সকলে (নীতীশ তখন বিজেপির জোটসঙ্গী) সেই বিলকে সমর্থন করেছিলেন। অথচ কেন্দ্রের ক্ষমতায় এসেই বিজেপি নেতৃত্ব সেই আইন পাল্টাতে চাইছিলেন। নীতীশ বলেন, ‘‘নীতি আয়োগের বৈঠকেও বলেছিলাম,
এই জমি অধিগ্রহণ বিল কৃষক-বিরোধী। শেষ পর্যন্ত ঝুঁকতে হল সরকারকে।’’ নীতীশের মতে, ‘‘এটা দেশের মানুষের জয়।’’

রাজনীতির খাতায় হারজিতের অঙ্ক কষা চললেও প্রশ্ন উঠছে, লাভটা আসলে কার হল? ক্ষতি হল কার?

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, সব থেকে বড় ক্ষতি হল শিল্প মহলের। অতীতে এক বার এই ধরনের ক্ষতি করেছে পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সরকার। পরে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের দেখানো পথেই রাজ্যে রাজ্যে শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ রুখে দেওয়া হয়েছে। এ বার করল মোদী সরকার। অথচ দু’জনের আপাত উদ্দেশ্যে কোনও ভ্রান্তি ছিল না। উভয়েই চেয়েছিলেন দেশে শিল্প ও পরিকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাড়ুক। আরও বেশি-বিদেশি লগ্নি আসুক। উভয়েরই মত হল, শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। সরকারেরই উচিত জমি অধিগ্রহণ করে শিল্প সংস্থাকে দেওয়া। দেশের জমি এত ছোট ছোট ভাগে ভাগ হয়ে রয়েছে এবং জমির উপরে নির্ভরশীল পরিবারের সংখ্যা এত বেশি যে বর্তমান আইন মোতাবেক সহমতের ভিত্তিতে জমি নেওয়াটা খুবই শক্ত। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, প্রক্রিয়াগত ভুল করলেন দু’জনেই। আর তাই সিপিএম যেমন এখন দলীয় তরফে বুদ্ধদেববাবুর অধিগ্রহণ তত্ত্ব বাতিল করেছে, তেমনই দল ও সঙ্ঘ পরিবারের চাপে মোদীকেও আইন সংশোধন থেকে হাত ধুয়ে ফেলতে হল। পরিণামে পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ যেমন এখন কার্যত অসম্ভব হয়ে উঠেছে, তেমনই জাতীয় স্তরেও শিল্পের জন্য অধিগ্রহণের জটিলতা জিইয়ে রইল।

ঘটনাচক্রে দু’জনেরই ভরসা ছিল বিপুল জনসমর্থনের উপরে। ২০০৬-র ভোটে বুদ্ধদেববাবু বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়ে সরকারে এসেছিলেন। মোদীও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকারে এসেছেন। সংস্কারের পথে দু’জনেই একটু দ্রুত এগোতে চাইছিলেন। কিন্তু সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে জমি নেওয়ার ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট সরকারের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি ছিল। আর মোদী সরকার রাতারাতি জমি আইন সংশোধনে নেমে পড়ার আগে রাজনৈতিক জমি যথাযথ ভাবে তৈরি করেনি। কৃষক সংগঠনগুলির সঙ্গে আগাম কথা বলে প্রেক্ষাপট তৈরি করেনি।

ভবিষ্যতে তবে শিল্প ও পরিকাঠামোর জন্য জমি অধিগ্রহণ সম্ভব হবে কী ভাবে? কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক সূত্রে বলা হচ্ছে, সেই দায়িত্ব এ বার রাজ্যগুলির হাতেই ছেড়ে দেবে কেন্দ্র। সরকারের বক্তব্য হবে, স্থানীয় প্রয়োজনের ভিত্তিতে জমি নীতি প্রণয়ন করুক রাজ্যগুলি। তবে পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ক্ষেত্রে বর্তমান কেন্দ্রীয় আইনে বলা শর্ত রাজ্যগুলিকে পালন করতে হবে। কোনও ভাবেই তার থেকে কম হারে ক্ষতিপূরণ দিলে চলবে না।

গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের এক শীর্ষ সারির অফিসার জানাচ্ছেন, হরিয়ানা ও অন্ধ্রপ্রদেশে জমি অধিগ্রহণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রয়েছে। হরিয়ানায় কৃষকদের কাছ থেকে জমি নিয়ে গুরগাঁও, সোনিপত, পানিপতের মতো নতুন নগরী তৈরি হয়েছে। কিছু দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও সেখানে বড় মাপের কৃষক অসন্তোষের ঘটনা ঘটেনি। কৃষকরা ঠিক মতো ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন ও উন্নয়নের অংশীদার করা হয়েছে তাঁদের। অন্ধ্রেও নতুন রাজধানী শহর নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে কৃষকদের উন্নয়নের অংশীদার করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তাতে কাজও হয়েছে। ফলে সামগ্রিক ভাবে জমি আইন সংস্কারের থেকে কেন্দ্র হাত ধুয়ে ফেলার পর শিল্পায়নের জন্য বাকি সব রাজ্যের সামনে এখন এগুলিই দৃষ্টান্ত হয়ে থাকল। হতে পারে এর থেকেও ভাল নীতি প্রণয়ন করবে কোনও রাজ্য!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE