জনসভার মঞ্চ থেকে নেমে ব্যারিকেডের এ-পারে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। নেতাকে একটি বার ছুঁয়ে দেখার জন্য অনুগামীদের মধ্যে তুমুল উন্মাদনা। ঠেলাঠেলিতে মুহূর্তে বিশৃঙ্খল ও-পারের জমাট বাঁধা ভিড়।
দলীয় সভায় কিংবা ভোট প্রচারে গিয়ে নামী-দামি রাজনৈতিক নেতারা যখন এমন ধারার জনসংযোগ করেন, প্রমাদ গুনতে থাকেন তাঁদের নিরাপত্তারক্ষীরা। দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে এমন সমস্যা এখনও হয়নি ঠিকই। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর বিভিন্ন জনসভায় দলীয় নেতারা যে ভাবে মঞ্চ দখল করে থাকছেন, প্রধানমন্ত্রীর সুরক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত স্পেশ্যাল প্রোটেকশন গ্রুপ (এসপিজি) তাতে সিঁদুরে মেঘ দেখছে। তারা এ বার ঠিক করেছে, দু’-এক জন ছাড়া মোদীর জনসভার মঞ্চে দলীয় নেতাদের উঠতেই দেওয়া হবে না।
নিয়মটি সর্বত্র কঠোর ভাবে বলবৎ করার জন্য কেন্দ্র রাজ্যগুলিকে চিঠি পাঠিয়েছে। ও এই প্রেক্ষাপটে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আধিকারিক মহলে ফের উঠে আসছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরক্ষা প্রসঙ্গ, নিরাপত্তা-বিধি মেনে চলার ব্যাপারে যাঁর বিশেষ সুনাম নেই।
কী বলা হয়েছে কেন্দ্রের চিঠিতে?
তাতে নয়াদিল্লি জানিয়েছে, জনসভায় প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বজায় রাখতে এসপিজি হিমশিম খাচ্ছে। এসপিজি’র ডিরেক্টর সম্প্রতি নর্থ ব্লকের কাছে আক্ষেপ করেছেন যে, প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় নিয়ম-কানুনের কার্যত বালাই থাকছে না। নেতারা দলে দলে মঞ্চে উঠে পড়ছেন। এমন অনেকেই মোদীর কাছাকাছি চলে আসছেন, যাঁদের সম্পর্কে এসপিজি-র কাছে আগাম তথ্য থাকছে না!
ফলে রীতিমতো ঝুঁকি নিয়েই প্রধানমন্ত্রীর জনসভা হচ্ছে বলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে অভিযোগ করেছে এসপিজি। তাদের দাবি, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, জম্মু-কাশ্মীর ও দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক নির্বাচনী জনসভাগুলোর প্রায় প্রতিটিতে নিরাপত্তার গাফিলতি হয়েছে। পাশাপাশি নিয়মকে গুলি মেরে অনেক জায়গায় যে ভাবে শেষ মুহূর্তে সভাস্থল পাল্টে দেওয়া হচ্ছে, সেটাও প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার পক্ষে প্রভূত বিপজ্জনক।
এসপিজি’র এই সব আশঙ্কার কথা উদ্ধৃত করে রাজ্যের মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রকে চিঠিটি লিখেছেন কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেট সচিবালয়ের নিরাপত্তা সংক্রান্ত সচিব এসবি অগ্নিহোত্রী। তাঁর বক্তব্য: এসপিজি ডিরেক্টরের আপত্তির প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে নতুন সিদ্ধান্ত হয়েছে। সব রাজ্যকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর আশপাশে দলীয় নেতাদের ভিড় করতে দেওয়া যাবে না। মঞ্চে শুধু এক বা দু’জন নেতা থাকবেন। কারা মঞ্চে উঠবেন, সভার অন্তত তিন দিন আগে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের পুলিশ এবং এসপিজি যৌথ ভাবে বসে তা চূড়ান্ত করবে। সেই তালিকা পাঠিয়ে দিতে হবে কেন্দ্রের কাছে।
নবান্ন-সূত্রের খবর: প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা সম্পর্কে এসপিজি’র যে প্রশ্ন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে একই প্রশ্ন তুলেছেন এ রাজ্যে তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এসএসডব্লিউ। মমতার জন্য বহাল রয়েছে সর্বোচ্চ স্তরের ‘জেড-প্লাস’ সুরক্ষা-বলয়। যার অর্থ, তাঁর জীবনের ঝুঁকি রয়েছে। কিন্তু আধিকারিকদের অভিযোগ, বারবার বলা সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রী সুরক্ষা-বিধি ঠিকঠাক মানছেন না। তাঁর সভামঞ্চে দলীয় নেতাদের উপস্থিতি দেখার মতো। কলকাতায় তিনি বুলেটপ্রুফ গাড়ি চড়েন না। উপরন্তু বসেন সামনের আসনে, চালকের পাশে। আর জেলা সফরে গেলে তো মুখ্যমন্ত্রী হামেশাই যাবতীয় আগল ভেঙে জনতার ‘কাছাকাছি’ পৌঁছে যান!
বস্তুত মুখ্যমন্ত্রীর মতো ভিভিআইপি-র এ হেন আচরণ যুক্তিযুক্ত কি না, সেই প্রশ্নে প্রশাসনিক মহল আগেও তোলপাড় হয়েছে। যাকে ফের উস্কে দিয়েছে দিল্লির চিঠি। এক এসএসডব্লিউ-অফিসারের কথায়, ‘‘নরেন্দ্র মোদী নিজে নিরাপত্তার যাবতীয় বিধি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা সত্ত্বেও এসপিজি উদ্বিগ্ন। এ দিকে এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রতি দিন নিজেই নিজের নিরাপত্তা ভাঙছেন! বুঝতে অসুবিধে নেই, তাঁকে নিয়ে আমরা কতটা চিন্তিত।’’
তবে মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ম মানাতে না-পারলেও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এসপিজি-র ফরমান মেনে চলবে। কী রকম?
নবান্নের এক কর্তা জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর জনসভার মঞ্চে দু’-এক জন দলীয় নেতা থাকতে পারবেন। অন্য নেতাদের জন্য মোদীর মঞ্চের ‘ফ্রন্ট স্টেরাইল এরিয়া’-র বাইরে আলাদা মঞ্চ বানাতে হবে। অর্থাৎ, ওঁরা কোনও ভাবেই প্রধানমন্ত্রীর ধারে-কাছে ঘেঁষতে পারবেন না। তা হলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে স্থানীয় নেতারা কি দেখা করবেন না?
তেমনটা অবশ্য নয়। এসপিজি বলেছে, প্রধানমন্ত্রীর মঞ্চের পিছনে, ‘রিয়ার স্টেরাইল এরিয়া’র বাইরে একটি এলাকা চিহ্নিত করে রাখা হবে। ওই ‘মিট অ্যান্ড গ্রিট এরিয়া’য় দাঁড়িয়ে স্থানীয় নেতারা প্রধানমন্ত্রীর দর্শন পাবেন, তাঁকে অভ্যর্থনাও জানাতে পারবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy