Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

শর্ত গোপন রেখেই নাগা-চুক্তি কেন্দ্রের

ছ’দশক পরে অবশেষে শান্তি চুক্তি। বিস্তর প্রাণহানির পরে ১৯৯৭ সালে নাগাল্যান্ডের জঙ্গি সংগঠন এনএসসিএন আইজ্যাক-মুইভা (আইএম) শাখার সঙ্গে সংঘর্ষবিরতি করে শান্তি আলোচনা শুরু করেছিল কেন্দ্র।

চুক্তির পর। এনএসসিএন(আইএম)-এর সাধারণ সম্পাদক মুইভার সঙ্গে মোদী। সোমবার দিল্লিতে। ছবি: পিটিআই।

চুক্তির পর। এনএসসিএন(আইএম)-এর সাধারণ সম্পাদক মুইভার সঙ্গে মোদী। সোমবার দিল্লিতে। ছবি: পিটিআই।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি ও গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০১৫ ০৩:১৯
Share: Save:

ছ’দশক পরে অবশেষে শান্তি চুক্তি।

বিস্তর প্রাণহানির পরে ১৯৯৭ সালে নাগাল্যান্ডের জঙ্গি সংগঠন এনএসসিএন আইজ্যাক-মুইভা (আইএম) শাখার সঙ্গে সংঘর্ষবিরতি করে শান্তি আলোচনা শুরু করেছিল কেন্দ্র। এর পর কেটে গিয়েছে ১৮ বছর। অন্তত ২২ বার দু’পক্ষ বসেছে শান্তি আলোচনায়। কয়েক দফায় বদল হয়েছে মধ্যস্থতাকারী। বদলেছে চুক্তির শর্তও।

অবশেষে আজ চুক্তির পর নাগাল্যান্ডে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পাওয়া গেল বলে দাবি করেছে কেন্দ্র। কোন শর্তে এই চুক্তি হল, তা স্পষ্ট করা হয়নি। যদিও সেই শর্তের উপরেই নাগাল্যান্ড তথা উত্তর-পূর্বে শান্তি ফেরার বিষয়টি অনেকাংশে নির্ভর করছে বলে বিশেষজ্ঞদের মত।

এনএসসিএনের অন্য গোষ্ঠী— এনএসসিএন খাপলাং-কে নিয়ে কেন্দ্রের উদ্বেগ অবশ্য রয়েই যাচ্ছে। গত জুন মাসে মণিপুরে সেনা কনভয়ে হামলা চালিয়ে ২০ জন জওয়ানকে খুন করেছিল এনএসসিএন খাপলাং, আলফা, কেএলও, এনডিএফবি (সংবিজিৎ)-এর জঙ্গি গোষ্ঠীর যৌথ বাহিনী। সেই হামলায় প্রধান ভূমিকা ছিল খাপলাং-এরই।

সমস্যার সূত্রপাত স্বাধীনতার সময় থেকেই। ১৯৪৭ সালের ১৪ অগস্ট নেতাজির অনুগামী আঙ্গামি জাপু ফিজো নাগাল্যান্ডকে ‘স্বাধীন’ বলে ঘোষণা করেছিলেন। যার জন্য গ্রেফতার হন তিনি। জেল থেকে বেরিয়ে এসে ফের আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন ফিজো। সেই শুরু। এর পর ছ’দশকের বন্ধুর পথ।

আজ বিকেলেই টুইট করছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী— ‘আজ এক ঐতিহাসিক ঘোষণা হবে।’ সন্ধে ছ’টার সময়ে প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের উপস্থিতিতে শান্তি চুক্তিতে সই করেন এনএসসিএন আইএম-এর সাধারণ সম্পাদক মুইভা। সেই ছবিও টুইট করেন মোদী। বলেন, ‘‘এই ঐতিহাসিক চুক্তি নাগাল্যান্ডকে প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।’’ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ও লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা মল্লিকার্জুন খড়্গেকে ফোন করেও গোটা বিষয়টি জানান প্রধানমন্ত্রী।

তবে প্রশ্ন হল, শাসক শিবির একে ‘বড় সাফল্য’ বলে দাবি করলেও চুক্তি নিয়ে ভেঙে বলতে চায়নি কোনও পক্ষই। সরকারি ভাবে কেবল জানানো হয়েছে, চুক্তির বিস্তারিত শর্ত ও তা কী ভাবে রূপায়িত করা হবে তা পরে জানানো হবে। উত্তর-পূর্বের বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চুক্তির শর্তের উপরেই শান্তি চুক্তির সাফল্য নির্ভর করছে। কারণ, শর্ত প্রকাশ না হওয়ায় নাগাল্যান্ড-সহ গোটা উত্তর-পূর্বে ইতিমধ্যেই তলায় তলায় উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। যাদের সঙ্গে চুক্তি, সেই এনএসসিএন আইএম গোষ্ঠীর একাধিক শীর্ষ নেতাই বলছেন, বৃহত্তর ‘নাগালিম’ (অসম, মণিপুর ও অরুণাচলের নাগা অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে বৃহত্তর নাগাল্যান্ড) রাজ্য গঠিত না হলে এই চুক্তি অর্থহীন। নাগা ছাত্র সংগঠন এনএসএফ জানিয়েছে, শর্ত না জেনে তারা কোনও মন্তব্য করবে না।

সরব মুইভা-বিরোধী শিবিরও। কিতোভি গোষ্ঠীর শীর্ষ নেতা অ্যালেজো চাকেসং বলেন, ‘‘মনে হচ্ছে না মুইভা বৃহত্তর ও ঐক্যবদ্ধ নাগালিম আদায় করতে পেরেছেন বলে। তা ছাড়া মুইভা নিজে মণিপুরের টাংখুল নাগা গোষ্ঠীর প্রতিনিধি। সমগ্র নাগাল্যান্ডকে প্রতিনিধিত্ব করার স্বীকৃতিই তাঁর নেই।’’

ফলে ধোঁয়াশা পূর্ণমাত্রায়। উঠেছে একাধিক প্রশ্নও।

প্রথমত, এনএসসিএন আইএমের লড়াই ছিল বৃহত্তম নাগালিমের প্রশ্নে। কিন্তু পড়শি তিন রাজ্যই জানিয়েছে, নাগা চুক্তির স্বার্থে তারা কোনও অঙ্গহানি বা প্রশাসনিক বদল মানবে না। গত মাসেই মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী ওক্রাম ইবোবি সিংহ আরও এক বার তা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন। একই অবস্থান অসম ও অরুণাচলের। ফলে চুক্তির শর্তে যদি অন্য রাজ্যের সীমানা পরিবর্তনের প্রচেষ্টা হয়, সে ক্ষেত্রে নতুন সংঘর্ষের মুখোমুখি হতে চলেছে উত্তর-পূর্বাঞ্চল।

দ্বিতীয়ত, চুক্তিতে যদি কোনও ভাবে বৃহত্তর নাগা রাজ্য গঠনের শর্ত না থাকে, সে ক্ষেত্রে মুইভা তথা এনএসসিএন আইএম নেতাদের পক্ষে স্থানীয় নাগা আবেগকে সন্তুষ্ট করা বেশ কঠিন। মুইভা যে গোষ্ঠীর মানুষ, সেই টাংখুল নাগাদের প্রাধান্য রয়েছে এনএসসিএন আইএমে। কিন্তু তার বাইরে আম নাগা জনমানস এবং দলের শীর্ষ নেতাদের কাছে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে মুইভাকে।

তৃতীয়ত, দিল্লির প্রতি মুইভা গোষ্ঠীর নরম অবস্থানের কারণেই জন্ম হয়েছিল কট্টর এনএসসিএন খাপলাং গোষ্ঠীর। এখন বৃহত্তর নাগালিমের প্রশ্নে মুইভারা যদি নিজেদের অবস্থান থেকে সরে আসেন, সে ক্ষেত্রে নাগা জনমানসে তীব্র অসন্তোষের সৃষ্টি হবে। গোয়েন্দাদের আশঙ্কা, এর ফায়দা নেবে খাপলাং গোষ্ঠী।

ফলে আগামী দিনে নাগাল্যান্ড কোনও পথে হাঁটতে চলেছে তা গোটাটাই নির্ভর করছে চুক্তির শর্তের উপর। সরকারি সূত্র বলছে, আজ তাই পরিকল্পিত ভাবেই চুক্তির শর্ত সামনে আনা হয়নি। আগামী দিনে উত্তর-পূর্বের পরিস্থিতি বিচার করেই ওই শর্ত প্রকাশ করবে নয়াদিল্লি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE