Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

কাবুল থেকে মালদহ ঘুরে মাদক দিল্লিতে!

আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তান। সেখান থেকে বিমানে বাংলাদেশ। ও পার থেকে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত টপকে এ পারের মালদহ। তার পর ট্রেনে উত্তরপ্রদেশ হয়ে সোজা রাজধানী দিল্লি। পুলিশের কথায়— এই হল আফগান মাদকের যাত্রাপথ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৬ ০৩:১৮
Share: Save:

আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তান। সেখান থেকে বিমানে বাংলাদেশ। ও পার থেকে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত টপকে এ পারের মালদহ। তার পর ট্রেনে উত্তরপ্রদেশ হয়ে সোজা রাজধানী দিল্লি। পুলিশের কথায়— এই হল আফগান মাদকের যাত্রাপথ।

গত সপ্তাহেই রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্ট বলেছিল, ভারত হয়ে আফগানিস্তান থেকে হেরোইন ও কোকেনের মতো মাদক পাচার হচ্ছে অন্যান্য দেশে। কিন্তু সেই হেরোইন যে আফগানিস্তান থেকে বাংলাদেশ ঘুরে মালদহ হয়ে দিল্লিতে ঢুকছে, এ বার তার প্রমাণ মিলল। মালদহ থেকে অপারেশন চালানো এই আন্তর্জাতিক মাদকচক্রের সন্ধান পেয়েছে দিল্লি পুলিশের স্পেশ্যাল সেল। ইতিমধ্যেই চার জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যাদের মধ্যে তিন জনই মালদহের। সম্প্রতি ‘উড়তা পঞ্জাব’-এর দৌলতে মাদক চক্র এবং সীমান্ত পেরিয়ে মাদক আনা-নেওয়ার কাহিনি দেশ জুড়ে ঝড় তুলেছে। সেই ধরনের নেটওয়ার্কে এ বার এ রাজ্যের নামটাও জড়িয়ে গেল। নাটকীয় ভাবে এই মাদক চক্রের খোঁজ মেলার পর এ বার তার গভীরে পৌঁছতে চাইছে দিল্লি পুলিশ।

নাটকের শুরু বৃহস্পতিবার উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে গোকুলপুরীর উড়ালপুলের নীচে। সূত্রের মাধ্যমে পুলিশ খবর পায়, ৪ কিলোগ্রাম ওজনের খুব ভাল মানের হেরোইন হাতবদল হতে চলেছে সেখানে। খবর মিলেও যায়। হেরোইন সমেত ধরা পড়ে মালদহের গণেশ হালদার ও মানিক বিশ্বাস। উত্তরপ্রদেশের বরেলীর মাদক পাচারকারী জোহরির হাতে সেই হেরোইন তুলে দিতে এসেছিল তারা। পুলিশের মতে, আন্তর্জাতিক বাজারে অত্যন্ত ভাল মানের ওই ৪ কেজি হেরোইনের দাম অন্তত ১৬ কোটি টাকা!

গণেশ ও মানিককে জেরা করে জানা যায়, তাদের চক্রের আসল চাঁই সমীর মল্লিক। এই সমীরই মালদহ থেকে উত্তরপ্রদেশ ও দিল্লির বিভিন্ন জায়গায় হেরোইন পাচার করে। এর পরে আর দেরি করেননি পুলিশ কর্তারা। স্পেশ্যাল সেলের ইন্সপেক্টর আট্টার সিংহর নেতৃত্বে একটি দল পশ্চিমবঙ্গ রওনা হয়। স্থানীয় পুলিশের সাহায্য নিয়ে রবিবার বীরভূমের সিউড়ির হাটজন বাজারে তার গ্রামের বাড়ি থেকে সমীরকে পাকড়াও করা হয়। আদতে মালদহের বাসিন্দা সমীর বছর দশেক আগে সিউড়িতে বাড়ি ও গুঁড়ো সাবানের কারখানা খোলে। দিল্লি নিয়ে আসার পর জেরায় সমীর জানিয়েছে, গত দশ বছর ধরে সে এই কারবারে যুক্ত। সে হেরোইন জোগাড় করত মালদহর রিজাউল নামে মাদক চক্রের এক ‘কিঙ্গ পিন’-এর থেকে। এই রিজাউলের সঙ্গে সমীরের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল কিশোর নামে মালদহের আর এক কুখ্যাত ড্রাগ মাফিয়া। পুলিশ জানতে পেরেছে, কিশোর এখন জেলে। এ বার রিজাউলের খোঁজে নামছে পুলিশ।

স্পেশ্যাল সেলের ডেপুটি কমিশনার সঞ্জীব যাদব বলেন, ‘‘মালদহের গ্যাংটির উপরে চার মাস ধরে নজরদারি চলছিল। তখনই জানা যায়, মালদহ থেকে বরেলী হয়ে দিল্লিতে আসছে হেরোইন।’’ যাদবের মতে, কালিয়াচক এলাকায় প্রচুর বেআইনি আফিমের চাষ হয়। তা থেকে হেরোইন তৈরি হয়। কিন্তু তার পাশাপাশি আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশের মাধ্যমেও হেরোইন-কোকেন মালদহে ঢুকছে। ছড়িয়ে পড়ছে গোটা উত্তর ভারতে। যাদবের দাবি, এই সব মাফিয়াদের রেকর্ড পুড়িয়ে ফেলার জন্যই কিছু দিন আগে কালিয়াচকে অশান্তি বাধিয়ে থানায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্ট বলছে— চিন, ইজরায়েলের বাজারে আফগান হেরোইনের বেশি দাম মেলে। তাই তাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্সের মতো ভারতের মাটিকে ‘ট্রানজিট’ হিসেবে ব্যবহার করে ড্রাগ মাফিয়ারা। শুধু ট্রানজিট নয়, দিল্লি পুলিশের বক্তব্য, গত কয়েক বছরে দিল্লি, গুড়গাঁও, নয়ডা সংলগ্ন এলাকায় ভাল মানের হেরোইন ও কোকেনের চাহিদাও তৈরি হয়েছে। মাদকাসক্তদের মধ্যে হেরোইনের চাহিদা বেশি, নিশি-হুল্লোড়ে কোকেন। দিল্লিতে বসবাসকারী নাইজেরীয়দের মাধ্যমেও সেই ড্রাগ বিভিন্ন মহলে ছড়িয়ে পড়ছে।

বাজার বুঝেই জোহরির মতো ড্রাগ মাফিয়া মালদহের সঙ্গে দিল্লির যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে উঠেছিল বলে পুলিশের দাবি। বছর আঠাশের জোহরি দু’বছর আগেও উত্তরপ্রদেশের স্থানীয় বাজারে হেরোইন বিক্রি করত। কিন্তু দিল্লির বাজারে ভাল দাম মিলবে বুঝে আন্তঃরাজ্য মাদকচক্রের জাল বিছিয়ে বসে। মূলত ফোনেই বরাত দেওয়া হতো। মাদক পৌঁছে দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মিলে যেত টাকা। কিন্তু সেই হেরোইন কাদের কাছে বিক্রি হচ্ছে, তা জানার চেষ্টা করা বারণ ছিল।

গণেশ-মানিককে জেরা করে পুলিশ জেনেছে, ব্যাগের লুকোনো খোপে ছোট ছোট প্যাকেটে হেরোইন লুকিয়ে ফেলা হতো। তার পর মূলত ট্রেনে চেপে দিল্লির নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে যেত। দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের মাধ্যমে সমীরের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হয় বলে গণেশ-মানিক জানিয়েছে। ধৃতদের কাছ থেকে পাঁচটি মোবাইল ফোন ও একগুচ্ছ সিমকার্ড মিলেছে। যা থেকে এই চক্রের বাকিদের নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করছে পুলিশ। এক তদন্তকারী অফিসারের কথায়, ‘‘যা মিলেছে, তা হিমশৈলের চুড়ো। এর জাল কত দূর ছড়ানো, এই মুহূর্তে সেটা আন্দাজ করাও মুশকিল!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Drug trafficin Delhi Afghanistan Malda
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE