Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

নেত্রদানের মুহূর্তের দিকে চেয়ে ভক্তরা

বাবার বলা ১৯ বছর আগেকার একটা কথা আজ দিনভর মনে পড়ছে বিজয় ওরফে বিজু দত্ত মহাপাত্রের। যে দায়িত্ব আজ বিজুর কাঁধে, প্রায় দু’দশক আগে জগন্নাথদেবের নবকলেবরের সময়ে সেই দায়িত্ব সম্পন্ন করেছিলেন তাঁরই বাবা নীলকান্ত দত্ত মহাপাত্র।

বাঘ দরজার সামনে চিত্রকর বিজু দত্ত মহাপাত্র। ছবি: রণজিৎ নন্দী।

বাঘ দরজার সামনে চিত্রকর বিজু দত্ত মহাপাত্র। ছবি: রণজিৎ নন্দী।

ঋজু বসু
পুরী শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০১৫ ০৩:৩৮
Share: Save:

বাবার বলা ১৯ বছর আগেকার একটা কথা আজ দিনভর মনে পড়ছে বিজয় ওরফে বিজু দত্ত মহাপাত্রের।

যে দায়িত্ব আজ বিজুর কাঁধে, প্রায় দু’দশক আগে জগন্নাথদেবের নবকলেবরের সময়ে সেই দায়িত্ব সম্পন্ন করেছিলেন তাঁরই বাবা নীলকান্ত দত্ত মহাপাত্র। যিনি বলতেন, জগন্নাথদেব, বলভদ্র আর মা সুভদ্রার চক্ষুদানের সময়ে মনটা পুরোপুরি জগন্নাথেই সমর্পণ করতে। বলতেন, ‘‘মন হল অর্জুন! সারথি জগন্নাথ। আর কিছু ভাবতে হবে না, সব ঠিকঠাক হবেই।’’

বৃহস্পতিবার বিকেলে, ‘প্রভুর’ নবকলেবর ধারণ সম্পূর্ণ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে সেই কথা বলতে বলতেই বিভোর হয়ে উঠছেন প্রৌঢ়।

সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে গেলে বিজুর হাতের রূপটানেই শুক্রবার দুপুরে নেত্র উত্সব সম্পূর্ণ হবে জগন্নাথদেবের। চন্দনচর্চিত অঙ্গে সুসজ্জিত দয়িতাপতি, মন্দিরের অন্য সব সেবায়েত, কর্মচারীদের সামনে তার পরেই প্রভুর নবযৌবন মূর্তি প্রকট হবে।

জগন্নাথদেবের এই ‘মহা অনশর’ বা ‘মহা অসুস্থতা’ পর্বে এত দিন শুধু দয়িতাপতিরাই প্রভুকে দেখার, সেবা করার অনুমতি পেয়েছেন। গত দিন দুই ধরে দয়িতাপতিদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন এই দত্ত মহাপাত্ররাও। জ্ঞাতি-গোষ্ঠী মিলিয়ে এখন মোট ন’টি পরিবার। জগন্নাথ মন্দিরের আদি যুগ থেকে পরম্পরামাফিক, এই দত্ত মহাপাত্ররাই প্রভুর ‘মুখ শৃঙ্গার’ বা নাক, ঠোঁট, চোখ বসানো থেকে শুরু করে রং করার দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

তবে কুমোরটুলির মূর্তিতে যে শিল্পীরা চক্ষুদান করেন, তাঁদের সঙ্গে দত্ত মহাপাত্রদের ঢের ফারাক। জগন্নাথের চিত্রকরেরা মন্দিরের বাইরে অন্য কোনও শিল্পচর্চার ধার ধারেন না। বছরভর প্রভুর কান্তির আভা অটুট রাখাই তাঁদের একমাত্র কাজ।

জগন্নাথদেবের গায়ের কালো রং তৈরির কাজও অতি গোপনে এই দত্ত মহাপাত্রদের বাড়ির অন্দরে সম্পন্ন হয়। তবে সেটা বাড়ির বৌদের কাজ। সোনার প্রদীপের কালির সঙ্গে আরও কিছু গোপন উপাদান মিশিয়ে বিজুর স্ত্রী নিরুপমা, বিজুর ভাই সঞ্জয়ের স্ত্রী অরুন্ধতীরা কয়েক মাস ধরে তা তিলে তিলে সৃষ্টি করেন। সেই রং গোপনে মন্দিরে নিয়ে যাওয়ার পরেই দত্ত মহাপাত্রদের ‘গুপ্তসেবা’র শুরু।

মন্দিরের পশ্চিমে বাঘ দরজার কাছেই দত্ত মহাপাত্রদের মহল্লা। বাঘ দরজার বাঘের গলায় হাত বুলিয়ে নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে বিজু মন্দির থেকে বেরোলেন। গেট পাহারায় থাকা পুলিশকর্মীরা ‘দত্ত সাব’ বলে সসম্ভ্রমে জায়গা ছেড়ে দিলেন তাঁকে। বিজু বলছিলেন, জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার রঙে কোনও রাসায়নিক মিশবে না। সব প্রাকৃতিক উপদান। তবে সুভদ্রার হলুদ বর্ণে নাকি সোনার গুঁড়োও মেশে। বলভদ্রের ধবধবে সাদা রং শাঁখ থেকে আহরিত। আয়ুর্বেদ গুণসম্পন্ন হরিতাল, হিঙ্গুলের মতো নানা পদার্থেও সুভদ্রার হলুদবরণ গা বা লাল ঠোঁট পূর্ণতা পায়। ‘‘তবে কী করে সব রংটং মেশাই, তা বলা যাবে না! গুপ্তসেবা কিনা!’’— আচমকাই থেমে যান বিজু।

এমনিতে মাসে-মাসেই জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার চোখেমুখে রঙের কাজ করা হয়। কিন্তু নবকলেবরের মহিমা স্বতন্ত্র। বিজুর বড়দা মদনমোহন দত্ত মহাপাত্র পরিবারের তিন প্রজন্মের ন’জনের উপরে এই কাজের দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছেন। রয়েছেন বিজুর ভাই সঞ্জয়, ছেলে রশ্মিরঞ্জন।

এ কালে দত্ত মহাপাত্রদের ছেলেরা কেউ কেউ কলেজ-টলেজও পাশ করছেন। তবে পুরীতে তাঁদের আসল প্রতিপত্তি ওই জগন্নাথসেবার মাহাত্ম্যেই। বিজুর এক ভাই, ধনেশ্বর ওরফে পো মাঝে রগচটা বলে খ্যাত হয়েছিলেন, মারামারি করে জেলেও যান। কিন্তু এলাকার লোকে বলে, জগন্নাথের কৃপায় তিনি এখন একেবারে সন্ত স্বভাবের। দিনে এক বার প্রভুর মহাপ্রসাদ গ্রহণ করে গুপ্তসেবার কাজ করেই চলেছেন। নেত্র-দর্শনের এক দিন আগেই মোটামুটি সব কাজ সেরে রেখেছেন দত্ত মহাপাত্র ভাইয়েরা। শুধু বাকি আছে মাহেন্দ্রক্ষণে চোখের মণিতে তুলির শেষ টান।

নবকলেবরের চূড়ান্ত মুহূর্তে নিরাকার ব্রহ্মের ‘আকার ধারণ’ তার পরই সম্পূর্ণ হবে। গীতার তত্ত্ব মেনে, পুরনো শরীর ছেড়ে জগন্নাথদেবের নতুন শরীর ধারণও পূর্ণতা পাবে চক্ষুদানেই।

ভিড়ের চাপে দুর্ঘটনার আশঙ্কায় মন্দিরে চক্ষুদানের দৃশ্য চাক্ষুষ করার সৌভাগ্য সবার ঘটবে না। তবে পুরী বা ওড়িশা তো বটেই, দেশ-বিদেশের ভক্তরাও সেই লগ্নের দিকে তাকিয়ে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE