মথুরায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সোমবার। ছবি: রয়টার্স
আশ্বাস ছিল ‘আচ্ছে দিন’-এর। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী সরকারের বর্ষপূর্তির দিনে প্রশ্ন একটাই, পরিবর্তন কিছু হলো কি?
অর্থনীতির দিকে তাকালে অবশ্য বদল তেমন কিছু চোখে পড়ছে না। দেশের বাজারে চাহিদা নেই। বিদেশের অবস্থাও তথৈবচ। সুতরাং হাত গুটিয়ে দেশি-বিদেশি সব লগ্নিকারীই। এমনকী, শিল্প-উৎপাদনের সূচক (আইআইপি) বৃদ্ধির হার কমছে। কারখানা, নির্মাণ শিল্প, হোটেল ব্যবসা, পরিবহণ, যোগাযোগ, আবাসন, আর্থিক পরিষেবা— সব ক্ষেত্রেই ছবিটা এক। নতুন শিল্পের জন্য ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেওয়া হচ্ছে না। এই জড়তা কাটাতে সংস্কারের প্রশ্নে যতটা সাহসী হওয়ার দরকার ছিল, তা-ও দেখাতে ব্যর্থ কেন্দ্র। নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসার এক বছর পরে অর্থনীতি ঘিরে এই উদ্বেগটাই দেখা দিচ্ছে বড় হয়ে।
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির অবশ্য ব্যাখ্যা, ‘‘ইউপিএ-আমলের শেষ পর্যায়ে অর্থনীতিতে যে হতাশার পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, এক বছরে তা কেটে গিয়েছে। আমরা যে আর্থিক বৃদ্ধি ও উন্নয়নের পথে হাঁটতে চাই, তা নিয়ে কারও মনে কোনও অস্পষ্টতা নেই।’’ তাঁর মতে, বৃদ্ধির হার খুব দ্রুত ১০ শতাংশ ছোঁবে। কিন্তু বাস্তব বলছে— বৃদ্ধির হারে এই বাড়বৃদ্ধির একটা বড় কারণই হলো হার নির্ধারণের মাপকাঠিটা পাল্টে ফেলা, শিল্পমহলের উদ্দীপনা নয়। মোদী ক্ষমতায় আসার সময় তাঁকে ঘিরে শিল্পপতিদের যে আগ্রহ ছিল, এক বছর পরে তা কার্যত উধাও। অধিকাংশ লগ্নিকারীই গত এক বছরে সরকারের কাজকর্মে খুশি নন। যদিও এখনই সবটুকু আশা ঝেড়ে ফেলতে তাঁরা নারাজ। শিল্পপতিরা বলছেন, ‘কোনও সরকারের বিচার করতে এক বছর সময়টা যথেষ্ট নয়। তাই অখুশি হলেও আমরা পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছি’।
চাহিদা না থাকলে বৃদ্ধি হবে না— এটাই অর্থনীতির সহজ অঙ্ক। এখন প্রশ্ন হল, চাহিদা নেই কেন? বিশেষ করে গত এক বছরে তেলের দাম হু হু করে পড়ল। আর তার জেরে কমলো জিনিসপত্রের দাম। পাইকারি বাজারে মূল্যবৃদ্ধির হার তো এখন শূন্যেরও নীচে! অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আমজনতা যে হাত খুলে কেনাকাটা করার কথা ভাবছেন না, সেটাই অর্থনীতির প্রতি অনাস্থার প্রকাশ। কারণ, সুদিন ফিরবে এই বিশ্বাসই মানুষকে সঞ্চয় কমিয়ে বাজারমুখী করে। এর সঙ্গে গোদের উপরে বিষফোড়া— অকালবৃষ্টি। তার জেরে ফসল নষ্ট হয়েছে। চাষিদের রোজগার কমায় কেনাকাটা কমেছে তাঁদেরও।
বিদেশের বাজার থেকেও কোনও আশার আলো নেই। রফতানির পরিমাণ হু হু করে কমছে। রফতানিকারীরা সাহায্যের আবেদন নিয়ে অর্থমন্ত্রীর দ্বারস্থ। রফতানিকারী সংগঠনের সভাপতি এস সি রলহন বলেন, ‘‘গত ডিসেম্বর থেকেই রফতানি কমছে।’’
চাহিদা না থাকার কারণে লগ্নিও আসছে না বিদেশ থেকে। অথচ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে বিদেশি পুঁজির উপরেই অনেকখানি ভরসা করেছিলেন মোদী-জেটলি। অনেকে বলছেন, এ দেশের অর্থনীতি যে ঝিমিয়ে রয়েছে তার অন্যতম কারণ বিশ্ব বাজারের মন্দার ধাক্কা। মনমোহন সিংহও এই যুক্তিই দিতেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, গোটা বিশ্বে যদি মন্দা চলে, তা হলে ভারত তার থেকে মুক্ত হতে পারে না। এই যুক্তির সঙ্গে আবার সহমত নন অনেক অর্থনীতিবিদই। তাঁদের মতে, এ দেশের অর্থনীতি বিশ্ব-বাণিজ্যের সঙ্গে এতটা অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত নয় যে বিদেশের মন্দার প্রভাব এখানে পড়বে।
জেটলি অবশ্য দাবি করছেন যে, তাঁদের আমলে বিদেশি লগ্নির পরিমাণ তুলনায় বেড়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘২০১৩-’১৪য় ২০৮০ কোটি ডলার বিদেশি লগ্নি এসেছিল। ২০১৪-’১৫য় এসেছে ২৮৮০ কোটি ডলার।’’ শিল্পমহল বলছে, বাড়তি ডলারে যে নতুন শিল্প হয়েছে, তা নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেশি-বিদেশি যৌথ উদ্যোগে বিদেশি সংস্থাগুলির অংশীদারি বেড়েছে। অর্থনীতিতে তার তেমন কোনও প্রভাব পড়েনি।
তা হলে এক বছরে ‘সুদিন’ কতটা এল? আজ মোদী সরকারের বর্ষপূর্তিতে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের কটাক্ষ, ‘‘মোদী সরকার শুধু বিজ্ঞাপন ও বিপণনটাই ভাল বোঝে। কিন্তু এক বছরে বিনিয়োগের পরিবেশে যেমন বদল হয়নি, তেমনই কাজের সুযোগ বাড়েনি। মানুষও বুঝতে পারছে সুদিনের প্রতিশ্রুতি ছিল শুধু বলার জন্য বলা।’’
মথুরায় কংগ্রেসের কটাক্ষ ফিরিয়ে মোদী আজই বলেছেন, ‘‘যাঁরা কুকীর্তি করেছেন, তাঁদের সুদিন আনার কোনও নিশ্চয়তা আমি দিতে পারব না।’’ কিন্তু নিছক ভাষণে যে সরকার সব দায় ঝেড়ে ফেলতে পারবে না, সে কথা বলছেন অনেক অর্থনীতিবিদই। তাঁদের মতে, সরকার অনেক দরকারি কাজ করেনি। যেমন, জমি অধিগ্রহণ বিল বিশ বাঁও জলে। সরকার রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা না-থাকাকেই দায়ী করলেও সিপিএম সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির পাল্টা অভিযোগ, ‘‘সরকার কিন্তু এক বারও সর্বদলীয় বৈঠক ডেকে ঐকমত্য তৈরির চেষ্টা করেনি।’’
যে সব সিদ্ধান্তের জন্য সংসদে ধাক্কা খাওয়ার সম্ভাবনা কম, সেখানেও থমকে রয়েছে সরকার। এখনও একটাও বড় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বা পিএসইউ-এর বেসরকারিকরণ হয়নি। জেটলি বিলগ্নিকরণ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা তোলার কথা বললেও সরাসরি বেসরকারিকরণের কথা বলছেন না। যার অর্থ, বেসরকারি সংস্থার অংশীদারি বাড়বে। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির নিয়ন্ত্রণ সরকার নিজের হাতেই রেখে দেবে। রেলের ক্ষেত্রেও মোদী বলেছেন: বেসরকারি টাকা আসবে, বেসরকারিকরণ নয়।
শ্রম আইনের সংস্কার, যেটুকু হয়েছে, তা নেহাতই মামুলি। শিল্পমহল শ্রম আইনকে এখনও নতুন শিল্প এবং চালু কারখানাকে বড় করার পক্ষে অন্তরায় হিসেবে দেখছে।
অথচ তিরিশ বছর পরে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসা মোদী সরকারের কাছে সব থেকে বড় প্রত্যাশা ছিল, ঝোড়ো গতিতে আর্থিক সংস্কার। মধুচন্দ্রিমার এক বছরেই অপ্রিয় সিদ্ধান্তগুলি নিয়ে নেওয়া শ্রেয়। তা না-হলে পরে রাজনীতির চাপে আর তা করা যায় না। কিন্তু মোদী ধাপে ধাপে এগোনোর পক্ষপাতী। জেটলির যুক্তি, ‘‘আমার কাজ হল সংস্কারের বিষয়ে ধৈর্য ধরে থাকা এবং নিরুৎসাহ না হওয়া।’’
কিন্তু ধাপে ধাপে এগোতে গিয়েই সরকার নানা ভুল করেছে। যেমন, বিদেশি বিনিয়োগকারীর মূলধনী আয়ের ওপর ‘ম্যাট’ বসানো। ফলে বিনিয়োগকারীরা ভয় পেয়েছেন। তাঁদের অনেকেই মনে করছেন, ইউপিএ-জমানার ‘কর সন্ত্রাস’ আবার ফিরে এল। দুই, আয়করদাতাদের কাছে বিদেশ ভ্রমণ সংক্রান্ত হিসেব চাওয়া। তাতেও একটা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। তিন, বাণিজ্যমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের বেফাঁস কথার জেরে খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি নিয়ে সম্পূর্ণ অনিশ্চিত বাতাবরণের জন্ম দেওয়া।
প্রথম দু’টি ক্ষেত্রে ভুল শোধরানোর চেষ্টা করেছেন জেটলি। ম্যাট নিয়ে কমিটি তৈরি হয়েছে। যে আয়কর রিটার্ন ফর্ম নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল, তারও সরলীকরণ হচ্ছে। কিন্তু খুচরো ব্যবসায় ৫১ শতাংশ বিদেশি লগ্নি নিয়ে সরকারের নীতি ও বিজেপির রাজনৈতিক অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত। মোদী-জেটলি দলের চাপ উপেক্ষা করে সংস্কারের পথে টিকে থাকতে চাইছেন বটে, কিন্তু এই টানাপড়েন মোটেই সাহস জোগাচ্ছে না বিদেশি লগ্নিকারীদের।
মোদী সরকারের এই হোঁচট খাওয়া নিয়ে আজ প্রশ্ন তুলেছেন চিদম্বরম। তিনি বলেন, ‘‘কাঠামোগত কোনও বড় সংস্কারের উদ্যোগ সরকারের নেই। তার উপর কিছু বিভ্রান্তিকর ডিগবাজি খেতে দেখা যাচ্ছে সরকারকে। যেমন, প্রত্যক্ষ কর বিধি চালু করার প্রস্তাব ঠান্ডা ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিদেশি লগ্নিকারীদের উপরে ম্যাট প্রয়োগ করা হচ্ছে। আর্থিক সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশনের সুপারিশও মানা হচ্ছে না।’’
জেটলির দাবি, তিনি মূল্যবৃদ্ধিতে রাশ টেনেছেন। এ বার রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার কমালেই নতুন শিল্প আসবে। যা শুনে এ দিন সাংবাদিক বৈঠকে হেসে ফেলেন চিদম্বরম। তার পরে বলেন, ‘‘গত নভেম্বরে পাইকারি মূল্যের সূচক শূন্যে পৌঁছেছিল ঠিকই, কিন্তু জেটলিজি কি সেটা তঁদের সাফল্য বলে দাবি করতে পারবেন? মূল্যবৃদ্ধির হার কমতে শুরু করেছিল ইউপিএ-র সময় থেকেই।’’
অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, মূল্যবৃদ্ধির হার কমার আসল কারণ তেলের দাম কমে যাওয়া। এবং তেলের দাম কমার পিছনে সরকারের কোনও কৃতিত্ব নেই। সেটা নেহাতই বরাত জোর। তেলের দাম ইতিমধ্যেই বাড়তে শুরু করেছে। তার সঙ্গে অকালবৃষ্টি মিলে ফের ঘনাচ্ছে মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা।
দিল্লি নির্বাচনের প্রচারে মোদী বলেছিলেন, ‘সমালোচকরা বলে, আমার বরাত ভাল। তা বরাত যার ভাল, ভোটটা তাকেই দিন।’ দিল্লির ভোটাররা তাঁর কথায় ভোলেননি। কারণ, বরাতের ওপর ভরসা করে বেশি দিন চলা যায় না। প্রধানমন্ত্রী সেই সত্যটা যত শীঘ্র বোঝেন, ততই মঙ্গল।
সহ প্রতিবেদন: শঙ্খদীপ দাস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy