Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

রাজস্থানের নয়া মন্ত্র, ‘এইট পিএম, নো সিএম’

‘এইট পিএম, নো সিএম’। রাজস্থান রসাতলে গেলেও রাত ৮টার পরে মুখ্যমন্ত্রীকে পাওয়া যাবে না। দেখা পাওয়া তো দূর অস্ত। মোবাইল বা টেলিফোনেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা মুশকিল। ওই সময় মুখ্যমন্ত্রীর ‘ব্যক্তিগত জীবন’-এ ব্যাঘাত ঘটানো নিষেধ। সরকারি আমলা থেকে বিজেপি পার্টির অন্দরমহলের সকলেই তাই এখন ‘এইট পিএম, নো সিএম’ মন্ত্র মেনে চলেন।

জয়পুরে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি।

জয়পুরে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি।

প্রেমাংশু চৌধুরী
জয়পুর শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০১৫ ১৯:১৩
Share: Save:

‘এইট পিএম, নো সিএম’।
রাজস্থান রসাতলে গেলেও রাত ৮টার পরে মুখ্যমন্ত্রীকে পাওয়া যাবে না। দেখা পাওয়া তো দূর অস্ত। মোবাইল বা টেলিফোনেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা মুশকিল। ওই সময় মুখ্যমন্ত্রীর ‘ব্যক্তিগত জীবন’-এ ব্যাঘাত ঘটানো নিষেধ। সরকারি আমলা থেকে বিজেপি পার্টির অন্দরমহলের সকলেই তাই এখন ‘এইট পিএম, নো সিএম’ মন্ত্র মেনে চলেন।
গত মাসের কথা। জয়পুরের এক খ্যাতনামা ব্যবসায়ী কিছু সমস্যা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দরবারে গিয়েছিলেন। সিভিল লাইনসের বাসভবনে সকাল ৯টায় ‘অ্যাপয়েন্টমেন্ট’ ছিল মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে। বসুন্ধরা রাজে দেখা দিয়েছিলেন বেলা ১২টায়। দেরির কোনও কারণও দেখাননি তিনি। ‘সরি’ বলা তো দূরের কথা।
এমনিতেই দেখা মেলা ভার। তার উপরে ললিত মোদীর সঙ্গে তাঁর বেআইনি আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ এবং ইস্তফার দাবি ওঠার পর মুখ্যমন্ত্রী সিভিল লাইনসের ১৩ নম্বর বাড়ি থেকে বেরনোই বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বিদেশে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে বৈঠক করতে যাওয়ার কথা ছিল। তা-ও বাতিল করেছেন। নিরাপত্তা কর্মীদের জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, গত এক সপ্তাহে মাত্র এক বারই সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে যোগ দিতে গিয়েছিলেন। আর এক বার নীতি আয়োগের বৈঠকে যোগ দিতে দিল্লিতে। বাকি সময় বাড়িতেই। সেখানেই মন্ত্রী-পারিষদ-আমলাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। আমজনতা তাঁর দেখা পাননি। নিজের পক্ষে যুক্তি দিতে সাংবাদিক সম্মেলনও করেননি। বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরাই ও সব সামলাচ্ছেন।

৩০ জুন অবশ্য একটা ব্যতিক্রম হয়েছিল। জয়পুরের মানসরোবরে শ্রীমদভাগবত জ্ঞানযজ্ঞ এবং লক্ষ্মীনারায়ণ মহাযজ্ঞর আয়োজন হয়েছিল। সেখানে প্রায়ই সাধ্বী প্রিয়ংবদার কথা শুনতে যান বসুন্ধরা। ওই দিনও গিয়েছিলেন। পুজো, আরতি করেছেন। পুরোহিতের আশীর্বাদ চেয়েছেন। সঙ্কট মুক্তির আশায় হাতে লাল সুতোর ‘রক্ষাসূত্র’-ও বেঁধেছেন। লোকসভা ভোটের সময়, বিজেপি-র ভাল ফলের প্রার্থনায় বসুন্ধরার নির্দেশে সরকারি দেবস্থান দফতর এক সপ্তাহ ধরে বিশেষ পুজো-যজ্ঞের আয়োজন করেছিল। খুব শিগ্গিরি ফের সেই নির্দেশ আসতে চলেছে বলে অনেকেই মনে করছেন।

পুজো-আরতি করে, রক্ষাসূত্র বেঁধে রাহুর দশা কাটানোর চেষ্টা করলেও জয়পুরের মানুষ বসুন্ধরার উপর বিরক্ত। বিশেষত ব্যবসায়ী মহল। তা সে হোটেল ব্যবসায়ীই হোন বা ছোট-বড় শিল্পপতি। কারণ, মুখ্যমন্ত্রী কোনও সমস্যার কথা শুনতে চান না। দরকারে দেখা মেলে না। নিজের খেয়ালখুশি মতো চলেন। দল হোক বা সরকার, তাঁর কথাই শেষ কথা। সোজা কথায় একনায়কতন্ত্র। তোষামোদ ভালবাসেন। বিধানসভায় বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দু’বছর আগে ক্ষমতায় এসেছিলেন। তার পর লোকসভা ভোটে রাজস্থান থেকে কংগ্রেস সাফ হয়ে গিয়েছে। তাতে যেন মুখ্যমন্ত্রী ধরাকে আরও সরা জ্ঞান করছেন। ললিত-কাণ্ডে হয়তো বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠায় জিতে আসা বসুন্ধরা সরকারে অস্থিরতা তৈরি হয়নি। কিন্তু মানুষ যে মুখ্যমন্ত্রীর উপর দু’বছরেই বিরক্ত, তা বিজেপি নেতারাও টের পাচ্ছেন। বিজেপি-র এক নেতার কথায়, ‘‘আসলে উনি এখনও নিজেকে মহারানি ভাবেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখেন না। সেটাই সমস্যা।’’

ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। জয়পুর জেলা দায়রা আদালতের উকিল বিনোদ খাণ্ডেলওয়ালের প্রশ্ন, ‘‘বসুন্ধরার আমলে আমজনতার কোনও সুরাহা হয়নি ঠিকই। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী সরকারও কি সুদিন আনতে পেরেছে?’’ মাহেশ্বরী কলেজের কমার্সের ছাত্রী নম্রতা বিয়ানি আবার বলছেন, ‘‘বসুন্ধরা রাজের মতো এমন ক্যারিশ্মা কারও নেই। উনি যে রঙের শাড়ি পরেন, সেটাই ফ্যাশন। শুধু মুখ্যমন্ত্রী নন, উনি আমাদের ফ্যাশন আইকন-ও।’’

শুধু ক্যারিশ্মা-ফ্যাশন দিয়ে কি রাজ্য-রাজনীতি চলবে? জয়পুরের ক্ষমতার অন্দরমহলে ললিত মোদীর সঙ্গে বসুন্ধরা রাজের ঘনিষ্ঠতা নতুন কোনও বিষয় নয়। শুধু এই জমানায় নয়। ২০০৩-এ বসুন্ধরা রাজে যখন মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, তখনও ললিত মোদীর এতটাই প্রভাব ছিল, অনেকে তাঁকে ‘সুপার চিফ মিনিস্টার’ বলে ডাকতেন। আর এখন?

দেশ ছেড়ে লন্ডনে আশ্রয় নিয়েও জয়পুরে ললিত মোদীর ক্ষমতার শিকড় এখনও গভীরে। বিদেশে থেকেই গত বছর রাজস্থান ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন-এর (আরসিএ) প্রেসিডেন্ট পদে জিতে গিয়েছিলেন। তারপরে তাঁকে সেই পদ থেকে সরানো হয়েছে। কিন্তু সোয়াই মান সিংহ স্টেডিয়ামে ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের দফতরের মাথায় এখনও ললিত মোদীর হাসি মুখের ছবি। ‘টিম ললিত মোদী-নিউ এগজিকিউটিভ কমিটি ২০১৪-১৮’-র বিরাট ব্যানার। দফতর অবশ্য বন্ধ। তাঁকে বেআইনি ভাবে আরসিএ-র প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরানো হয়েছে বলে হাইকোর্টে মামলা করেছিলেন ললিত। সবটাই লন্ডনে বসে। মার্চ মাসে আদালতের নির্দেশে আরসিএ-র দফতরে তালা ঝুলিয়ে সিল করে দেওয়া হয়েছে। ‘নিজে আরসিএ-তে না ঢুকলে আর কাউকে ঢুকতেও দেব না’—ব্যানার থেকে হাসি মুখে যেমন এমনটাই বলছেন ললিত।

রাজস্থান ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন

পুরনো বন্ধু ললিতই যে তাঁর গলার কাঁটা হয়ে উঠবেন, ভাবতে পেরেছিলেন বসুন্ধরা? কংগ্রেসের নেতারা বলছেন, বসুন্ধরা-পুত্র দুষ্মন্ত সিংহের সংস্থাকে ১১ কোটি টাকারও বেশি ঋণ দিয়েছিল ললিতের সংস্থা। তার পর দুষ্মন্তের সংস্থার ১০ টাকা দামের এক একটি শেয়ার ৯৬ হাজার টাকা দিয়ে কেনেন ললিত। দুষ্মন্ত ও তাঁর স্ত্রী নিহারিকার নামে থাকা ওই রকম ৩,২৮০টি শেয়ার বসুন্ধরা জন্মদিনে ছেলে-বউমার থেকে উপহার পেয়েছিলেন। যার অর্থ স্পষ্ট। ললিত মোদীর কালো টাকা এসে ঢুকেছে বসুন্ধরার সিন্দুকে।

বসুন্ধরা না হয় মুখে কুলুপ এঁটে দরজায় খিল দিয়েছেন। কিন্তু বিজেপি নেতৃত্ব দুষ্মন্তকে নিয়েও হতাশ। ঝালওয়ারের এই বিজেপি সাংসদ কেন সামনে আসছেন না? জানা গেল, ‘রাজকুমার’ এখন স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে ইউরোপে ছুটি কাটাচ্ছেন। দু’একদিনের মধ্যেই ফিরবেন। ছেলে এসে মায়ের হয়ে মুখ খুলবেন বলে ঘনিষ্ঠ মহলের ধারণা। কংগ্রেস অবশ্য বলছে, তাতেও বিপদ কাটবে না।

২০১৪-য় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে থেকেই সিভিল লাইনসের ১৩ নম্বর বাংলোয় থাকতেন। গদিতে বসলেও ঢিল ছোড়া দূরত্বে সরকারি ‘মুখ্যমন্ত্রী নিবাস’-এ যাননি। সবাই বলতেন, অশুভ ১৩-ই বসুন্ধরার পয়া সংখ্যা। কংগ্রেসের মুখপাত্র অর্চনা শর্মার কটাক্ষ, ‘‘এ বার ওই ১৩ নম্বরই মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অপয়া হয়ে উঠেছে।’’

নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rajasthan Chief Minister Joypur vasundhara raje
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE