Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

রোগ রুখতে লাগাম খুচরো সিগারেটে

সিগারেটের সুখটানে এ বার সরকারি কোপ! খুচরো সিগারেট বেচাকেনার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে চলেছে কেন্দ্র। খেতে হলে কিনতে হবে গোটা প্যাকেট। ক্রেতার স্বাস্থ্যের স্বার্থেই তাঁদের পকেটের উপরে চাপ বাড়িয়ে সিগারেট বিক্রি নিয়ন্ত্রণের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র। তবে একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে, এতে আবার হিতে বিপরীত হবে না তো?

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা ও নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:২৬
Share: Save:

সিগারেটের সুখটানে এ বার সরকারি কোপ!

খুচরো সিগারেট বেচাকেনার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে চলেছে কেন্দ্র। খেতে হলে কিনতে হবে গোটা প্যাকেট। ক্রেতার স্বাস্থ্যের স্বার্থেই তাঁদের পকেটের উপরে চাপ বাড়িয়ে সিগারেট বিক্রি নিয়ন্ত্রণের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র। তবে একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে, এতে আবার হিতে বিপরীত হবে না তো? একসঙ্গে এক প্যাকেট সিগারেট কিনলে ধূমপানের প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে বলে শাসক শিবিরেরই একাংশের আশঙ্কা।

সিগারেটের নেশা ছাড়াতে একাধিক বার ব্যবস্থা নিয়েছে কেন্দ্র। সিগারেটের বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফি-বাজেটে দাম বেড়েছে সিগারেটের। কিন্তু লাভ বিশেষ হয়নি। সিগারেটের প্যাকেটে ফুসফুসের কালো ছবিও ভয় দেখাতে ব্যর্থ ধূমপায়ীদের। প্রকাশ্য ধূমপানে জরিমানার আইন নথিবন্দি আইন হয়েই থেকে গিয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রকের পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর এ দেশে ১০ লক্ষ লোকের মৃত্যুর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণ হল ধূমপান। কোনও তথ্যই ধূমপায়ীদের বিশেষ ভয় দেখাতে পারছে না বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কর্তারা।

কেন্দ্রে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তামাকজাত সামগ্রী বিক্রির ক্ষেত্রে একাধিক নতুন বিধিনিষেধের কথা ভাবা হচ্ছিল। নিজে চিকিৎসক হওয়ার সুবাদে প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধনও গুটখা ও সিগারেটের বিক্রি নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগী হয়েছিলেন। সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জে পি নাড্ডা ‘সিগারেটস অ্যান্ড আদার টোব্যাকো প্রোডাক্টস অ্যাক্ট, ২০০৩’ আরও কঠোর করার দিকেই হাঁটছেন।

পরিস্থিতি বদলের পথ খোঁজার ভার দেওয়া হয়েছিল একটি বিশেষজ্ঞ কমিটিকে। তাদের পরামর্শ, সর্বাগ্রে সিগারেট খাওয়ার ন্যূনতম বয়স বাড়াতে হবে। আর বন্ধ করতে হবে খুচরো সিগারেটের বিক্রি। বাজারে যাতে কোনও ভাবেই খুচরো সিগারেট বিক্রি না-হয়, তার জন্য কড়া আইন তৈরিরও সুপারিশ করেছে ওই কমিটি। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাড্ডা মঙ্গলবার রাজ্যসভায় বলেন, “কমিটির পরামর্শ মেনে নিয়েছে মন্ত্রক। মন্ত্রিসভা ছাড়পত্র দিলে বিষয়টিকে আইনের স্বীকৃতি দেওয়া হবে।”

নতুন দাওয়াইয়ে কী ভাবে সুফল মিলবে বলে আশা করা হচ্ছে?

বিশেষজ্ঞ কমিটির মতে, সামান্য দামে সিগারেট হাতের নাগালে মিলছে বলেই নেশার প্রবণতা বাড়ছে। ফলে স্কুলপড়ুয়ারাও টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে সিগারেট কিনে ফেলছে। খুচরো বিক্রি বন্ধ করা গেলে সহজলভ্যতায় ভাটা পড়তে বাধ্য। গোটা প্যাকেট কিনতে হলে ধূমপানের প্রবণতা অনেক কমবে। চিকিৎসকদের বড় অংশ এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁদের মতে, সিগারেট খাওয়া কমলে স্বাভাবিক ভাবেই কমবে ক্যানসারও।

ধূমপান কমাতে অনেক দেশে দীর্ঘদিন আগেই খুচরো সিগারেট বিক্রি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আমেরিকা, জাপান, ইংল্যান্ডের মতো দেশে কিনতে হলে গোটা প্যাকেটই কিনতে হয়। বিশেষজ্ঞ কমিটি কেন্দ্রকে জানিয়েছে, ওই সব দেশে আইন চালু হওয়ার কয়েক বছর পরে সমীক্ষায় দেখা যায়, সিগারেটের বিক্রি অনেক কমেছে। এর মূল কারণ, বহু ক্রেতাই গোটা প্যাকেট কিনতে অনীহা প্রকাশ করছেন। ফলে ধীরে ধীরে সিগারেট বিক্রি কমে গিয়েছে।

এ দেশেও একই ফল মিললে সামগ্রিক ভাবে জনস্বাস্থ্যই উপকৃত হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৫০ শতাংশ বা তারও বেশি ক্যানসারের জন্য দায়ী তামাক। বিশেষজ্ঞেরা জানান, সিগারেট থেকে ফুসফুস, মুখমণ্ডল ও পেটে বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার হয়। ইদানীং অনেক ক্ষেত্রে স্তন ক্যানসারের জন্যও ধূমপানকে দায়ী করা হচ্ছে। ক্যানসার শল্যচিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, তাঁরা দীর্ঘদিন ধরেই সিগারেটের উপরে নিয়ন্ত্রণ চেয়ে আসছেন। তাঁর কথায়, “কর বৃদ্ধি কেনাবেচা নিয়ন্ত্রণ, যে-ভাবেই হোক, সিগারেটে রাশ টানতে হবে। কেন্দ্র যদি এই সিদ্ধান্তটা নেয়, তা হলে বেশ কিছু ক্ষেত্রে ক্যানসারের মতো মারণ রোগকে আমরা ঠেকাতে পারব বলে আশা করছি।”

তবে চিকিৎসকদেরই একটি অংশের আশঙ্কা, যাঁরা মাঝেমধ্যে এক-আধটা সিগারেট খান, পুরো প্যাকেট কিনতে বাধ্য হলে তাঁদের নেশা বেড়ে যাবে না তো? সব মিলিয়ে বিষয়টা নিয়ে এখনও কিছুটা ধোঁয়াশা থেকে গিয়েছে। ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের বক্তব্য, দিন আনা দিন খাওয়া লোক, যার প্যাকেট কেনার ক্ষমতা নেই, তার সিগারেট খাওয়া হয়তো কমবে। কিন্তু খুব বড় কিছু লাভ হবে বলে মনে হয় না। খোলা সিগারেট না-মিললেও বিড়ি তো পাওয়া যাবে। “ধূমপানে রাশ টানা এত সহজ নয়। অন্য একটা ভয়ও আছে। যারা দিনে একটা-দু’টো সিগারেট খেত, প্যাকেট কিনতে হলে তাদের সিগারেট-আসক্তি আচমকা বেড়ে না যায়,” বলছেন সুবীরবাবু।

চিকিৎসকদের নানা মতের মধ্যেই ক্যানসার ফাউন্ডেশনের এগ্জিকিউটিভ ডিরেক্টর সুতপা বিশ্বাসের আশা, খুচরো সিগারেট বিক্রিতে রাশ টানলে শিশু-কিশোরদের জীবনে তা বড় সুফল বয়ে আনবে। তাঁর কথায়, “একটা ছেলে ১০ টাকা খরচ করে একটা সিগারেট কিনতে পারে। কিন্তু ১০০ টাকা দিয়ে প্যাকেট কেনার সামর্থ্য তাদের বয়সি ক’জনের আছে?” তবে সিদ্ধান্ত তো অনেকই হয়। তার প্রয়োগ কতটা হচ্ছে, সেটাই বড় কথা,” বলছেন সুতপাদেবী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE