এ দেশেও এ বার বুলেট ট্রেন।
এত দিন সিনেমার পর্দায় দেখেছিলেন। এ বার এ দেশের লাইনেই দৌড়বে বুলেট ট্রেন। টিকিট কেটে তাতে চড়ার ব্যবস্থাও করছে রেলমন্ত্রক। ’৭০-এর মাঝামাঝি জাপানি ছবি ‘বুলেট ট্রেন’ এবং তার কয়েক বছর পরে তার অনুকরণে তৈরি সুপার হিট হিন্দি ছবি ‘তেজ’ দেখে বুলেট ট্রেন সম্পর্কে সাধারণ ভারতীয়ের আকর্ষণ বেড়েছে। এ বার সেটাই প্রায় সাড়ে ৩০০ কিলোমিটার বেগে ছুটে চলে যাবে সামনে দিয়ে। তবে এখনই নয়। বেশ কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে। আপাতত মুম্বই-আমদাবাদ রুটে বুলেট ট্রেন চালানোর জন্য সমীক্ষা চালানোর কাজ শেষ। এক দফা রিপোর্ট জমা পড়েছে রেলের ঘরে। আগামী মাসেই আসবে দ্বিতীয় রিপোর্ট। তারপরেই এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে রেলমন্ত্রক।
বুলেট ট্রেন সময়সাপেক্ষ। তাই দেশীয় জনতাকে গতির স্বাদ দিতে প্রথমে আসছে অতি দ্রুত ট্রেন। গতি ১৬০-২০০ কিলোমিটার। ২০১৪-১৫ সালের রেল বাজেটে এই প্রস্তাব দিয়েছেন রেলমন্ত্রী সদানন্দ গৌড়া। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন বাজপেয়ী গড়েছিলেন সোনালি চতুর্ভুজ। চতুষ্কোণ জাল বিছিয়েছিলেন সড়ক পথে। আর এ বার মোদী-সরকার অতি দ্রুত গতিসম্পন্ন ট্রেনে জুড়তে চান দেশের চার প্রান্তকে। প্রকল্পের নাম ‘হীরক-চর্তুভুজ’। বাজেট বক্তব্যে রেলমন্ত্রী মঙ্গলবার বলেন, “এই প্রকল্পের জন্য ইতিমধ্যেই ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।”
বুলেট ট্রেনের ক্ষেত্রে পথিকৃৎ জাপান। সে দেশে ১৯৬৪ সালে টোকিও এবং ওসাকার মধ্যে প্রথম বুলেট ট্রেনটি চলেছিল। ট্রেনের ইঞ্জিন বুলেটের মতো দেখতে বলে নাম দেওয়া হয় বুলেট ট্রেন। জাপান ছাড়াও, চিন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, তাইওয়ান, তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, ইংল্যান্ড ও স্পেনে এই ধরনের ট্রেন চলে। ফ্রান্স, চিন ও জাপানে বুলেট ট্রেনের গতিবেগ ঘণ্টায় ৩০০ কিলোমিটারের ওপরে। বিদেশের ট্রেনগুলির মধ্যে জনপ্রিয় বুলেট ট্রেনটি হল ইউরোস্টার। যেটি চলাচল করে ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ডের মধ্যে।
বুলেট ট্রেন চালানো যথেষ্ট খরচসাপেক্ষও বটে। কিন্তু ওই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে তা যে প্রথম মুম্বই-আমদবাদের মধ্যেই চলবে, তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন গৌড়া। কেন? রেলমন্ত্রকের দাবি, প্রধানমন্ত্রীর নিজের রাজ্য বলে গুজরাত প্রথম এই পরিষেবা পেতে চলেছে, বিষয়টি কিন্তু সে রকম আদপেই নয়। প্রাথমিক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, মুম্বই-আমদাবাদ রুটে বুলেট ট্রেন চালালে বিনিয়োগকারীদের অর্থ উঠে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। সমীক্ষা বলছে, ৩২০ কিলোমিটার গতিতে ৫৩৪ কিমি দূরত্ব দৌড়াতে মাত্র দু’ঘণ্টা সময় নেবে এই ট্রেন। বিমানের থেকে মাত্র আধ ঘণ্টা বেশি। ফলে ওই রুটে যাত্রীর অভাব হবে না বলেই মনে করছে মন্ত্রক। তাই প্রাথমিক ভাবে ওই রুটটিকেই বেছে নেওয়া হয়েছে।
তবে বুলেট ট্রেন চালানো নিয়ে বিরোধিতাও রয়েছে। প্রথমত, বুলেট ট্রেনের পরিকাঠামো নির্মাণে বিপুল অর্থের প্রয়োজন। যেমন, স্রেফ মুম্বই-আমদাবাদ বুলেট ট্রেনের পরিকাঠামো নির্মাণে প্রয়োজন প্রায় ৬৩ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতি কিলোমিটার পিছু একশো কোটি টাকার বেশি। বিদেশী সংস্থারা যে হেতু বুলেট ট্রেনে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী, তাই ভারতীয় রেলের মতো ভর্তুকি দিয়েও সেটি চালানো হবে না। সে ক্ষেত্রে টিকিটের যা দাম হবে তা সাধারণ মানুষ কেন, মধ্যবিত্তেরও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে। শুধু ব্যবসায়ী বা উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির মাধ্যমে ওই বিপুল অর্থ উঠে আসবে কিনা, তাতে সন্দেহ রয়েছে।
দ্বিতীয়ত, বুলেট ট্রেনের মূল শর্ত হল গতি। এর জন্য প্রয়োজন বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন আলাদা রেললাইন। এই পরিস্থিতিতে ওই নতুন লাইন পাততে গেলে যে জমির প্রয়োজন, তা কোথা থেকে আসবে তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
তৃতীয়ত, প্রক্রিয়াটিতে সিগন্যালিং থেকে বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন লাইন ও কোচ-পরিকাঠামোগত ভাবে বিদেশি প্রযুক্তির উপর নির্ভরতা ব্যাপক ভাবে বেড়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারী সংস্থার সমস্ত শর্ত মানতে বাধ্য থাকবে রেল। যেমনটি এখন মেনে চলতে হয় পণ্য করিডরের ক্ষেত্রে।
তাই বুলেটের পরিবর্তে আপাতত জোর দেওয়া হয়েছে হাইস্পিড, অর্থাৎ অতি দ্রুত ট্রেন চালানোর উপরে। আপাতত যে ক’টি শহরের মধ্যে ওই হাইস্পিড ট্রেন চালানো হবে সেগুলো হল দিল্লি-আগরা, দিল্লি-চণ্ডীগড়, দিল্লি-কানপুর, নাগপুর-বিলাসপুর, মহীশূর-বেঙ্গালুরু-চেন্নাই, মুম্বই-গোয়া, মুম্বই-আমদাবাদ, চেন্নাই-হায়দরাবাদ ও নাগপুর-সেকেন্দরাবাদ। ইতিমধ্যে এই প্রকল্পে বাজেট-বরাদ্দ করা হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। গতিবেগ ১৬০-২০০ কিলোমিটার। ভারতে সব থেকে গতিসম্পন্ন ট্রেন রাজধানী এক্সপ্রেস। ঘণ্টায় ১৩০ কিলোমিটার। কিন্তু ট্রেনের গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় ৭০ কিলোমিটার বাড়াতে গেলে যে পরিকাঠামো প্রয়োজন সেটা কতটা রয়েছে রেলে?
মন্ত্রক জানাচ্ছে, বর্তমানে যে ধরনের লাইন ব্যবহার করা হয়, সেগুলো যথেষ্ট মজবুত। এ ধরনের লাইনে ওই অতি দ্রুত ট্রেন চালানো সম্ভব। সে ক্ষেত্রে পয়েন্ট, সিগন্যাল ও যেখানে যেখানে লাইন অনেকটা করে বাঁক নিয়েছে, সেই সব জায়গায় বিশেষ ভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে। সাধারণ সিগন্যাল পাল্টে ‘ডবল ডিস্ট্যান্স সিগন্যাল’ লাগাতে হবে। যাতে চালক পর পর দু’টি জোনের মধ্যে (অনেকটা বেশি দূরত্ব) লাইনে আর কোনও গাড়ি রয়েছে কি না তা বুঝতে পারেন। ওই গতিতে ট্রেন চালাতে গেলে এলএইচবি (লিঙ্ক হফম্যান বুস) কামরার প্রয়োজন। যে ধরনের কামরা দিয়েই এখন রাজধানী চালানো হয়। দরকার শক্তিশালী ইঞ্জিনও। সেটাও রয়েছে এ দেশের রেলের হাতে। এখন এপি-৪,৫,৬ বা ৭ জাতীয় যে সমস্ত ইঞ্জিন আসছে সেগুলো প্রত্যেকটাই ওই গতিতে চলতে পারবে বলে রেলের পদস্থ কর্তারা জানিয়েছেন।
তবে সংশয়ও রয়েছে। রেল বলছে, এ দেশে একটি লাইন দিয়ে যে ভাবে কম গতির মালগাড়ি বা অন্যান্য ট্রেন যায়, তাতে ২০০ কিলোমিটার বেগে কতক্ষণ ওই ট্রেন চালানো যাবে তা নিয়ে যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনা প্রয়োজন। এ ছাড়া, গত কয়েক বছরে রাজনৈতিক চাহিদায় পরিকল্পনা ছাড়াই ট্রেনের সংখ্যা প্রচুর বেড়ে গিয়েছে। ফলে একই লাইনে অনেক ট্রেনের সঙ্গে হাইস্পিড ট্রেন চালানোয় অসুবিধে হওয়াও অস্বাভাবিক কিছু নয়।
এই বাজেটে হাই স্পিডের তালিকায় কলকাতার কোনও উল্লেখ নেই। বঞ্চনার দাবি তুলে বিরোধীরা ইতিমধ্যেই এই নিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেছেন। কিন্তু এই প্রকল্পের আওতায় কলকাতা না-আসার একটি কারণ রয়েছে। গত কয়েক বছরে পরিকাঠামো না বাড়িয়েই এই অঞ্চলে এত নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে যে, এখানে ওই লাইনে আর এই দ্রুত গতির ট্রেন চালানো সম্ভব নয় বলে মনে করছেন রেলের কর্তারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy