Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

অতিথিদের মশা না কামড়ায়, এত ছোট ব্যাপারেও নজর ছিল তাঁর

এ পি জে আব্দুল কালাম তখন রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতি ভবনে বিভিন্ন রাজ্যের সাংসদদের প্রাতঃরাশের বৈঠকে তিনি ডাকতে শুরু করেছেন এক এক করে। সে দিন ছিল বিহারের সাংসদদের নিমন্ত্রণ। বিহারের সাংসদেরা জানেন না সেখানে গিয়ে তাঁদের কী করণীয়। রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে তাঁরা দেখেন ঢোকার মুখেই বিরাট বিরাট আর্ট পেপারে বিহারের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির উপর রেখচিত্র তৈরি করা রয়েছে। নানা ধরনের চার্ট পেপার।

রাষ্ট্রপতি ভবন।—নিজস্ব চিত্র।

রাষ্ট্রপতি ভবন।—নিজস্ব চিত্র।

জয়ন্ত ঘোষাল
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৮ জুলাই ২০১৫ ১৪:৫২
Share: Save:

এ পি জে আব্দুল কালাম তখন রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতি ভবনে বিভিন্ন রাজ্যের সাংসদদের প্রাতঃরাশের বৈঠকে তিনি ডাকতে শুরু করেছেন এক এক করে। সে দিন ছিল বিহারের সাংসদদের নিমন্ত্রণ। বিহারের সাংসদেরা জানেন না সেখানে গিয়ে তাঁদের কী করণীয়। রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে তাঁরা দেখেন ঢোকার মুখেই বিরাট বিরাট আর্ট পেপারে বিহারের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির উপর রেখচিত্র তৈরি করা রয়েছে। নানা ধরনের চার্ট পেপার। কোনটি থেকে জানা যাচ্ছে বিহারের শিক্ষার হাল, কোনও ছবি থেকে জানা যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। রাষ্ট্রপতি তখনও আসেননি। অফিসারেরাই সাংসদদের সব ঘুরে ঘুরে দেখান। তারপর রাষ্ট্রপতি এলেন। প্রাতঃরাশ টেবিলে শুরু হল বিহারের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা। রাষ্ট্রপতি বললেন, আমার উদ্দেশ্য আসলে আপনাদের কাছ থেকে বিহার কেমন আছে তার খবর নেওয়া। আপনাদের অভিজ্ঞতা, অভিমত শুনে আমি শিক্ষিত হতে চাই। রাষ্ট্রপতির খানসামারা এক এক করে ইডলি-সম্বর, পুরি-ভাজি, এ সব নিয়ে আসতেই থাকছেন। কিন্তু তার পাশাপাশি বিহার নিয়ে হয়ে গেল মস্তিষ্কে ঝড় তোলা এক অধিবেশন।

সে দিন সন্ধ্যায় লালুপ্রসাদ যাদবের মতো ব্যক্তিও আমায় বলেছিলেন, ভদ্রলোককে দেখে অবাক হয়ে যেতে হয়। আমাদের রাজ্য নিয়ে যা পড়াশোনা করেছেন এবং যা আন্তরিক তা ভাবা যায় না। শুধু বিহার নয়, এ ভাবে তিনি প্রত্যেকটি রাজ্যের প্রতিনিধিদের ডেকে তাঁদের সঙ্গে রাজ্য নিয়ে আলাপ-আলোচনা চালিয়েছেন। বহু দিন পর আর এক সহলেখকের সাহায্য নিয়ে একটি বই প্রকাশ করেন কালাম। বইটির নাম ‘এ ম্যানিফেস্টো ফর চেঞ্জ। এ সিক্যুয়েল টু ইন্ডিয়া ২০২০।’ সহলেখকের নাম ভি পোনরাজ। যিনি বেঙ্গালুরুর ডিআরডিও-র এক বিজ্ঞানী। গত বছর ওই বইটি প্রকাশিত হয়। সেই যে রাজ্যগুলির মূল্যায়ন তিনি করেছিলেন সেই ভিত্তিতে রাজ্যগুলির জন্য ওই বইটিতে একটি পরিচ্ছদও রয়েছে। যার নাম হল রাজ্যগুলির উন্নয়নের ইস্তাহার। এই গল্পটি আমি এই কারণে বলছি শুধু এটুকু বোঝানোর জন্য যে, আব্দুল কালাম মানেই পোখরানের দ্বিতীয় বিস্ফোরণ বা পরমাণ বিজ্ঞানী নন। তিনি দেশের সমস্যা নিয়েই একটি সার্বিক আগ্রহ রখতেন।

রাষ্ট্রপতি ভবনের মোগল বাগানে তিনি রঙিন ফোয়ারার মাধ্যমে সঙ্গীত ও নৃত্যশীর্ষক এক অনুষ্ঠান শুরু করেছিলেন। বিভিন্ন রাগে, সঙ্গীতের মূর্ছনায় জলের নৃত্য। আর সেই ফোয়ারার জলের উপর নানা রঙের আলো পড়ছে। সে এক অনির্বচনীয় দৃশ্য। যে দিন এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন হল সে দিনের একটি মজার ঘটনা বলি। সস্ত্রীক সেই অনুষ্ঠান দেখতে গিয়েছিলাম। সন্ধ্যার সময়। বাগানে খুব মশা। সন্তুরবাদক শিবকুমার শর্মার সঙ্গে তাঁর পুত্রও এসেছিলেন ওই অনুষ্ঠানে। কিন্তু সকলকেই খুব মশা কামড়াচ্ছে। এ দিকে এক এক করে লোক আসা শুরু হয়ে গিয়েছে। অনুষ্ঠান শুরু হব হব। হঠাৎ দেখলাম রাষ্ট্রপতির পাইক-পেয়াদারা মাথায় লাল পাগড়ি, লাল-সাদা ঝলমলে পোশাক পরে আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছেন। ট্রেগুলির উপর নীল ভেলভেটের কাপড়। লাল জরির পাড় দেওয়া। আর দূর থেকে দেখা যাচ্ছে ট্রে-র উপর রয়েছে কিছু সুসজ্জিত বস্তু। আমরা ভাবলাম কিছু খাবার আসছে বুঝি! কাছে আসতে দেখলাম প্রত্যেকটি ট্রে-র উপর থরে থরে সাজানো মশার মলমের টিউব। পরে রাষ্ট্রপতির মিডিয়া উপদেষ্টা এস এম খান আমায় বলেছিলেন, মশার ব্যাপারটি রাষ্ট্রপতির মাথায় ছিল। সঙ্গীতের মূর্ছনার সঙ্গে মশার কামড়— এই বৈপরীত্য যাতে মোগল বাগানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাঘাত না ঘটায় তার জন্যই রাষ্ট্রপতি আগাম ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। বেশ নিপুণ গৃহিণীপনা ছিল অকৃতদার কালামের জীবনে।

এই যে এখন আমরা রাষ্ট্রপতি ভবনে কম্পিউটার ব্যবস্থা দেখি এ সবই কিন্তু তাঁর সময়কার অবদান। রাষ্ট্রপতি ভবনের রিসেপশনে ঢুকলেই এখন কম্পিউটারের টাচ স্ক্রিন স্পর্শ করলেই রাষ্ট্রপতি ভবন নামক এই বিশাল সাম্রাজ্যের হালহকিকৎ আপনি জানতে পারবেন। যেখানে যেতে চাইছেন সেই বিভাগের সমস্ত অফিসার, সমস্ত হালহকিকৎ আপনার সামনে হাজির হয়ে যাবে। রাষ্ট্রপতি ভবন যাতে বেশি সংখ্যক মানুষ পরিদর্শন করতে পারেন তার জন্য গাইডের ব্যবস্থা দীর্ঘ কাল ধরে রয়েছে। যেমন থাকে বাকিংহ্যাম প্যালেস বা ক্রেমলিনে। কিন্তু ভারতের রাষ্ট্রপতি বা রাষ্ট্রপতি ভবন নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কুইজ বা প্রশ্নোত্তরের ব্যবস্থা করা, শীততাপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে টাচ্ স্ক্রিনে প্রশ্নোত্তর, এ সব কালামের আগে ছিল না।

আর একটি কাজ কালাম করেছিলেন। তাঁর আগে পর্যন্ত রাষ্ট্রপতিরা বিভিন্ন দেশ থেকে যে উপহার পেতেন তার কোনও সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি। কে আর নারায়ণন চলে যাওয়ার পরে তো রীতিমতো অভিযোগ উঠেছিল যে তাঁর স্ত্রীর তত্ত্বাবধানে বহু উপহার সামগ্রী দক্ষিণ ভারতে চলে গিয়েছে। সেখানে নারায়ণনের পাওয়া উপহার সামগ্রী নিয়ে নাকি একটি পৃথক মিউজিয়ামও তৈরি হয়েছে। সে সব অভিযোগ নিয়ে নানা বিতর্ক সে সময়ে উঠেছিল। কালাম রাষ্ট্রপতি ভবনের মধ্যেই সমস্ত উপহারসামগ্রীকে সাজানোর ব্যবস্থা করেন। প্রত্যেকটি উপহার সামগ্রীর নীচে দিনক্ষণ, দেশের নাম উল্লেখ করা হয়। আর এখন বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় রাষ্ট্রপতি ভবনের মিউজিয়ামকে আরও আধুনিক গবেষণার মাধ্যমে নতুন মাত্রা দিতে তৎপর রয়েছেন।

অটলবিহারী বাজপেয়ী ও লালকৃষ্ণ আডবাণী, দু’জনের সঙ্গেই কালামের মধুর সম্পর্ক ছিল। দ্বিতীয় বারের জন্য কালামকে রাষ্ট্রপতি করার কথা ভাবা হলেও, সে দিন কংগ্রেস তাঁকে সমর্থন করেনি। আর কালামের অভিমান ছিল, ঐকমত্য না হলে তিনি রাষ্ট্রপতি হবেন না। ভোটে লড়ে রাষ্ট্রপতি হতে তিনি রাজি নন। এ বার যখন প্রণব মুখোপাধ্যায় রাষ্ট্রপতি হলেন, তার আগে কালামকে রাষ্ট্রপতি করার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্যে আবেদন জানিয়েছিলেন। সুব্রহ্মণ্যম স্বামী থেকে সুধীন কুলকার্নি, অনেকেই তাঁর কাছে গিয়ে বিজেপি-র পক্ষ থেকে ঘরোয়া ভাবে ওই প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু সে দিন একই অভিমান তিনি বজায় রেখেছিলেন যে ভোটে লড়ে রাষ্ট্রপতি হবেন না তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE