Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

বাড়ছে মৃত্যু, তবু বুনো গোলাপ ছাড়বে না দিল্লি

উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর মতো এটাও যেন এক মেরু অঞ্চল! সে কারণে অনেকে এটাকে তৃতীয় মেরু বলেও ডাকেন। যত দূর চোখ যায় আদিগন্ত বরফ আর তার ফাঁকে ফাঁকে একের পর এক বরফ মোড়া শৃঙ্গ। কারাকোরাম পর্বতমালার।

পৃথিবীর সর্বোচ্চ যুদ্ধক্ষেত্রে অতন্দ্র প্রহরায় ভারতীয় সেনা।

পৃথিবীর সর্বোচ্চ যুদ্ধক্ষেত্রে অতন্দ্র প্রহরায় ভারতীয় সেনা।

প্রেমাংশু চৌধুরী
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:২৮
Share: Save:

উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর মতো এটাও যেন এক মেরু অঞ্চল! সে কারণে অনেকে এটাকে তৃতীয় মেরু বলেও ডাকেন। যত দূর চোখ যায় আদিগন্ত বরফ আর তার ফাঁকে ফাঁকে একের পর এক বরফ মোড়া শৃঙ্গ। কারাকোরাম পর্বতমালার। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কমবেশি ২০ হাজার ফুট উচ্চতায় প্রায় ২৭০ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে থাকা এই জায়গাটাই সিয়াচেন হিমবাহ। এখানে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর হাতছানি। এখানে প্রতি বছর গুলি বিনিময়ে যত সেনা মারা যান, তার থেকে অনেক বেশি সেনার মৃত্যু হয় প্রকৃতির রোষে। অনেকে সারা জীবনের মতো পঙ্গু হয়ে যান। দেখা দেয় মানসিক সমস্যাও।

তুষারধসে চাপা পড়ে মৃত হনুমন্থাপ্পা কোপ্পাড়-সহ দশ জওয়ান সেই তালিকাতেই শেষতম সংযোজন। ৩৫ ফুট বরফের নীচে ছ’দিন পরেও বেঁচে থাকায় হনুমন্থাপ্পাকে নিয়ে তা-ও হইচই হয়েছে। তাঁর বাকি সঙ্গীদের দেহ বরফে জমে এতটাই শক্ত হয়ে গিয়েছিল যে রীতিমতো হাড়গোড় ভেঙে উদ্ধার করতে হয়েছে তাঁদের! গোটা দেশ যখন হনুমন্থাপ্পাদের জন্য শোক পালন করছে, তখন সিয়াচেনে নতুন বহাল হওয়া জওয়ানদের সেই শোক পালনেরও সময় নেই!

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন, এমন জায়গায় এ ভাবে সেনা রেখে কী লাভ?

সিয়াচেন কথার অর্থ ‘বুনো গোলাপ’। আর একে নিয়ে সমস্যার শুরু ১৯৪৯-এর করাচি চুক্তি থেকে। ১৯৭২-এ শিমলা চুক্তিতেও সমস্যা মেটেনি। ভারতীয় সেনা অফিসারদের বক্তব্য, পাকিস্তান সিয়াচেন থেকে কারাকোরাম পাস পর্যন্ত নিজেদের এলাকা বলে দাবি করে। সে ক্ষেত্রে নুব্রা ভ্যালি থেকে লে পর্যন্ত রাস্তা, কারাকোরাম হাইওয়ে, লাদাখ পর্যন্ত আকসাই চিনের রাস্তা— সবটাই পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

পাকিস্তান বরাবরই চায়, সিয়াচেন থেকে সেনা সরাক ভারত। আজও ভারতে নিযুক্ত পাক হাইকমিশনার আব্দুল বসিত বলেছেন, ‘‘এই ট্র্যাজেডি থেকে স্পষ্ট যে অবিলম্বে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান দরকার। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে খারাপ আবহাওয়ায় আর প্রাণহানি যেন না ঘটে।’’ গত বছর রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ অধিবেশনে নওয়াজ শরিফও সিয়াচেন থেকে দু’তরফেরই সেনা সরানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

ভারত কিন্তু সিয়াচেন থেকে সেনা সরাবে না। প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পর্রীকর তুষারধসের পরেও বলেছেন, ‘‘দেশের নিরাপত্তার কারণেই সিয়াচেনে সেনা রাখা দরকার। এই ধরনের ঘটনা যন্ত্রণাদায়ক ঠিকই, কিন্তু এর কোনও সমাধান নেই।’’

নয়াদিল্লির বক্তব্য, সিয়াচেন হিমবাহে পাকিস্তানের থেকে তুলনামূলক ভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে ভারত। এবং ওই জায়গাটিকে যত ক্ষণ না ভারতের এলাকা বলে আন্তর্জাতিক স্তরে সিলমোহর বসছে, তত ক্ষণ দিল্লি সেখান থেকে সেনা সরাবে না। ১৯৮৪ সালে সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন মেঘদূত’-এর পর থেকেই সলতোরো রেঞ্জের সবক’টি শৃঙ্গ ভারতের দখলে। যেখান থেকে গোটা নুব্রা উপত্যকার উপর নজর রাখা যায়। কার্গিল যুদ্ধের সময় তো বটেই, তার আগে পরেও পাক সেনা ওই সব এলাকা দখল করার বহু চেষ্টা করেছে। কিন্তু ভারত সুবিধাজনক অবস্থানে থাকায় প্রতি বারই তারা ব্যর্থ হয়েছে। নয়াদিল্লির আশঙ্কা, ইসলামাবাদ মুখে সিয়াচেন থেকে দু’তরফেরই সেনা সরানোর কথা বললেও ভারতীয় সেনা ওখান থেকে সরে এলেই পাকিস্তান ওই এলাকা দখল করবে।

এই এলাকা দখলের বিনিময়ে মূল্য কী? নয়াদিল্লির হিসেব অনুযায়ী, সিয়াচেনে সেনা মোতায়েনের দৈনিক খরচ ৫ কোটি টাকা! এখনও পর্যন্ত ৯০০ ভারতীয় সেনা মারা গিয়েছেন সিয়াচেনে। তাঁদের সিংহভাগই খারাপ আবহাওয়ার জন্য। প্রায় একই সংখ্যক পাক সেনারও মৃত্যু হয়েছে এখানে। যেখানে হনুমন্থাপ্পারা তুষারধসের কবলে পড়েছেন, গত মাসে তার কাছেই সেনার চার জওয়ান প্রাণ হারান। চার বছর আগে সিয়াচেনে তুষারধসে পাকিস্তানের ১২৯ জন সেনা ও ১১ জন ঠিকাদার মারা যান। তার পরেও ‘বুনো গোলাপ’-এর দখল ছাড়তে নারাজ কেউ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

premangshu choudhury MostReadStories
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE