Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
National News

ভারত কি ঝুঁকছে ইজরায়েলের দিকে? বিশেষজ্ঞেরা বললেন...

কেন ভারত, ইজরায়েলের এত কাছাকাছি আসা? তার প্রেক্ষিতে এই ভূখণ্ডে নিজের অবস্থানের প্রশ্নে ভারতের পথ বদলাবে কি? ভারত-ইজরায়েলের সম্পর্কের অগ্রগতিতে আরব দুনিয়া কি দূরে সরে যাবে? এই প্রশ্নগুলি নিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের তিন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সংযুক্তা ভট্টাচার্য, পুরুষোত্তম ভট্টাচার্য ও অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন সুজয় চক্রবর্তী।

কাছে, আরও কাছাকাছি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানইয়াহু। ১৪ জানুয়ারি, দিল্লির ইন্দিরা গাঁধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। ছবি: সংগৃহীত।

কাছে, আরও কাছাকাছি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানইয়াহু। ১৪ জানুয়ারি, দিল্লির ইন্দিরা গাঁধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। ছবি: সংগৃহীত।

শেষ আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

গত বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী গিয়েছিলেন ইজরায়েল সফরে। আর গত সপ্তাহে ভারত ঘুরে গেলেন ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানইয়াহুআগামী দিনে দু’দেশের সম্পর্ক আরও জোরদার হওয়ার ভিতও তৈরি হয়েছে এ বার দুই দেশের মধ্যে ৯টি ‘মউ’ সইয়ের পর।

কেন ভারত, ইজরায়েলের এত কাছাকাছি আসা? তার প্রেক্ষিতে এই ভূখণ্ডে নিজের অবস্থানের প্রশ্নে ভারতের পথ বদলাবে কি? ভারত-ইজরায়েলের সম্পর্কের অগ্রগতিতে আরব দুনিয়া কি দূরে সরে যাবে? ইজরায়েলের সঙ্গে ভারতের প্রতিরক্ষা চুক্তি দুই প্রতিবেশী চিন ও পাকিস্তানের পক্ষে কি অস্বস্তিকর হবে?

এই প্রশ্নগুলি নিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের তিন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সংযুক্তা ভট্টাচার্য, পুরুষোত্তম ভট্টাচার্য অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন সুজয় চক্রবর্তী

আনন্দবাজার: আরব দুনিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ আর তার আগে-পরের পরিস্থিতি ইজরায়েলকে মুসলিমবিরোধী রাষ্ট্রের পরিচিতি দিয়েছে গোটা বিশ্বে। ও দিকে, কেন্দ্রের বিজেপি নেতৃত্বাধীন মোদী সরকারের গ্রহণযোগ্যতা মুসলিমদের কাছে কতটা, তা নিয়ে সন্দেহ, সংশয়েও খামতি নেই। ধর্মকে ভিত্তি করে রাজনৈতিক মতাদর্শের এই আপাত-নৈকট্যই কি মোদী সরকারের আমলে ভারত ও ইজরায়েলের কাছাকাছি আসার কারণ?

সংযুক্তা: ভারতের স্বাধীনতা ও ইজরায়েলের রাষ্ট্র ঘোষণার ইতিহাস অবশ্য অন্য কথা বলে! ১৯৪৭-এ দু’টুকরো হয়ে ভারত আর পাকিস্তান স্বাধীন হয়েছিল। ’৪৮ সালে প্যালেস্তাইনকে দাবিয়ে ইজরায়েল নিজেকে আলাদা রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করেছিল। ইহুদি জাতিসত্তার আলাদা অস্তিত্বের স্মারক হিসাবে। ইজরায়েল হয়েছিল ইহুদি রাষ্ট্র। পাকিস্তানও নিজেকে মুসলিম রাষ্ট্র ঘোষণা করেছিল। দু’টি রাষ্ট্রেরই জন্ম হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে। তাই ইজরায়েল ও পাকিস্তানের কাছাকাছি থাকাটাই স্বাভাবিক ছিল। সে দিক থেকে দেখলে, উচিতও ছিল।

ইন্দিরা-আরাফত: প্যালেস্তাইনে ইজরায়েলি দমনের বিরুদ্ধে বরাবরই সরব ছিল ভারত।

আনন্দবাজার: কিন্তু ইতিহাস বলছে, সেই সময় জওহরলাল নেহরু বা মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী, কেউই ইহুদিদের জাতিসত্তার স্বীকৃতির দাবিকে অস্বীকার করেননি। অগ্রাহ্য করতে চাননি।

সংযুক্তা: ঠিকই। কিন্তু যে ভাবে প্যালেস্তাইনকে দাবিয়ে ইজরায়েল আলাদা রাষ্ট্র হল, তা কেউই মেনে নেননি। এখানে পাকিস্তানের সঙ্গে কিছুটা মিল রয়েছে ইজরায়েলের। ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’-এর কায়দাতেই ‘লড়কে লেঙ্গে ইজরায়েল’-এর জন্ম হয়। এটা গাঁধী, নেহরুর মোটেই পছন্দ হয়নি।

অন্য দিকে, স্বাধীনতার পর ভারত হয়ে ওঠে একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। পাকিস্তান মুসলিম রাষ্ট্র থেকে পরে হয়ে ওঠে ইসলামিক রিপাবলিক বা মুসলিম প্রজাতন্ত্র। ইজরায়েল নিজেকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বললেও সেখানে থাকা আরব মুলুকের মুসলিমরা হয়ে পড়েন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল চরিত্রটা ছিল অহিংস। কিন্তু ইজরায়েলের ক্ষেত্রে উল্টোটা হয়েছিল। হিংসার পথে গিয়ে প্যালেস্তাইনকে দাবিয়ে রেখে ইজরায়েল স্বাধীন রাষ্ট্র হয়েছিল। বন্দুকের নলকে সামনে রেখে। ২০০০ বছর পর ইহুদিরা হঠাৎ এসে বলল, প্যালেস্তাইনের ভূখণ্ডটা তাঁদেরই সম্পত্তি! এমন একটা ব্যবস্থা কায়েম করা হল, যাতে গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইহুদিরা সেখানে গিয়ে অবাধে নাগরিকত্ব পেতে পারেন।

আনন্দবাজার: এই পরিস্থিতিটাই প্যালেস্তাইনকে ভারতের বন্ধু করে দিয়েছিল। গাঁধী বলেছিলেন, যে ভাবে প্যালেস্তাইনকে বন্দুকের নলে দাবিয়ে রেখে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের তোড়জোড় চালাচ্ছে ইজরায়েল, সেটা তাঁর পছন্দ হয়নি। প্যালেস্তাইন সর্বহারা হয়ে গেল। তাই ভারত তো বটেই, নির্জোট আন্দোলনের শরিক বিশ্বের বহু শান্তিকামী দেশেরও সহানুভূতি পেয়ে গেল প্যালেস্তাইন। ’৭৪-এ প্যালেস্তাইনের মুক্তি আন্দোলন (পিএলও)-কে ভারত স্বীকৃতি দিল। রাষ্ট্র না হয়েও পিএলও নির্জোট আন্দোলনের দেশগুলির জোটে এল। ভারত ও ইজরায়েলের মধ্যে দূরত্বটা কি বাড়ল সেই সূত্রেই?

সংযুক্তা: দূরত্ব তার আগেই বেড়েছিল। ছ’য়ের দশক থেকেই। ’৬৭-তে আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের সময় থেকে। তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য আরব দেশগুলির উপর ভারতের নির্ভরতার খুবই প্রয়োজন ছিল। বিশ্বে তত দিনে ইজরায়েলের মুসলিমবিরোধী ভাবমূর্তি তৈরি হয়ে যাওয়ার ফলে, ভারতেও মুসলিম ভোট ধরে রাখার বাধ্যবাধকতা ছিল তদানীন্তন নেহরু সরকারের। তাই ইজরায়েলের সঙ্গে ওই সময় থেকেই দূরত্ব বাড়তে শুরু করে ভারতের।

আরও পড়ুন- সাধারণ মানুষ, প্রোটোকল জানি না: ‘আলিঙ্গন’ ব্যাখ্যা মোদীর​

পুরুষোত্তম: আরও একটা কারণ ছিল। ’৪৮ সাল থেকেই ভারত আর পাকিস্তান একটা জিনিস প্রমাণের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। সেটা হল, আরব দুনিয়ার স্বার্থ দেখার ব্যাপারে কে বেশি আগ্রহী। আসল উদ্দেশ্য সেই তেল আর প্রাকৃতিক গ্যাস। এই প্রতিযোগিতাও ভারতকে ইজরায়েলের সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে উৎসাহ জুগিয়েছিল।

আনন্দবাজার: আমেরিকাকে পাশে পাওয়ার প্রয়োজন হয়েছিল কেন ইজরায়েলের? তা কি পিএলও-র পিছনে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মদতের সঙ্গে পাল্লা দিতেই? কারণ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন ইজরায়েলের জন্ম হল, তখন তো আর আমেরিকা-রাশিয়া ‘ভাই-ভাই’ নেই। রেষারেষি শুরু হয়ে গিয়েছে। শুরু হয়ে গিয়েছে ঠান্ডা যুদ্ধের যুগ...

অ্যালবাম থেকে: ’৬৭-র আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ। তখন থেকেই তেল আভিভের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় নয়াদিল্লির।

সংযুক্তা: সে তো বটেই। যে ভাবে বন্দুকের নলে প্যালেস্তাইনকে দাবিয়ে রেখে ইজরায়েলের জন্ম হয়েছিল, তাতে গোটা বিশ্বে সেই সময় কার্যত একঘরে হয়ে পড়েছিল ইহুদি রাষ্ট্রটি। তাই ইজরায়েলের তখন একটি ‘গডফাদার’-এর দরকার হয়ে পড়ল। আমেরিকাকে পেয়েও গেল। ইজরায়েলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিল আমেরিকাই।

আনন্দবাজার: আমেরিকাকে ইজরায়েলের ওই সময় দরকার হয়েছিল মূলত অস্ত্রের জন্য। কিন্তু আমেরিকা তো তখন ইজরায়েলকে অস্ত্র বেচতে চায়নি। আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ থেকে আমেরিকার সঙ্গে ইজরায়েলের ‘অস্ত্রের সম্পর্ক’ হঠাৎ গড়ে উঠল কেন? কোন বাধ্যবাধকতায়?

পুরুষোত্তম: ঠিক, ইজরায়েলকে প্রথমে অস্ত্র বেচতে চায়নি আমেরিকা। অন্য ভাবে সাহায্য করে গিয়েছে। অর্থ দিয়েছে। প্রযুক্তি দিয়েছে। পরামর্শ, পরিচিতি দিয়েছে। কারণ, আমেরিকার ইহুদি লবি বরাবরই সেটা চেয়েছে। আমেরিকার এই ইহুদি লবির হাতে রয়েছে প্রচুর অর্থ। তাই এদের খুব বড়সড় প্রভাব রয়েছে মার্কিন প্রশাসনে, বরাবরই। আরব দুনিয়ার সঙ্গে ইজরায়েলের যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই ওই ইহুদি লবি মার্কিন প্রশাসনের উপর চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করল ইজরায়েলকে অস্ত্র দেওয়ার জন্য। না হলে ইহুদিদের রাষ্ট্র বিপদে পড়বে, এই যুক্তিতে। ফলে, ওই সময় থেকেই তেল আভিভের সঙ্গে খাতায়, কলমে ওয়াশিংটনের ‘অস্ত্রের সম্পর্ক’ গড়ে উঠল।

আনন্দবাজার: সোশ্যালিস্ট মতাদর্শে অনুরক্ত, সোভিয়েত-ঘনিষ্ঠ নেহরুর তো তা পছন্দ না হওয়ারই কথা। তা হলে কি ইজরায়েলের সঙ্গে তখন কোনও সম্পর্কই ছিল না ভারতের?

সংযুক্তা: না, তা নয়। এটা ঠিক, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রয়োজনে আরব দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখাটা খুব জরুরি ছিল ভারতের। দেশে মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক ধরে রাখাটাও প্রয়োজন ছিল নেহরুর। কংগ্রেসের। তার জন্য দিল্লিতে ইজরায়েলকে ওই সময় দূতাবাস খুলতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু মুম্বইয়ে ইজরায়েলকে একটা কনস্যুলেট খুলতে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, সেই পাঁচের দশকেই....

(সংযুক্তাকে থামিয়ে)

পুরুষোত্তম: সেটা ভারত করেছিল নিজের প্রয়োজনে। উপসাগরে প্রচুর ভারতীয় কাজ করতে যেতেন, এখনও যান। বিশেষ করে কেরলের মানুষ। তাঁদের সুবিধা, অসুবিধার কথা ভেবেই মুম্বইয়ে একটা কনস্যুলেট খোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল ইজরায়েলকে। ওই ভাবেই নেহরু একটা ‘ডিফ্যাক্টো রেকগনিশন’ বা কাজ চালানো স্বীকৃতি দিয়েছিলেন ইজরায়েলকে। এগুলি বিদেশ নীতির ‘ডিটারমিন্যান্টস’। কখনও অর্থ, কখনও ব্যবসা-বাণিজ্য, কখনও সংস্কৃতি বা জিও-পলিটিক্স (ভূকৌশলগত রাজনীতি) কখনও-বা দেশের অভ্যন্তরীণ প্রয়োজন বা অন্য কোনও জরুরি কারণে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে হয়।

ইজরায়েলে নেতানইয়াহুর সঙ্গে মোদী: বদলাচ্ছে সম্পর্কের সমীকরণ।

সংযুক্তা: আমি সেটাই বলতে চাইছি। আরব দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা আর দেশে মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক ধরে রাখার বাধ্যবাধকতায় ওই সময় নেহরু সরকার ইজরায়েলের সঙ্গে একেবারেই মুখ দেখাদেখি বন্ধ করে দিয়েছিল, তা নয়। গোপনে গোপনে একটা সম্পর্ক ছিলই ভারত, ইজরায়েলের মধ্যে। একটা ‘কভার্ড’ বা ঢাকা-চাপা দেওয়া সম্পর্ক তেল আভিভের সঙ্গে তখনও রেখে চলেছিল দিল্লি। পরে জানা যায়, তার গভীরতাও খুব কম ছিল না। ২০০৩ সালে আদালতে দায়ের হওয়া একটি জনস্বার্থ মামলার প্রেক্ষিতে জানা যায়, ’৮৮/’৮৯ সালে ইজরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা ‘মোসাদ’-কে সাহায্য করেছিল ভারতের ‘র’। ’৭১-এ পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধেও ইজরায়েলি গুপ্তচর সংস্থার সাহায্য নিয়েছিল ভারত।

পুরুষোত্তম: সেই গোপন সম্পর্কেরও ওঠা-নামা ছিল। ’৮২ সালে মুম্বইয়ে যিনি ইজরায়েলের কনসাল জেনারেল ছিলেন, তিনি সংবাদ মাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কড়া সমালোচনা করেছিলেন ভারতের। তার জন্য তাঁকে বহিষ্কার করে ভারত।

আনন্দবাজার: তার মানে, তলে তলে সেই পাঁচের দশক থেকেই ইজরায়েলের সঙ্গে একটা সম্পর্ক বজায় রেখে চলছিল ভারত। পারদের ওঠা-নামা সত্ত্বেও। কিন্তু তার ৪ দশক পর ’৯২ সালে কেন তদানীন্তন পি ভি নরসিংহ রাও সরকার ইজরায়েলের সঙ্গে পুরোদস্তুর কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিল?

পুরুষোত্তম: পুরোদস্তুর কূটনৈতিক সম্পর্কের অর্থ, একে অন্যের দেশে দূতাবাস খোলা। রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করা। পাঁচের দশক থেকে সেটা ছিল না। বিদেশ নীতি তৈরি হয় দু’টি জিনিসের ভিত্তিতে। একটি- ডোমেস্টিক মিলিউ। অভ্যন্তরীণ প্রয়োজন। অন্যটি- ইন্টারন্যাশনাল মিলিউ। আন্তর্জাতিক প্রয়োজন। সেই দু’টি প্রয়োজন থেকেই ’৯২ সালে ইজরায়েলের সঙ্গে পুরোদস্তুর কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলা হয় প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিংহ রাও সরকারের আমলে। সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন ভেঙে চৌচির হয়ে গিয়েছে। মাতব্বর বনে গিয়েছে আমেরিকা। শুরু হয়েছে আমেরিকার একাধিপত্য। নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার ঘোষণা করেছেন তদানীন্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ। এরই প্রেক্ষিতে নরসিংহ রাও সরকার ঠিক করল, ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য এ বার গুটি গুটি পায়ে এগোতে হবে।

আরও পড়ুন- মোদীর হাত ধরে অন্যতম বৃহৎ শক্তি হয়ে উঠছে ভারত: নেতানইয়াহু​

অরুণ: তবে তদানীন্তন কংগ্রেস সরকার তখন এটাও ঠিক করেছিল, এই সম্পর্কটাকে খুব একটা পাবলিক ডোমেনে বা প্রকাশ্যে আনা হবে না। কারণ, তাদের মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক ধরে রাখার বাধ্যবাধকতা ছিল।

পুরুষোত্তম: সোভিয়েতের দেওয়া অস্ত্রই তখন একমাত্র ভরসা ছিল ভারতের। সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ায় তাই চিন্তায় পড়ল ভারত। ইজরায়েল এগিয়ে এসে বলল, তারা অস্ত্র বা অস্ত্র বানানোর প্রযুক্তি দিতে পারে। সেই ইজরায়েল এখন ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। সেই ’৯২ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত বিশ্ব পরিস্থিতি অনেক বদলে গিয়েছে। প্রচুর পরিবর্তন ঘটেছে মধ্য এশিয়াতেও। সংযুক্তা যেটা বলছিলেন, আগে যেটা ছিল ‘কভার্ড’ সম্পর্ক, ’৯২ সালের পর ভারত-ইজরায়েলের সেই সম্পর্কটাই হয়ে ওঠে ‘ওভার্ট’!

অরুণ: ইজরায়েলের প্রতি ভারতের আগ্রহ বাড়ার আরও একটা কারণ ছিল। ’৯১-এ ভারতের অর্থনৈতিক মন্দা। হাতে টাকা নেই, সোভিয়েতও নেই যে, অন্তত ধারেও অস্ত্র কেনা যাবে। সোভিয়েতের দেওয়া অস্ত্রশস্ত্রের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য স্পেয়ার পার্টসও মিলবে না। ভরসা হয়ে উঠল ইজরায়েল। ইজরায়েল যখন যেচেই অস্ত্র বেচতে চাইছে, তখন কিছুটা সস্তায় ভারত অস্ত্র কিনতে পারবে। সেই সব অস্ত্র মেরামতির স্পেয়ার পার্টস পেতেও অসুবিধা হবে না।

আনন্দবাজার: শুধুই অস্ত্রের প্রয়োজন আর নতুন বিশ্ব পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতা? আর কোনও কারণ ছিল না ভারত-ইজরায়েলের কাছাকাছি আসার জন্য?

পুরুষোত্তম: অবশ্যই ছিল। ’৯২ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত দু’দেশের সম্পর্কের কাটাছেঁড়া করলে দেখা যাবে, মূলত তিনটি প্রয়োজন একে অন্যকে উত্তরোত্তর কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। ভারতের কৃষিক্ষেত্র। কৃষিতে ইজরায়েল তখন একটা দৃষ্টান্ত গড়ে ফেলেছে। মরুভূমিতেও ‘সোনা’ ফলিয়ে! চমকে দেওয়া প্রযুক্তি দিয়ে। সেই কৃষি প্রযুক্তি খুব প্রয়োজন ছিল ভারতের। এটা সংযুক্তাও জানেন। তখন ইজরায়েল ভারতকে বলেছিল কৃষির উন্নতির জন্য ড্রোন দেবে। ফসল বা জমিতে কোথায় কখন জল কতটা পরিমাণে দিতে হবে, কোন জমিতে কোন ফসল কতটা পরিমাণে ফলতে পারে, ড্রোন দিয়ে তার ল্যান্ড ম্যাপিং করা যাবে।

ইজরায়েলের চমকে দেওয়া কৃষি প্রযুক্তি: পোকামাকড়ের হাত থেকে ফসল বাঁচানোর উপায়। আলোও অবাধ সেখানে।

সংযুক্তা: সে তো বটেই। আমেরিকায় অত নদী। জলের অভাব নেই। তবু তার কৃষি উৎপাদন তেমন নয়। কিন্তু ইজরায়েলে অত নদী কোথায়? জলের দারুণ অভাব। তাতেও ফুল, বিভিন্ন রকমের শস্য উৎপাদনে ইজরায়েল চমকে দিয়েছে। ফল উৎপাদনও ওদের চমকে দেওয়ার মতো। ভারত ও ইজরায়েল যে কংগ্রেস জমানা থেকেই আরও কাছাকাছি আসতে শুরু করেছিল, তার আরেকটা প্রমাণ, ২০০৮ সালে ভারত-ইজরায়েলের একটি কৃষি চুক্তি। ইজরায়েলের কৃষি প্রযুক্তি দিয়েই রাজস্থানে ফসল উৎপাদনে বিরাট সাফল্য পাওয়া গিয়েছে।

অরুণ: এ ছাড়াও ‘কাটিং এজ টেকনোলজি’ ইউরোপ, আমেরিকার দেশগুলি থেকে পাওয়া মুশকিল। ওরা চট করে দিতে চায় না। দিলেও তার দাম খুব বেশি। এটাও ইজরায়েল দিয়েছে ভারতকে।

সংযুক্তা: ওদের (ইজরায়েল) জিডিপি দেখলে চমকে যাবেন। ভারতের অনেক কিছু নেওয়ার আছে ইজরায়েলের কাছ থেকে। গত বছর প্রধানমন্ত্রী মোদী ইজরায়েলে গিয়ে বলেছিলেন, আমাদের সম্পর্কের ভিত্তি ‘আই-টু-টি-টু’। মানে দু’টি ‘আই’ বলতে বুঝিয়েছিলেন ইন্ডিয়া আর ইজরায়েল। আর দু’টি ‘টি’ বলে বুঝিয়েছিলেন, ভারতের ট্যালেন্ট (প্রতিভা) আর ইজরায়েলের টেকনোলজি (প্রযুক্তি)-কে।

আনন্দবাজার: কিন্তু ভারত-ইজরায়েল সম্পর্কের এই নতুন রসায়ন আর ইজরায়েলের কাছে আসতে গিয়ে প্যালেস্তাইনের সঙ্গে ভারতের সম্ভাব্য দূরত্ব-বৃদ্ধি কি আরব দুনিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নষ্ট করবে না?

পুরুষোত্তম: একেবারেই করবে না। কারণ, বছর দশেক হল, বিশেষ করে, ‘আরব বসন্ত’-এর পর গোটা আরব দুনিয়ায় এক রকম ‘ভার্চুয়াল রেভোলিউশন’ এসে গিয়েছে। মতাদর্শের বিষয়টা বিশ্ব রাজানীতিতে আর ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রয়োজনটাই সেখানে অগ্রাধিকার পায়। যে ভাবে পেট্রো ডলারের দাম পড়েছে গত কয়েক বছরে হু হু করে, তাতে তেল আর প্রাকৃতিক গ্যাস বেচার বাজার ধরে রাখতে ঘাম ঝরাতে হচ্ছে আরব দুনিয়াকে।

আরব বসন্ত: ২০১০ সাল থেকে আরব মুলুকের দেশে দেশে শুরু হয়ে গিয়েছে সরকারবিরোধী আন্দোলন।

অরুণ: শুধু ইজরায়েলের পাশে যাওয়ার ‘ক্ষোভ’-এ সে ক্ষেত্রে ভারতকে ‘দুর ছাই’ বলার দিন আর নেই আরব দুনিয়ার। ভারতের বড় বাজার ধরে রাখাটা তারও খুব প্রয়োজন। ভারত, ইজরায়েল দু’টি দেশেরই একে অন্যকে প্রয়োজন। তাই ’৯২-এ ইজরায়েলের সঙ্গে ভারতের পুরোদস্তুর কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার পর দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ২০ কোটি ডলার থেকে ২০০২ সালে পৌঁছয় ৪০ কোটি ডলারে। আর তাতে প্রতিরক্ষার চেয়েও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে প্রযুক্তি। তা সে কৃষির জন্যই হোক বা সাইবার ক্ষেত্রে। পাশাপাশি তেল আর প্রাকৃতিক গ্যাসের বাজার ধরে রাখার জন্য ভারতকেও খুব দরকার আরব দেশগুলির।

পুরুষোত্তম: সেটাই বলতে চাইছি। লড়াইয়ে টিঁকে থাকার জন্য আরব দুনিয়ার কাছে এখন প্যালেস্তাইন ইস্যুটি অনেক গৌণ হয়ে গিয়েছে। সন্ত্রাসবাদে জর্জরিত হয়ে পড়ার ফলে আরব দেশগুলি আর ততটা প্রকাশ্যে প্যালেস্তাইনের হয়ে কথা বলতে পারছে না।

অধ্যাপক সংযুক্তা ভট্টাচার্য ও অধ্যাপক পুরুষোত্তম ভট্টাচার্য

সংযুক্তা: এটাও যে খুব সাম্প্রতিক, তা নয়। হচ্ছে সেই ’৯২ সাল থেকেই। ইজরায়েলের সঙ্গে ওই সময় ভারত যখন পুরোদস্তুর কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলল, তখন আরব দুনিয়ার কোনও দেশই খাতায়, কলমে তার বিরুদ্ধে মুখ খোলেনি। একমাত্র হোসনি মুবারকের মিশর ছাড়া। তাই ইজরায়েলের সঙ্গে ভারতের ভাবসাব বাড়লে আরব দুনিয়া দিল্লি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, আমরা অন্তত তা মনে করি না।

আনন্দবাজার: ইজরায়েল একটি অস্ত্রনির্মাতা দেশও। তাই প্রতিরক্ষায় ইজরায়েলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আরও জোরদার হয়ে উঠলে তা আমাদের দুই প্রতিবেশী চিন ও পাকিস্তানের পক্ষে কতটা উদ্বেগের হবে?

অরুণ: আমাদের মনে হয়, এটা নিয়ে চিন বা পাকিস্তান কেউই বিশেষ ভাবছে না। চিন বরং বেশি চিন্তিত, আমেরিকার সঙ্গে ভারতের ভাবসাব বেড়ে যাওয়ায়। তাতে এশিয়ায় চিনের ‘দাদাগিরি’ অনেকটাই কমে যাবে।

আর পাকিস্তান ও সব নিয়ে ভাবার মতো অবস্থাতেই নেই। কারণ, অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস সহ নানা রকমের সমস্যায় জর্জরিত হয়ে রয়েছে পাকিস্তান। গত কয়েক বছরে পাকিস্তানে বিদেশি বিনিয়োগ কমে গিয়েছে অন্তত ৯৩ শতাংশ। পাকিস্তান সে সব নিয়েই এখন বেশি চিন্তিত। তাই ইজরায়েলের সঙ্গে ভারতের প্রতিরক্ষা চুক্তি কী হল, তা নিয়ে ভাবার ফুরসতই পাচ্ছে না ইসলামাবাদ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE