রোখা যাবে জাল নোটের কারবার?
নোট বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্ত আর তার পরবর্তী ‘আসল’ নোটের দেশজোড়া বিপুল হাহাকার— এর সঙ্গে এখন পরিচিত আম আদমি। ব্যাঙ্ক, এটিএমের সুদীর্ঘ লাইন এখন সমস্যার হাইওয়ে ছেড়ে সোশ্যাল মিডিয়ার টিপ্পনির এঁদো গলিতে। কালো টাকা আর জাল নোট পাকড়াও করার ‘মোদী’য় আশ্বাসের ডিঙিতে সওয়ার হয়ে দুর্নীতিহীন সেই ইউফোরিয়ায় পৌঁছতে চাইছে মানুষ। যাবতীয় অসুবিধা মাথায় করে নিয়ে আম আদমির বক্তব্য, ভাল কাজে প্রাথমিক কিছু সমস্যা তো হবেই। কিন্তু এ তো গেল আবেগের কথা। তথ্য কী বলছে? ৫০০ আর হাজারের নোট বাতিল করে জাল নোটের কারবারে কতটা রাশ টানা সম্ভব?
চলতি মাসের গোড়ায় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে ৫০০ এবং হাজারের নোট বাতিল ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। বাজারে চলা নোটের সিংহ ভাগ (প্রায় ৮৬ শতাংশ) ছিল ৫০০ আর হাজারের দখলে। নোট জাল করতে সিদ্ধহস্তদের প্রভাব তখন এতটাই প্রবল যে, আসল আর নকল নোট আলাদা করাই দুষ্কর। সাধারণ মানুষ তো বটেই, নোট চিনতে যে দুঁদে ব্যাঙ্ক কর্মীরাও নাজেহাল, একটি সরকারি তথ্যই তার জন্য যথেষ্ট। সরকারের হিসাব বলছে, প্রতি ২৫০টি জাল নোটের মধ্যে চিহ্নিত হয় মাত্র ১৬টি নোট। তাই বাজার থেকে পুরনো নোট তুলে নিয়ে নতুন নোট আনলে জাল নোটের কারবার থমকে যাবে বলে দাবি করেছিল কেন্দ্র। নতুন নোট জাল করা কার্যত অসম্ভব বলেও ঠারেঠোরে জানিয়েছিল কেন্দ্র। প্রথমে শোনা গিয়েছিল নতুন ২০০০-এর নোটে রয়েছে মাইক্রোচিপ। জাল নোট এবং কালো টাকা আটকাতে যা মিরাকলের মতোই কাজ করবে। পরে অবশ্য সরকার এই চিপের অস্তিত্ব অস্বীকার করে। নোট বাতিল অধ্যায়ের আগে পর্যন্ত বাজারে চালু ছিল প্রায় ন’হাজার কোটি নোট। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে ছ’লক্ষ ৩০ হাজার অর্থাৎ ০.০০০৭ শতাংশ জাল নোট। অর্থাত্ প্রতি ১০ লক্ষে জাল নোটের সংখ্যা ৭টি। ২০১৫-১৬ অর্থবর্ষের হিসাব বলছে, বাজারে চালু জাল নোটের মোট অঙ্ক ২৯ কোটি ৬৪ লক্ষ টাকা। দেশে চালু অর্থাঙ্কের যা ০.০০১৮ শতাংশ। তবে সরকারি এই তথ্যে বাজেয়াপ্ত হওয়া টাকার হিসাব নেই। তা বাজেয়াপ্ত হওয়া অর্থের পরিমাণ ঠিক কত? গত সপ্তাহে লোকসভায় পেশ হওয়া ন্যশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৫ সালে দেশে বাজেয়াপ্ত হয়েছে ৪৩ কোটি ৮০ লক্ষ টাকার জাল নোট। চলতি বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হয়েছে আরও প্রায় ২৮ কোটি। অর্থাৎ সব মিলিয়ে জাল টাকার পরিমাণ কোনও ভাবেই ১০০ কোটির বেশি নয়।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এই দাবির সঙ্গে কিন্তু মিলছে না সরকারেরই অন্য একটি সমীক্ষার রিপোর্ট। গত বছর ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইনস্টিটিউট এবং এনআইএ-র করা একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, বাজারে চালু জাল টাকার পরিমাণ প্রায় ৪০০ কোটি। এবং প্রতি ১০ লক্ষ নোটের ২৫০টি জাল। রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, এই জাল নোটের বেশির ভাগই ঘোরাফেরা করে সীমান্ত অঞ্চলে।
নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের পক্ষে যাঁরা, তাঁদের মতে, সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে এই মুহূর্তে দেশে জাল টাকা প্রায় নেই। ফলে সাময়িক সমস্যা হলেও ভবিষ্যতের জন্য এ এক কালজয়ী পদক্ষেপ। অবশ্য এর পাল্টা যুক্তিও আছে। সেই পক্ষের মতে, মাত্র ০.০০০৭ শতাংশ জাল নোট (রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী) রুখতে সব টাকা বাতিল তো মশা মারতে পরমাণু হামলার সমান! তা না করে কি জাল টাকা ধরতে আর একটু সচেষ্ট হতে পারত না সরকার? এর আগে মনমোহন সিংহের জমানায় ₹ চিহ্ন নিয়ে নতুন ৫০০-র নোট বাজারে আসার পর তা জাল হতে খুব বেশি দিন সময় লাগেনি। নতুন নোটের ক্ষেত্রেও যে তেমন কিছু ঘটবে না, তার নিশ্চয়তা কিন্তু সরকারের তরফে এখনও পাওয়া যায়নি। সরকার বা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কিন্তু এখনও তেমন কিছু ঘোষণা করেনি, যা শুনে আম আদমি নিশ্চিত হবেন যে তার কাছে থাকা নোট জাল হবে না। তাই প্রশ্ন থাকছেই, জাল নোট রুখতে পর্বতের মুষিক প্রসব করল না তো কেন্দ্র? এর উত্তর দেবে সময়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy