Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

ব্রহ্মকে নয়ছয়! নষ্টের গোড়া সোশ্যাল মিডিয়াই

নন্দিনী শতপথীর মুখ্যমন্ত্রিত্বের আমলেও এমনটা হয়নি নবকলেবরে! চার দশক আগের সেই ওড়িশায় নবকলেবর ধারণের দিনে জনবিস্ফোরণে পদপিষ্ট হয়ে বেশ কয়েক জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। কিন্তু এ সব ঝামেলা তখনও ছিল না। দ্বাদশ শতকীয় জগন্নাথ মন্দিরের নতুন উপদ্রবের নাম সোশ্যাল মিডিয়া। ওড়িশা প্রশাসনের কর্তারা যা এখন হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছেন।

পুরীর মন্দিরের সামনে বিজেপি-র বাইক বিক্ষোভ। ছবি: রণজিৎ নন্দী।

পুরীর মন্দিরের সামনে বিজেপি-র বাইক বিক্ষোভ। ছবি: রণজিৎ নন্দী।

ঋজু বসু
পুরী শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০১৫ ০৩:৫৮
Share: Save:

নন্দিনী শতপথীর মুখ্যমন্ত্রিত্বের আমলেও এমনটা হয়নি নবকলেবরে!

চার দশক আগের সেই ওড়িশায় নবকলেবর ধারণের দিনে জনবিস্ফোরণে পদপিষ্ট হয়ে বেশ কয়েক জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। কিন্তু এ সব ঝামেলা তখনও ছিল না।

দ্বাদশ শতকীয় জগন্নাথ মন্দিরের নতুন উপদ্রবের নাম সোশ্যাল মিডিয়া। ওড়িশা প্রশাসনের কর্তারা যা এখন হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছেন।

মন্দিরের মুখ্য প্রশাসনিক আধিকারিক তথা আইএএস-কর্তা সুরেশ মহাপাত্র মঙ্গলবার সেটাই বলছিলেন, ‘‘সোশ্যাল মিডিয়াই যত নষ্টের গোড়া। মন্দিরের গুপ্ত রীতিতে এমন উঁকিঝুঁকি কখনও দেখা যায়নি। যত গুজবের উত্পত্তিও সেখানেই।’’ পুরনো নবকলেবরের অনুষ্ঠানগুলির সঙ্গে নজরদার সোশ্যাল মিডিয়া, হোয়াট্‌সঅ্যাপ, ফেসবুক ইত্যাদির উপস্থিতিই এ বার ফারাক করে দিচ্ছে বলে সুরেশ মনে করছেন।

নবকলেবরে ব্রহ্ম পরিবর্তনের দুর্ঘটনার সঙ্গে পাল্লা দিয়েই নানা ভুয়ো ছবি ইন্টারনেটে উঠে আসছে। তার মধ্যে কিছু-কিছু ‘ভুয়ো ছবি’ বলে স্থানীয় খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছে। সমাজের নানা স্তরে ক্ষোভও বাড়ছে। ওড়িশা প্রশাসন যে এ বিষয়ে কড়া পদক্ষেপ করবে তা জগন্নাথ মন্দিরের মুখ্য প্রশাসনিক আধিকারিক এ দিন স্পষ্ট করে দিয়েছেন। বলছেন, ‘‘ফেসবুকে আজেবাজে ছবি দিয়ে যাঁরা মানুষের ভাবাবেগ নিয়ে খেলছেন, তাঁরা কিছুতেই পার পাবেন না। যারা এ সব করছে, তাদের খুঁজে বার করে গ্রেফতার করার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’’

কটকে ওড়িশার একমাত্র সাইবার ক্রাইম থানাকে তদন্তভার দেওয়া হয়েছে। ওড়িশার সিআইডি-র এডিজি বিজয় কুমার শর্মা বিষয়টির দেখভাল করছেন। তিনি বলেন, ‘‘ভারতীয় দণ্ডবিধি ও তথ্যপ্রযুক্তি আইন দু’টোকে কাজে লাগিয়েই দোষীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।’’ তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬এ ধারাটি কেন্দ্র তুলে নেওয়ায় সোশ্যাল মিডিয়ায় অপকীর্তির মোকাবিলা করা খানিকটা অসুবিধে হয়েছে। তবে পুলিশকে গোলমাল বা সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জোরদার আইন প্রয়োগ করে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে বলে মন্দিরের মুখ্য প্রশাসনিক আধিকারিক জানাচ্ছেন।

তাঁর ক্ষোভ, ‘‘ইউটিউব না কোত্থেকে পুরনো শালগ্রাম শিলার ছবি দেখিয়ে তা ব্রহ্ম বলে চালানোর চেষ্টা চলছে। এখনও অসমাপ্ত নতুন বিগ্রহের ভুয়ো ছবিও প্রচার হচ্ছে।’’ তাঁর আশ্বাস, ব্রহ্ম নিরাপদ ও গুপ্ত আছে। নতুন বিগ্রহও সব রীতি মেনে সেজে উঠছে। অনধিকারী কেউ তা দেখতে পাননি। পাবেনও না।’’

তবে আমজনতার ক্ষোভ থেকে সুরেশ নিজেও রেহাই পাচ্ছেন না। এ দিন সকালেই বিজেপি-র বাইকবাহিনী মন্দিরের সিংহদরজার সামনে অভিযান চালিয়ে স্লোগান দিল। তাতে মুখ্য প্রশাসনিক আধিকারিকেরও পদত্যাগের দাবি উঠেছে। কংগ্রেসও ইতিমধ্যে প্রশাসনের বিরুদ্ধে ব্রহ্মকে ‘বেচে’ দেওয়ার অভিযোগ করেছে। কংগ্রেসের ডাকে উত্তেজনায় ভরপুর ‘ওড়িশা বন্‌ধ’-এর পরে এ দিনই বিজেপিও তাদের কর্মসূচি শুরু করেছে। মন্দিরলাগোয়া গ্র্যান্ড রোডে সমাবেশ করেন রাজ্যের সবেধন নীলমণি বিজেপি সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জুয়েল ওরাম, বিজেপি-র প্রোগ্র্যাম ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটির সভাপতি বিজয় মহাপাত্র প্রমুখ। সেখানে ‘জগন্নাথ ধর্ম, জগন্নাথ সংস্কৃতি’ বলে আওয়াজ ওঠে। রাজ্য জুড়ে সুসজ্জিত ট্যাবলো সাজিয়ে ‘জগন্নাথ সংস্কৃতি সুরক্ষা যাত্রা’-য় পথে নেমেছে বিজেপি। রাজ্যে বিরোধীদের তরফে সিবিআই বা বিচারবিভাগীয় তদন্ত থেকে মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েকের ইস্তফা— সব দাবিই বাতাসে ঘুরপাক খাচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে শাসক দল বিজেডি খানিকটা কৌশলী ভঙ্গিতে নীরবতা বজায় রাখছে। মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েক ‘স্পর্শকাতর’ বিষয়টি নিয়ে কোনও মন্তব্যই করেননি। রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে বিজেডি সূত্রে জানানো হয়েছে, শাসকদলের তরফে নবকলেবর ও রথযাত্রার উত্সব সুষ্ঠু ভাবে না মেটা পর্যন্ত বিধানসভার অধিবেশন হবে না। বিরোধীরা যাতে বেশি গোলমাল পাকাতে না-পারে, তার জন্যই এই ব্যবস্থা।

তবে নানা বিষয়ে ক্ষোভ থাকলেও জগন্নাথ মন্দিরের অন্দরমহল নিয়ে রাজনীতি খুব ভাল চোখে দেখছে না জগন্নাথ ক্ষেত্র। দয়িতাপতিদের সংগঠনের সভাপতি রামকৃষ্ণ দাস মহাপাত্র ওরফে রাজেশ দয়িতাপতির কথায়, ‘‘ধর্ম, আচার-অনুষ্ঠান তার জায়গায়, রাজনীতি আলাদা। দু’টো মেলানো ঠিক নয়।’’ মুখ্য দয়িতাপতি জগন্নাথ সোয়াঁইন মহাপাত্রও এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে এক সুর।

নবকলেবরের প্রাক্কালে এই বিসম্বাদের পাশাপাশি, রেললাইন মেরামতির জেরে ট্রেন-বিভ্রাটেও পুরীগামী জনতা নাজেহাল হচ্ছে। ট্রেন দেরি করছে নিয়মিত। তবু এ সব উপেক্ষা করেই ভক্তদের আসা-যাওয়া চলছে। যেমন মিজোরামের অ্যাডভোকেট জেনারেল বিশ্বজিৎ দেব। ঝটিকা-সফরে ট্রেন-বিভ্রাটের জেরে খুরদা রোডে নেমে গাড়ির ব্যবস্থা করে এই পুণ্য লগ্নে ঠাকুরের কাছ থেকে ঘুরে গেলেন।

যা হওয়ার জগন্নাথের ইচ্ছায় হয়েছে, যা হবে তাঁর ইচ্ছেতেই হবে— এই বিশ্বাসে ভর করেই আপাতত নবকলেবরের আনন্দময় সমাপ্তির অপেক্ষা করছে পুরী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

puri riju bose jagannath IAS india
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE