ভক্ত সমাগমে জমজমাট পুরী। সোমবার রণজিৎ নন্দীর তোলা ছবি।
মন্দিরের দক্ষিণ দিকে গর্ভগৃহ থেকে বেরনোর দরজার মুখে ঠায় দাঁড়িয়ে স্বয়ং ব্রহ্মা ও শিব।
হতে পারেন দেবাদিদেব। তবে আপাতত তাঁদেরও ভিতরে ঢোকার অনুমতি নেই!
জগন্নাথ মন্দিরে মুখে মুখে ফিরছে সেই কাহিনি। নবকলেবর ধারণের আগে দেড় মাস বিষ্ণু তথা জগন্নাথ এমন সবার চোখের আড়ালে চলে যাবেন শুনে অনুযোগ করেছিলেন শিব ও ব্রহ্মা— ‘তুমি তো কখনও আমাদের থেকে আলাদা থাকো না।’ বিষ্ণু হেসে বলেন, ‘না, না এই সময়টা আমার অসুস্থ হওয়ার সময়! আমার শবর ভাইরা ছাড়া এই ক’দিন আর কেউ আমার কাছে আসবে না।’ তাই এমন নিয়ম। গর্ভগৃহের দক্ষিণ দরজায় তাই ব্রহ্মা ও শিব মূর্তির অধিষ্ঠান।
এই দরজার কয়েক পা দূরেই তালপাতার পর্দা ফেলা হয়েছে। সেটাই ‘লাইন অব কন্ট্রোল’। এখনও মন্দিরে রাত-দিন শয়ে শয়ে আসা দর্শনার্থীদের তার ও-পারে যাওয়ার নিয়ম নেই। পর্দার পিছনে গর্ভগৃহের দক্ষিণ দরজার ভিতরেই এখন ‘অসুস্থ’ ঈশ্বরের অধিষ্ঠান। হতে পারেন ‘অসুস্থ’! তবু সাধারণ দর্শনার্থীদের চোখের আড়ালে থেকেও তিনিই যে গোটা ওড়িশা, হয়তো বা আরও বৃহত্তর পরিসরের আবেগ ‘কন্ট্রোল’ করছেন, তা মালুম হয় এই জগন্নাথধামে এলেই।
ঈশ্বরের নবকলেবর-ধারণ ও রথযাত্রার প্রাক্কালে এখন মন্দিরে জগন্নাথ দর্শনের উপায় নেই। তবু বিশ্বাসী ভক্তদের নিরন্তর আসা-যাওয়ায় ছেদ পড়ছে না। কারও কারও বিশ্বাস, দর্শন হবে না জেনেও এ সময়ে অসুস্থ ঠাকুরকে দেখতে এলে নাকি ঈশ্বর আরও প্রীত হন।
তবে নবকলেবরের ব্রহ্ম বা ঘট-পরিবর্তনের ‘দুর্ঘটনা’র খবর জানাজানি হওয়ার পরে প্রশাসন এখন কাঁটা হয়ে আছে। আজ ওড়িশা সরকার সে দিনের ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছে এক শীর্ষ আইপিএস অফিসারকে। ব্রহ্ম স্থাপনের যে সব ‘ভুয়ো’ ছবি বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ছড়িয়েছে, সেগুলোও খতিয়ে দেখবেন তিনি।
নিয়ম অনুযায়ী, রথের আগের দিন অমাবস্যায় নবযৌবন-মূর্তিতে সুসজ্জিত হয়ে সব ভক্তদের সামনে প্রকট হওয়ার কথা জগন্নাথের। কিন্তু মন্দিরে ভিড়ের চাপে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, এই আশঙ্কায় প্রশাসন অনুষ্ঠানে রদবদল ঘটিয়েছে। ঠিক হয়েছে, নবকলেবরের শেষ পর্যায়ে নবযৌবন উত্সবটা এ বার আমজনতার চোখের আড়ালেই সারা হবে। অসুস্থ দশায় ঈশ্বরের গুপ্তসেবা যাঁরা করছেন, জগন্নাথের আপন জন শবর বংশের দৈতাপতিদের সঙ্গে মন্দিরের অন্য জাতের সেবায়েত-পুরোহিতরা সে দিন দর্শনের অনুমতি পাবেন। আর কেউ মন্দিরে ঢুকতে পারবে না। সর্বসাধারণের জন্য জগন্নাথদেব রথযাত্রার দিনে রথে সওয়ার হয়েই দর্শন দেবেন।
সে অবশ্য পরের কথা। আপাতত ঈশ্বরের নবকলেবর ধারণের খুঁটিনাটি চর্চায় ভক্তেরা বিভোর। জগন্নাথদেব ও লক্ষ্মীর ফি-বছর বিয়ে হয় যে মণ্ডপে, শবররাজ বিশ্বাবসুর বংশধর বলে পরিচিত দৈতাপতিরা সোম-সন্ধ্যায় সেখানেই বসেছিলেন। ‘‘ঠিক মানুষ যেমন রক্ত-মাংস-অস্থি-মজ্জা-চর্মের সৃষ্টি, প্রভুও একেবারে তাই! এ আমরা অন্তর থেকে বিশ্বাস করি!’’— বলছিলেন প্রবীণ দৈতাপতি গণেশ-রামচন্দ্রেরা।
সবিস্তার আনুষ্ঠানিকতায় বিশেষ লক্ষণযুক্ত নিমকাঠের যে নতুন বিগ্রহে ক’দিন আগে ঘট বা ব্রহ্ম স্থাপন করা হয়েছে, তা আদতে ঠাকুরের অস্থিপ্রতিম বলে মনে করেন জগন্নাথ-ভক্তেরা। নবযৌবন উত্সবের দিন পর্যন্ত তিলে-তিলে তাতে রক্ত-মাংস-মেদ-মজ্জা লাগবে। কী ভাবে? গুপ্তসেবার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁরা কেউ এ বিষয়ে মুখ খুলবেন না।
কিন্তু জগন্নাথক্ষেত্রের ইট-কাঠ-পাথরেও যেন কিংবদন্তীর ছড়াছড়ি। মন্দিরের কর্মকর্তারা বলেন, ‘গুপ্তসেবা, কিন্তু চলছে সবার চোখের সামনেই। যিনি বোঝার ঠিক বুঝে নেবেন!’
মন্দিরে মা লক্ষ্মীর পূজাস্থল লাগোয়া মণ্ডপেই সন্ধ্যায় এক দল সেবায়েতকে হলুদরঙা মোলায়েম সুতোয় টান দিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বিনুনি করতে দেখা গেল। মন্দিরের পরিভাষায়, এই সুতোর নাম পাট। পরম্পরাগত এ কাজের দায়িত্বে যাঁরা, তাঁরা হলেন ‘পাটরা বিষয়ী’। তাঁদের প্রধান জগন্নাথ পাত্র বললেন, ‘‘গুপ্তসেবা! এ হল প্রভুর শিরা-উপশিরা! আপনি যেমন, প্রভুও তেমন! আর কিছু বলা যাবে না।’’
অভিজ্ঞ ভক্তেরা জানেন, কাঠের বিগ্রহে প্রথমে এই পাটের প্রলেপ পড়বে। তার উপরে ওসুয়ো বা এক ধরনের ধুনোবাটা মাখানো হবে। নির্দিষ্ট দিনে গন্ধতেল বা‘ফুলুরি তেল’ লেপণ হবে। শুক্লা নবমীতে নব কলেবরের শ্রীঅঙ্গে খড়িলাগি বা শ্বেত অঙ্গরাগ হবে। তারপরে সর্বাঙ্গে চন্দন লেপণ। এক-একটি বিগ্রহের জন্য নাকি, এক কুইন্টাল করে চন্দন লাগে!
বিশ্বাসীদের চোখে, এ সব উপকরণই প্রভুর শরীরের নানা অংশ। নবযৌবন উত্সবের দিনেই বংশ পরম্পরায় ‘রূপকার’, মন্দিরের দত্ত মহাপাত্রেরা দৈতাপতিদের নির্দেশে বিগ্রহে চক্ষুদান সম্পূর্ণ করবেন।
এখন মন্দিরে কখনও ভোর রাতে ঠাকুরের ভোগের সূপকাররা উত্তর দিকে পাতালশিবের মন্দিরের পাশের ঘরটায় ধুনো গুঁড়িয়ে বাটতে বসছেন।
মন্দিরের পশ্চিম দিকের বাঘ দরজার কাছে কয়েকশো বছরের পুরনো ওড়িয়া মঠে শেষ মুহূর্তে দেখা হচ্ছে, ঠিকঠাক হয়েছে তো প্রভুর গায়ের গন্ধতেল। খাঁটি তিলের তেলের সঙ্গে মন্ত্রপূত জড়িবুটি ও জুঁই, বেল, চাঁপার মতো সুগন্ধী ফুল মিশিয়ে এক বছর ধরে গোপনে তৈরি হয় সে তেল। এ আবার জগন্নাথদেবের ওষুধও। ফি-বছর স্নানযাত্রায় বৃষ্টিতে ভিজে প্রভুর বাঁধাধরা জ্বর হয়। ম্যাজমেজে গায়ে তিনি একটু উঠে বসার পরে এ তেল মাখিয়ে দেন দৈতাপতিরা।
নবকলেবরের পথে এ ‘ফুলুরি তেল’ লেপণের দিনটার দিকে তাকিয়ে আছেন মুখ্য দৈতাপতি জগন্নাথ সোয়াঁইন মহাপাত্রও। ‘‘সে-দিন মন্দিরে বাজা বাজবে। প্রভু তুলসীমালা পরবেন। আর আমার ১১ মাসের নাতিটাও সে-দিনই দৈতাপতি হিসেবে দীক্ষা নেবে।’’
জগন্নাথের বড় ছেলে রাজকুমার মুম্বইয়ে ব্যবসার কাজ ফেলে পুরী এসে মস্তক মুণ্ডন করে মাসভর দৈতাপতির ব্রত পালন করছেন। তাঁর পুত্রকেও একদিন তা মানতে হবে।
রাতভর গুপ্তসেবায় দৈতাপতিরা মিলে অসুস্থ ‘বড় ভাই’য়ের হাত-পা টেপাটেপি করেন। পাখার হাওয়া বুলিয়ে তাঁকে ঘুম পাড়ান। অসুস্থ ঈশ্বর শুধু রাতে দু’বার সর-রাবড়ি-আম-পাকা কাঠাল খান। বিপুল ভোগ প্রভুকে খাইয়ে দৈতাপতিরা যতটা পারবেন, খাবেন। সে-খাবার গুপ্ত সেবার স্থান থেকে বার করা বা আর কাউকে বিতরণ করা নিষেধ।
এ সব পরম্পরাই দ্বাদশ শতকীয় মন্দিরের সূচনাপর্ব থেকে চলে আসছে। হাতে আর আড়াই সপ্তাহ! রাজনৈতিক গোলযোগ বা বিতর্ক যাই থাকুক! নবকলেবর ধারণ পর্যন্ত নির্বিঘ্নে পরম্পরা রক্ষাই একমাত্র অভিষ্ট ওড়িশা প্রশাসনেরও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy