Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ছেলেটা মরেছে, বিচারটাও মরল

পরপর তিন ধাপে ত্রিস্তরীয় পুলিশি ঘেরাটোপ পেরিয়ে পুরনো শহরের ঘিঞ্জি গলির আটপৌরে ঘরে পৌঁছনো গেল সন্ধ্যায়।

সে দিনের সাক্ষী সাব্বির ও মহাদেব। নিজস্ব চিত্র

সে দিনের সাক্ষী সাব্বির ও মহাদেব। নিজস্ব চিত্র

সন্দীপন চক্রবর্তী
হায়দরাবাদ শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৮ ০৫:০১
Share: Save:

মোবাইল দিয়ে যান আমাদের কাছে। ভিতরে ১০ মিনিটের বেশি থাকবেন না। বেশি কথা বলাবেন না।

পরপর তিন ধাপে ত্রিস্তরীয় পুলিশি ঘেরাটোপ পেরিয়ে পুরনো শহরের ঘিঞ্জি গলির আটপৌরে ঘরে পৌঁছনো গেল সন্ধ্যায়। বিছানায় বসে সৈয়দ আতিক। ঘরের মেঝেয় একগাদা লোক। চারমিনারের কাছে চুড়়ির দোকান আতিকের। সেই ২০০৭ সালের মক্কা মসজিদে বিস্ফোরণে দুই পরিজনকে হারিয়েছেন। তার পর ১১ বছর ধরে থানা-পুলিশ, আদালতের চক্কর কেটেছেন। সোমবার থেকে তাঁর মনে হচ্ছে, সব শেষ!

‘‘নমাজের মধ্যে বিস্ফোরণ হল। এত লোক দেখল, শুনল। আদালত বলে দিল, কেউ দোষী নয়? আমাকে এক বার নিয়ে যাবেন ওই বিচারকের কাছে? এক বার জানতে চাইব, কী করে হয় এ রকম?’’ প্রশ্ন থামছিল না মধ্যচল্লিশের আতিকের।

মক্কা মসজিদের ঠিক বাইরেই ফলের দোকান ছিল মহম্মদ জাফরের। জুম্মার নমাজ থেকে সে দিন বার করে আনা হয়েছিল তাঁর রক্তাক্ত শরীর। পুলিশের অ্যাম্বুল্যান্সে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই মৃত্যু। সেই হাসপাতাল-যাত্রার সঙ্গী সাব্বির আজ বলছিলেন, ‘‘সিবিআই তো বলেছিল, মসজিদে কারা বোমা রেখেছিল, তাদেরও নাকি ধরেছে। তার পরেও সবাই খালাস! ছেলেটা তো আগেই মারা গিয়েছে। এ বার বিচারটাও মরে গেল!’’ তাঁরই পাশে বসে জলের পাউচ বেচেন মহাদেব। মহারাষ্ট্রের আকালোয় আদি বাড়়ি। প্রায় স্বগতোক্তির ঢঙে প্রৌঢ়় যোগ করলেন, ‘‘নিরীহ মানুষ যখন আল্লার কাছে দুয়া চাইছে, সেই সময় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মৃত্যু! এর চেয়ে অন্যায় আর কিছু হয়? আদালত ছেড়়ে দিতে পারে। কিন্তু যারা এ কাজ করেছে, উপরওয়ালা তাঁদের ছাড়়বেন না!’’

আতিক, সাব্বির, মহাদেবদের বিপরীত বিন্দুতে দাঁড়়িয়ে জে পি শর্মা অবশ্য জানাচ্ছেন, আইনের কাছে এ সব আবেগের কোনও দাম নেই। তদন্তকারীরা ২২৬ জন সাক্ষী পেশ করেও প্রমাণ করার মতো কি‌ছু পাননি। তাই এনআইএ-র বিশেষ আদালত অভিযুক্ত ৮ জনকেই বেকসুর খালাস করে দিয়েছে। বাংলার গোঘাটের নবকুমার সরকার তথা হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ‘অভিনব ভারত’-এর নেতা স্বামী অসীমানন্দ সেই তালিকায় এক নম্বর। তাঁরই কৌঁসুলি শর্মার সাফ কথা, ‘‘গেরুয়া সন্ত্রাস বলে বিরাট হইচই হয়ে গেল! অথচ এ রকম কিছু নেই!’’ এনআইএ-র তরফে যদিও বলা হচ্ছে, রায়ের প্রতিলিপি দেখে তারা উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথা ভাববে।

‘গেরুয়া সন্ত্রাস’ নিয়েই এখন বিস্তর রাজনৈতিক বিতর্ক। বিস্ফোরণের পরে প্রথমে দায় স্বীকার করেছিল ইসলামি সংগঠন হুজি। কয়েক জনকে গ্রেফতারও করা হয়। পরে তাঁরা ছাড়়া পান। এর পরে আসে গেরুয়া সন্ত্রাসের অভিযোগ এবং অসীমানন্দের পর্ব।

এই বিতর্কের মাঝেই চতুর্থ অতিরিক্ত নগর দায়রা বিচারক কে রবিন্দর রেড্ডি শুধু নীরব। এনআইএ-র বিশেষ আদালতের বিচারক হিসেবে রায় দিয়েই যিনি ইস্তফা দিয়েছেন। নামপল্লিতে তাঁর দফতরে গিয়ে শুনে আসতে হল, এখন কোনও কথা নয়!

কথা থামছে না শুধু আতিকদের। আর হাসতে হাসতে শর্মাও শোনাচ্ছেন, ‘‘বাঙালিরা স্বাধীনতা সংগ্রামী হয়! সন্ত্রাসবাদী হয় নাকি?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE